images 15
‘এই মুহূর্তে গ্যালারিতে বসে, টিভির সামনে কিংবা দেশে-বিদেশের যে যেখান থেকে যে অবস্থায় অনুষ্ঠানটি দেখছেন, সবাইকে জানাই সাদরে সম্ভাষণ’— ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি’র এই বাক্যটি শোনামাত্রই সকলের মানসপটে ভেসে ওঠে জনপ্রিয় উপস্থাপক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত। যিনি শুদ্ধ সাবলীল বাচনভঙ্গি আর নান্দনিক উপস্থাপনায় সমাজের অসংগতি তুলে ধরার মাধ্যমে বহু আগেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন।
হানিফ সংকেতের জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর বরিশালের শহরে রায়পাশা ইউনিয়নের বসুরহাট গ্রামে। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় কাটে হানিফ সংকেতের শৈশব ও কৈশোর। বিজ্ঞান বিভাগে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সুইডেন বাংলাদেশ পলিটেকনিক থেকে প্রকৌশল বিদ্যায় লেখাপড়া সম্পন্ন করে যোগ দেন বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে (স্পারসো)। পরে সেখান থেকে ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী হিসেবে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিজেকে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে নেন সংস্কৃতিচর্চায়।
সত্তরের দশকে হানিফ সংকেতের পরিচয় হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রখ্যাত উপস্থাপক ও সাংবাদিক ফজলে লোহানীর সঙ্গে। সে সময় বিটিভিতে ফজলে লোহানীর উপস্থাপনায় প্রচারিত হতো ‘যদি কিছু মনে না করেন’। একবার সে অনুষ্ঠানে ফজলে লোহানির সহযোগিতায় নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান হানিফ সংকেত। সে-ই শুরু উপস্থাপনা, তারপর শুধু নিজেকে এগিয়ে নেওয়া আর উপস্থাপনায় মানুষকে মুগ্ধ করে যাওয়ার গল্প!
FB IMG 1656713474723
উপস্থাপনায় করার পাশাপাশি পরিচালনার দিকটাও ওই সময়ে রপ্ত করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে ফজলে লোহানী মারা গেলে বন্ধ হয়ে যায় ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠান। এরপর যদি কিছু মনে না করেন-এর ধারাবাহিকতায় ‘ঝলক’ ও ‘কথার কথা’ নামে দুটি অনুষ্ঠান শুরু করেন হানিফ সংকেত।
তবে সে যাত্রা বেশিদিনের হয়নি, মাত্র চার বছরেই বন্ধ হয়ে যায় এই অনুষ্ঠান দুটিও। পরবর্তীতে আবার ১৯৮৯ সালে নিজ রচনা, উপস্থাপনা ও পরিচালনায় শুরু করেন বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। তখন তিন মাস পর পর ইত্যাদি প্রচার হতো বিটিভিতে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচার বিমুখ, জনকল্যাণে নিয়োজিত মানুষদের কাজকর্ম তুলে ধরার পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে অচেনা-অজানা বিষয়ে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক শিক্ষামূলক প্রতিবেদন প্রচার করা হতো ইত্যাদি’তে। বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন, সামাজিক সচেতনামূলক অনুষ্ঠান আর হানিফ সংকেতের শুদ্ধ সাবলীল বাচনভঙ্গিতে নান্দনিক উপস্থাপনায় অল্প সময়েই দর্শকজনপ্রিয়তা পায় ইত্যাদি। নব্বইয়ের দশকে বিবিসি বাংলার এক জরিপে দেখা যায় সত্তর শতাংশ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ‘ইত্যাদি’ দেখে থাকেন। এখনও প্রতিবছর দুই ঈদে সাফল্যের সঙ্গে প্রচার হচ্ছে ইত্যাদি।
উপস্থাপনার পাশাপাশি বহু নাটক রচনা ও নির্মাণ করেছেন হানিফ সংকেত। তার নির্মিত রচনা ও নাটকগুলোর মধ্যে ‘কুসুম কুসুম ভালোবাসা’, ‘শূন্যস্থান পূর্ণ’, ‘আয় ফিরে তোর প্রাণের বারান্দায়’, ‘দুর্ঘটনা’, ‘তোষামোদে খোশ আমোদে’, ‘ফিরে আসে ফিরে আসা’, অন্যতম। সিনেমায় অভিনয়েও তিনি দেখিয়েছেন পারদর্শিতা। ‘আগমন’, ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ ও ‘ঢাকা ৮৬’ নামে তিনটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। লেখক হিসেবেও রয়েছে তার খ্যাতি। এই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক বই রচনা করেছেন তিনি। পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া তার বইগুলোর মধ্যে ‘শ্রদ্ধেয় রাজধানী’, ‘নিয়মিত অনিয়মিত’, ‘এপিঠ ওপিঠ’, ‘ধন্যবাদ’, ‘প্রতি ও ইতি’, ‘গণ্যমান্য সামান্য’ অন্যতম।
সামাজিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, ২০১০ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক ও ২০১৪ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক অর্জনসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।