tajhat jpg

একটি শহর এর রূপ যতটা না আকর্ষনীয় তার চেয়ে বেশি চমক রয়েছে এ শহরের নামে সুনামে। নিঃসন্দেহে শহরটির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কাল যত দীর্ঘতা ছড়িয়েছে এর ঐতিহ্য ততই সুঘ্রাণে ভরেছে। বলা হচ্ছে বাহের দেশ রংপুর মহানগরের সবচেয়ে ছোট প্রশাসনিক নগরী তাজহাট থানা অঞ্চলের কথা।

রংপুর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৬ কি.মি. দক্ষীণে অবস্থিত রয়েছে তাজহাটের সেই এতিহাসিক স্থাপনা তাজহাট রাজবাড়ি। রাজবাড়িটি মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে নির্মাণ করেছিলেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। কথিত মতে মহারাজার মুকুট বা তাজটি ছিলো খুবই মনমুগ্ধকর। তার সেই তাজের সৌন্দর্য থেকেই কালক্রমে অঞ্চলের নামকরণ হয় তাজহাট। এবং আরপিএমপি গঠনের পর তাজহাটের নামেই সৃস্টি হয় তাজহাট থানা।

 

আজ মহারাজা নেই কিন্তু দাড়িয়ে আছে মহারাজার নির্মিত সেই আলিসান প্রাসাদটি। যা এখন সরকারি উদ্যোগে যাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক এখানে এসে প্রাসাদের নিপুণ ও শৈলপিক কাজগুলো পরিদর্শন করছেন। দেখছেন যাদুঘরের ভেতর বাহির।

তাজহাট জমিদার বাড়ির চারপাশ এখন সবুজ বনায়ন বেষ্টিত। শহরের মানুষ একটু প্রশান্তির খোজে এখানেই আসেন। ঘুরে বেড়ান এর আঙ্গিনাকোলে। চতুর্ভূজ আকৃতির সীমানা প্রাচীরের বিশাল আয়তনে শোভা পাচ্ছে সবুজ-হলুদের মিশ্রণে ফোটা হরেক ফুল।

এ ফুলের সুভাসে তাজহাটের সুনাম দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে শহর ও বিশ্বজুড়ে।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠনের পর রংপুর সিটি কর্পোরেশন এর ১৫, ২৮, ২৯, ৩১, ও ৩২ নং ওয়ার্ডের মোট ১৪টি মৌজা নিয়ে তাজহাট থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাজহাট থানা অঞ্চলে বসবাস কৃত মোট জনসংখ্যা ১লাখ ৮৫ হাজার। মোট মহল্লা সংখ্যা ৯০টি।

এ নগরের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে মাহীগঞ্জ থানা এবং উত্তরে রয়েছে আরপিএমপির কোতয়ালী থানা। দক্ষিনে জেলার মিঠাপুর থানা অঞ্চল ও পশ্চিমে রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুস্কুরিনী ইউনিয়ন অবস্থিত।

রংপুর মহানগরের সর্ব দক্ষিনে অবস্থিত তাজহাট থানা অঞ্চলে রয়েছে রংপুর বিভাগীয় সর্ব বৃহত্তম বিদ্যাপিঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। শহরের মর্ডাণ মোড় রোড সংলগ্ন ৭৫ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রকৃতির নিরবতায় বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের মোট ২২ টি বিভাগে প্রায় ১২০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।

পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ। ১৯১৬ সালে রংপুরের তৎকালিন কালেক্টর জে.এন.গুপ্তা এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে তৎকালিন টেপার জমিদার অন্নদা মোহন রায় চৌধুরীর একটি রোমাঞ্চকর গল্প। প্রায় ৩০০ একর ভূমির উপর অবস্থিত কারমাইকেল কলেজের রয়েছে সুবিশাল ক্যাম্পাস।

ছায়া সুনিবিড় কলেজের বিশাল প্রাঙ্গনে রয়েছে একটি ক্যান্টিন, একটি সুদৃশ্য মসজিদ, একটি মন্দির, ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হল, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং বিশাল দুটি খেলার মাঠ। ক্যাম্পাসের দক্ষিণে রংপুর ক্যাডেট কলেজ, উত্তরে ঐতিহ্যবাহী লালবাগ হাট এবং চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছাত্রাবাস।তাছাড়া তাজহাট থানা নগরে রয়েছে মোট চারটি মহা বিদ্যালয়, ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া রংপুর তুলা গবেষনা কেন্দ্র, রংপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও রংপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি তাজহাট থানার সীমানাধীন।

শহরের দক্ষিন সীমান্ত এলাকাগুলো একটি নৈসর্গিক পল্লী গ্রাম। শহরের পাদদেশ থেকে বেরিয়ে আসা সাড়ি সাড়ি বৃক্ষ বেষ্টিত সরু সড়কগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তাজহাটের পল্লী জনপদের বসতি ও হাট-বাজার। তারপরই ফসলে ভরা সবুজ ক্ষেত। শীত মৌসুমে এই ভুমিগুলো আলুর সতেজপাতায় ফুটে থাকে। এই পাতাগুলোই এখানকার কৃষি পেশার মানুষের স্বপ্নবুনে।

শ্যামা সুন্দরী খাল ও ঘাঘট নদী বয়ে গেছে এ অঞ্চলের উপর দিয়ে। বর্তমানে শ্যামা সুন্দরী খালটি তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এটি রংপুর শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একটি কৃত্তিম খাল যা ১৮৯০ সালে রাজা জানকীবল্লভ সেন নির্মাণ করেছিলেন। তৎকালিন সময়ে রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকা কালে শহরে মশার উপদ্রব ঠেকাতে তিনি “শ্যামা সুন্দরী খাল” খনন করেন। খালটি এখন পরিণত হয়েছে একটি ময়লাল ভাগারে। এখন এর সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে শহরের অনতি দূরে বহমান ঘাঘট নদীটিও শীত মৌসুমে প্রাণহীন হয়ে পড়ে। এর সর্পিল গতিধারা চলমান রাখাও সময়ের দাবি।

তাজহাট থানা নগরীর পল্লী জনপদ এর বাসস্থানগুলো খুবই নান্দনিক। সমতল সবুজ ফসলী ভূমির মাঝে একেকটি টিনের ঘরগুলো যেন মনে করিয়ে দেয় বাসস্থান পদ্ধুতির সেই গ্রামীণ চেহারাগুলো। নেই কোন কোলহল, নেই কোন যান্ত্রিক শব্দ। যতদূর চোখ যায় যেন বাধাহীন ছুটে চলার নিশান। এমন পরিবেশে বসবাসকারিগণ নিঃসন্দেহে রংপুরের সুস্বাস্থ্যবান নাগরিক।

বর্তমান সময়ে অর্থনীতির যে রূপরেখা রংপুর মহানগরীতে পরিলক্ষিত হচ্ছে এর একটি বৃহৎ অংশের যোগান চলছে তাজহাটের অর্থনীতির চাকা থেকে। নগর জুড়ে অনেকগুলো কলকারখানা দৃশ্যমান। এসব কারখানাগুলোর যন্ত্রশক্তি যেমনিভাবে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থনীতে অবদান রাখছে, তেমনিভাবে তাজহাটের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। তাজহাটের আলমনগর এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন তথা বিসিআইসি বাফার গুদাম। যা উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে দেশে ইউরিয়া সারের পর্যাপ্ত মজুত সুনিশ্চিত করে থাকে। তাছাড়া তাজহাটের রয়েছে একটি সয়ংক্রীয় ফিড মিল ও বিভিন্ন ধরনের শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠান।

তাজহাট একটি মুসলীম প্রধান অঞ্চল। তাদের জন্য রয়েছে এলাকাজুড়ে ৫৯টি মসজিদ। তবে বেশ সংখ্যাক হিন্দু সম্প্রদায়ও বসবাস করে অঞ্চলে। তাদের জন্য রয়েছে অনেকগুলো মন্দির। তাজহাট থানার বড় রঙ্গপুরে রয়েছে ১৯১৬ সালে নির্মিত একটি কালী মন্দির যা ডিমলা রাজ কালী মন্দির বা ডিমলা রাজ দেবত্তর এষ্টেট নামে পরিচিত। এটি একটি অষ্টকৌণিক হিন্দু মন্দির। মন্দিরটির খিলানে রয়েছ ব্রাক্ষী, মহেশ্বরী, চামুন্ডা, নারসিংহী, নারায়নী, বারাহী, কৌমারী, ও অপরাজিতা রুপে নির্মিত বিভিন্ন দেবীমূতি।শহরের সুলতান নগর কেডিসি রোড সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে খ্রিষ্টানদের একটি অন্যতম ধর্মালয় ক্যাথলিক গির্জা।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।