tarail

জারী-সারি, ভাটিয়ালী, বাউলাগান ও লোক সাহিত্যে সমৃদ্ধ একটি সু-প্রচীন জনপদের নাম তাড়াইল। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি তাড়াইলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে রয়েছে বাঙ্গালীজাতির হাজার বছরের লোকায়ত ঐতিহ্য এবং অসংখ্য পুরাকৃতির ঐতিহাসিক নিদর্শন।

 

তাড়াইল উপজেলার ভৌগলিক অবস্থান : 

তাড়াইল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। উত্তরে কেন্দুয়া উপজেলা এবং মদন উপজেলা, দক্ষিণে করিমগঞ্জ উপজেলা; পূর্বে ইটনা উপজেলা আর পশ্চিমে নান্দাইল উপজেলা এবং কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা। ১৪১.৪৬ বর্গ কি.মি এলাকার সমন্বয়ে গঠিত তাড়াইল থানা বর্তমানে একটি উপজেলা, এতে ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৭৫টি মৌজা, ১০৪টি গ্রাম আছে।

তাড়াইল উপজেলার শিক্ষা ব্যবস্থা :

৭৭% সাক্ষরতার হারের তারাইল উপজেলায় সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান জাওয়ার উচ্চ বিদ্যলয় (১৯০৩)। যা কিশোরগঞ্জ জেলার ও প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। তাছাড়াও রয়েছে কলেজ ২টি, উচ্চ বিদ্যালয় ৯টি, গার্লস স্কুল ২টা, জুনিয়র হাই স্কুল ৬টি, মাদ্রাসা ৬টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৬টি, কমিউনিটি বিদ্যালয় ২০টি।

তালজাঙ্গা জমিদার বাড়ি :

তালজাঙ্গা জমিদার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলা তাড়াইল উপজেলায়, একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি । বাড়িটি প্রায় ১০০ বছরের পুরনো।জমিদার রাজ চন্দ্র রায় তিনি ছিলেন শিক্ষিত জমিদার, তখনকার সময়ে উচ্চ শিক্ষিত।১৯১৪ সালে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করার পর ৩৩ বছর পর্যন্ত জমিদারি করেন।১৯৪৭সালের পর জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদারি শেষ হয়,রাজ চন্দ্র রায়ের।রাজ চন্দ্র রায়ের ছেলে,নাতিরা,স্ব-পরিবারে কলকাতায় চলে যায়।

দরজাহাঙ্গীরপুর পদ্মবিল :

প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি দরজাহাঙ্গীরপুর পদ্মবিল। যেখানে সাদা-গোলাপী পদ্মফুল দেখতে প্রতিদিনই শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমান। হাজার হাজার পদ্মফুলের ফাঁকে ফাঁকে পদ্ম পাতাগুলো জলের সঙ্গে মিতালী গড়ে তুলেছে। আবার সাথে যোগ হয়েছে জলজ বিভিন্ন প্রজাতির পোকাদের বসবাস। একটু গভীরভাবে দেখলেই চোখে ভেসে উঠবে বিভিন্ন প্রজাতি দেশীয় মাছের ছোটাছুটি। পদ্মফুলের রাজত্বের কারণে সেটি এখন পদ্মবিল নামেই বেশি পরিচিত।

ধলা গিরিশ পালের বাড়ি :

গিরিশ চন্দ্র পাল প্রথম জীবনে একজন সুদখোর মহাজন এবং তাড়াইল বাজারের কেরোসিনের ডিলার ছিলেন। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে মদনের কাটল বাড়ী জমিদারের কাছ থেকে ০৩ (তিন) আনা জমিদারী ক্রয় করেন। বর্তমানে বসত বাড়ীটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে নির্মিত । এই জমিদার বাড়িতে তাঁর তৈরী করা ৫টি ভবন, দুটো সানবাঁধানো পুকুর রয়েছে। বাড়ীটির উদ্ধোধনকালে ৪০ মন মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন বলে স্থানীয় লোকজনের মুখে শুনা যায়। তিনি একজন অত্যাচারী বর্ণবাদী জমিদার ছিলেন। কথিত আছে যে, তার বাড়ীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দু ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হতে দিতেন না এবং জমিদার বাড়ির সম্মুখ দিয়ে সাধারণ প্রজাদের জুতা পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় চলাচল করতে পারতনা। দেশ বিভাগের পর জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে মনের দুঃখে কাউকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে তিনি কলিকাতা চলে যান এবং তার বংশধরগণ সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহন করে নেয়। বর্তমানে তার বসত বাড়ীতে ধলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম চলিতেছে।

সেকান্দর নগর সাহেব বাড়ি জামে মসজিদ :

প্রায় ৪০০ বছর পেরিয়ে গেলেও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেকান্দরনগর সাহেব বাড়ি জামে মসজিদ। এ মসজিদ মোগল আমলের স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। দূর অতীতে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন সৈয়দ শাহ জামান (রহ.) এবং তারই সমসাময়িক হজরত শাহ সেকান্দর (রহ.)। হজরত শাহ সেকান্দর এই স্থানে বসতি স্থাপনের পর এলাকাটি ‘সেকান্দরনগর’ নামে পরিচিতি পায়। স্থানীয়দের ধারণা, তার অবস্থানকে কেন্দ্র করে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তার মাজারও রয়েছে এ মসজিদের পাশে।

তাছাড়াও তাড়াইল উপজেলায় রয়েছে দামিহা চৌধুরীর বাড়ি, শ্রী শ্রী রাধা মদন গোপাল জিউর মন্দির ও শুভানন্দ ব্রহ্মচারী বাবার আসন বাটী মন্দির। জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে পাট ব্যবসা কেন্দ্র রূপে স্থানীয় একটি অশোক বৃক্ষের পাশেসপ্তাহে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হাট বসত। ধীরে ধীরে হাঁটি হাঁটি পা করে ছোট বাজারটি গঞ্জের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাজারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে অনেকেই এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। বিল-ঝিল, হাওর, বাওর আর ফুলেশ্বরী, নরসুন্দা, সূতী, বেতাই ও বর্নী নদী বিধৌত এই উপজেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ১০০ বছর আগে এ অঞ্চলে বসত করতেন গিরিশচন্দ্র পাল চৌধুরী। সেখানেই তাঁর বসত বাড়িটি নির্মাণ করেন। উল্লেখ রয়েছে বাড়িটির উদ্বোধন কালে ৪০ মণ মিষ্টি বিতরণ ততকালীন সমগ্র তারাইল অঞ্চল জুড়ে। তারাইল শব্দের অর্থ তারা সুন্দরীর ভূখন্ড। তালজাঙ্গা জমিদার রাজনারায়ণ চৌধুরীর স্ত্রী তারামন দেবীর নামের সাথে মিল রেখেই তাড়াইল বা সুন্দরীর ভূখন্ড নামে পরিচিতি লাভ করে।

তৎকালীন সময়ে দামিহা বাজারের উত্তর পার্শ্বে নরসুন্দা নদীর উত্তর তীরে একটি পুলিশফাঁড়ি নির্মাণ করা হয় কিন্ত সেখানে জনগণের সার্বিক যাতায়াতের অসুবিধার কারণে বর্তমান থানা ভবন স্থলে আরেকটি পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ করা হয়। এবং ১৯০৯ সালে ঘটনাক্রমে এ পুলিশফাড়িটি তাড়াইল থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও তাড়াইল থানা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ১৯১৮ সালের মধ্যভাগে।

ফলে তাড়াইল বাজার এলাকাটি ধীরে ধীরে ধান, পাট ব্যবসা কেন্দ্রের প্রধান অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠে। এবং বসবাসকারী মানুষও পায় নিরাপত্তার চাদর। সময়ের ব্যবধানে ১৯৮৩সালে তাড়াইল থানা অঞ্চলটি একটি মান উন্নীত থানায় রূপ নিয়ে একটি উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রূপ লাবণ্য ঘেরা ঘনবসতিপূর্ণ এ জনপদে বসবাস করে প্রায় ২৫০০০ পরিবার।

তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রভূত সামাজিক উন্নয়নে বর্তমানে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শ্রেনীর প্রায় ১০০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ২৮টি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্যা এনজিও। উল্লখ্যে, তাড়াইল উপজেলা দেশের অন্যতম কৃষি প্রধান ছোট ভাটী এলাকার উপজেলা হিসেবেও পরিচিত।

প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার হারের এই উপজেলার মানুষ অত্যান্ত সহজ সরল। মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কৃষি কাজে অন্তর্ভূক্ত থাকলেও, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকুরীজিবি ও উদ্যোক্তাও রয়েছে তাড়াইল উপজেলায়। এখানকার মানুষ সারাদিনের মানুষ সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে সন্ধা পরে সবাই মিলে জড়ো হয় গ্রামের ছোট ছোট টং দোকান গুলোতে। আড্ডা, সাথে গরম পুরি কিংবা চায়ের সাথে পার হয় কিছুক্ষণ। এরপর ঘরে ফেরা।

অন্ধকার রাত, বা চাদের আলোতে যখন জনশূন্য রাস্তা, হাটবাজার বা বাড়ির আঙ্গিনা, তখন জোড় নিরাপত্তার দাবি রাখে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত মানুষ। আর তার জন্য প্রস্তুত থাকেন তাড়াইল থানার একদল যোগ্য পুলিশ সদস্যসহ তাদের সঠিক পথ নির্দেশক, অভিভাবক, থানার একজন যোগ্য অফিসার ইনচার্জ।

জনাব মোঃ জয়নাল আবেদীন সরকার, তাড়াইল উপজেলায় বসবাসকারি মানুষের মধ্যে ঘটমান বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করেন, এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি একটি অপরাধ প্রবণতার কারণ। দেশের প্লাবিত অঞ্চল সমূহের মধ্যে তাড়াইল একটি পরিচিত উপজেলা। তাই বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে দেখা যায় সৌখিন মাছ শিকারের মত বিশেষ পেশায়, তাছাড়াও পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া কিছু মৎস খামারীরাও আছে এখানে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।