nagarpur Copy

পূর্বদিকে ধলেশ্বরী ও পশ্চিমে যমুনা। এই দুই নদীর মধ্যভাগের “ব”দ্বীপ বিশেষ অঞ্চলটির নাম নাগরপুর।

বছরজুড়ে এখানে খেলা করে প্রকৃতির নানা লীলা। বর্ষায় থৈ থৈ জল, গ্রীষ্মে ফসলে ভরা মাঠ আর সরু পথের দুই ধারে বাহারী ফলবৃক্ষ এসব নিয়েই নাগরপুরের জনজীবন।

ভোরে মসজিদে আজানের ধ্বনীতে জেগে ওঠা এ জনপদ, কৃষাণ দিনমজুর, কামার-কুমার, তাতী, জেলে, উদ্যোক্তা চাকুরিজীবি সকলের মিশ্রিত বসতভিটা। তাদের দিন শুরু হয় পাখির কিচির-মিচির শব্দে ও প্রকৃতির নির্মল বাতাসের সাথে। এরপর কৃষক যায় মাঠে, দিনমুজুর তার শ্রম বিক্রিতে,  চাকুরিজীবি তার উপর অর্পিত দায়িত্বে আর ব্যবসায়ী বের হয় নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। অন্যরা যখন সবেমাত্র জীবিকার তাগিদে ঘর হতে বের হচ্ছে ঠিক তখনই মাছ শিকারী জেলে দল সারারাত মাছ শিকার করে তা আবার ভোরের বাজারে বিক্রি করে বাসায় ফিরছে। এমনই বৈশিষ্ট মন্ডিত পল্লী জনপদটি নাগরপুর। এটি টাঙ্গাইল জেলার একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। টাঙ্গাইল জেলা সৃষ্টকালে নাগরপুর এলাকায় একটি পুলিশ ফাড়ি ছিলো। কালক্রমে নাগরপুরের ব্যবসা-বানিজ্য ও জনবসতি বাড়তে থাকলে সেই গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯০৬ সালে উক্ত ফাড়িকে পূর্ণাঙ্গ থানায় রুপান্তর করা হয়। বর্তমানে নাগরপুর থানার সীমানা নির্ধারিত রয়েছে মোট ২৬৬.৭৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন জুরে।

ঢাকা থেকে মাত্র ৯০ কি.মি. দুরত্বে অবস্থিত নাগরপুর নদীবাহিত একটি পল্লী জনপদ। এ জনপদটি কৃষির উপর নির্ভরশীল। পাট, গম, সরিষা ও আখ এ অঞ্চলের প্রধান কৃষি ফসল।

তবে বরতমানে এখানকার কৃষকেরা মাটির গুনাগুন অনুপাতে প্রায় সব ধরনের ফসল ফলাতেই উৎসাহি আছে। প্রবীন উদ্দোক্তাদের কেউ কেউ মাল্টা চাষ, কেউ ড্রাগনের বাগান করতে উৎসাহী হচ্ছেন। তাছাড়া, পল্ট্রী খামার ও মৎস চাষে বেশ সফল এখানকার কৃষি উদ্যোক্তাগণ। এই উপজেলার প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানুষের সৌহার্দ্যতা টাঙ্গাইল তথা বাংলাদেশের ভিতরে ও বাহিরে ব্যাক্তিকেন্দ্রীক পরিচিতির অন্যতম মাধ্যম।

যা ঐতিহাসিক কাল থেকেই প্রমাণিত। নাগরপুর এর ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, সুলতান মাহমুদ শাহ-র শাসন আমলে নাগরপুরের মামুদনগর ছিল তাঁর রাজধানী। এক সময় বর্তমান চৌহালীর পূর্বাংশ- নাগরপুর এবং দৌলতপুরের অংশ বিশেষে সহ পুরো এলাকা ছিল নদী এলাকা। কালের বিবর্তনে এই এলাকা চর এলাকায় রূপ নেয়। চর অঞ্চল হলেও জনপদ সৃষ্টির পূর্বে এখানে প্রচুর বনজঙ্গল ছিল। জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপের বিচরণ ছিলো। বিষাক্ত সাপের ভয়ে ভীত থাকত সবাই। এই সময় ভারতের পুরী থেকে “নাগর মিয়া” নামে এক বৃদ্ধ এই এলাকায় আসেন। শোনা যায় তিনি সাপ বা সরীসৃপ নিয়েই জীবন যাপন করতে ভালবাসতেন। এই ভালভাসার সূত্র ধরেই অঞ্চলটি মানুষের বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং ভারতের পুর থেকে আসা নাগরের নামে অঞ্চলটি একসময় নাগরপুর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

 

 

বর্তমানে নাগরপুর থানা অঞ্চল ১২টি ইউনিয়নে বিভক্ত একটি প্রশাসনিক জনপদ। এর আয়তন ২৬৬.৭৭ বর্গকিমি। আর জনসংখ্যা সর্বমোট আড়াই লক্ষাধিক। প্রকৃতিগত ভাবে এ থানা অঞ্চলটি ভীষন সুন্দর।

একসময় এ অঞ্চলটি বিভিন্ন রাজা-মহারাজাদের জমিদারি অংশ ছিলো। তাদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে এ থানা নগরে এখনো দাড়িয়ে আছে দুটি বিশাল অট্টালিকা। তন্মধ্যে একটি নাগরপুর চৌধুরীবাড়ী নামে পরিচিত ও অপরটি পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি নামে স্বীকৃত। প্রায় ৫৪ একর জমির উপর শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত নাগরপুর চৌধুরীবাড়ীটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জমিদার যদুনাথ চৌধুরী। অট্টালিকাটির অভ্যন্তরের কাজটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরের। পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে এক অপূর্ব নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত এই চৌধুরীবাড়ী। যার মুল ভবনটি বর্তমানে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চৌধুরীবাড়ীর দক্ষিণের ১১ একর জমির উপর একটি বিরাট দিঘি রয়েছে, এটি উপেন্দ্র সরোবর নামে পরিচিত।

অন্যদিকে নাগরপুরের পাকুটিয়ায় রয়েছে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রায় ১৫ একর এলাকা জুড়ে একই নকশার পর পর তিনটি প্যালেস বা অট্টালিকা নির্মাণ করেন জমিদার রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল। সেকালে জমিদার বাড়িটি তিন মহলা বা তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এ জমিদার বাড়িটি  বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

নাগরপুর থানা নগরে প্রতিষ্ঠিত মোট কলেজের সংখ্যা পাচটি। রয়েছে প্রায় অর্ধশত মাধ্যমিক বিদ্যালয় মোট দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

তাই শিক্ষার মানে উপজেলাটি যথেষ্ট এগিয়ে বলা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামোগত উন্নয়নে পিছিয়ে নেই নাগরপুর। ব্যাংক, বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি ক্লিনিকসহ রয়েছে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রয়েছে ২৫টি পোষ্ট অফিস।

২৪৪টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত নাগরপুর থানা অঞ্চলটি টাঙ্গাইল জেলার একটি অন্যতম ঐতিহ্যমন্ডিত গ্রাম। এখানকার মানুষ দিন দিন আধুনিকতার ছোয়ায় বদলে গেলেও তাদের অন্তরে এখনো লালিত হয়, হারানো দিনের নানা সংস্কৃতি।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।