maxresdefault 3

বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের ইতিহাসের নিশান, পাকিস্তান কর্তৃক বর্বরোচিত শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অসংখ্য নিহত বেসামরিক বাঙালি-অবাঙ্গালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত দেশের একমাত্র জাতীয় স্মারক স্থাপনার পুণ্যভূমি আশুলিয়া থানা অঞ্চল।

গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত সবুজ অরণ্য আর কলকারখানার খটখট শব্দে পোশাক শ্রমিকদের কোলাহলে পূর্ণ রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের জলাভূমি খ্যাত বিস্তীর্ণ প্রাচীন বাংলার জনপদ আশুলিয়া।

 

 

মাত্র দুই দশকে পোশাক শিল্পের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত আশুলিয়া ৫ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে উপজেলাধীন মানুষের প্রশাসনিক সুবিধার্থে সাভার মডেল থানা হতে পৃথক হয়ে শিমুলিয়া, ইয়ারপুর, পাথারিয়া, আশুলিয়া ও ধামসোনাসহ ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে একটি স্বাতন্ত্র্য থানা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। যা ১৪৮.৬৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বেষ্টিত সাভার উপজেলাধীন একটি আধুনিক থানা অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আশুলিয়া নামকরণের ইতিহাস

তুরাগ নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদ কিভাবে পরিচিতি পেলো আশুলিয়া নামে তার রয়েছে নানান মতবাদ। কেউ বলেন এ অঞ্চলে ধামসোনা নামে এক রাজা বসবাস করতেন। তার ছেলে ও মেয়ের নাম ছিল যথাক্রমে আশু ও লিয়া। সেই রাজপুত্র ও রাজ কন্যার নামের যৌথ মিশ্রণই আজকের আশুলিয়া। তবে স্বীকৃত ভিন্নমতটি হলো, একদা আশু ও লিয়ার মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলে তাদের সম্পর্কে বাধা হয়ে দাড়ায় উভয়ের পরিবার। ফলে আশু ও লিয়া এক সংগে স্থানীয় একটি বটগাছের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা থেকেই দিনে দিনে আশুলিয়া নামের পরিচিতি লাভ করে বলে ধারণা পাওয়া যায়।

জলাভূমি থেকে আধুনিক আশুলিয়া

একসময় আশুলিয়া ছিলো কৃষি প্রধান অঞ্চল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্প প্রধান অঞ্চলে রূপ লাভ করে।মাত্র দুই দশকের এই সমৃদ্ধি নিঃসন্দেহে আশুলিয়াকে প্রশংসিত করে। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাজধানীর সন্নিকটে অবস্থান আর ব্যবসায়ীদের নিশ্চিন্তে বিনিয়োগের মাধ্যমে আশুলিয়া অঞ্চল ঢাকা বিভাগের একটি অন্যতম বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে পরিণত হয়।এখানে উৎপাদিত পোশাক সোয়েটার, কম্বল, মাথার ক্যাপ, জার্সি, দুগ্ধজাত পণ্য, ইলেকট্রনিক্স, জুতা ও বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির মানদন্ডে উচ্চ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এই আশুলিয়া থানাধীন গণকবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। ১৯৯৩ সালে এখানে প্রথম একটি ইপিজেট স্থাপন হয় এবং পরে ১৯৯৭ সালে সড়কের বিপরীত পার্শ্বে আরও একটি সম্প্রসারিত অঞ্চল যুক্ত করার মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যে বৃহত্তর পরিসর দখল করে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। ৩৫৬.২২ একর আয়তনের এ ইপিজেডে সর্বমোট শিল্প প্লটের সংখ্যা ৪৫১টি।প্রতিদিন সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই আশুলিয়া থানা অঞ্চলের পথ-ঘাটে ভীর বাড়তে থাকে কলকারখানার শ্রমিকদের। সময়ের সাথে সাথে কারখানাগুলো শ্রমিকদের দ্বারা যন্ত্রশব্দে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, আবারো সকাল অথবা সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত যেন একেকটি কারখানা হয়ে ওঠে শক্ত হাতের শ্রম বাজার। অন্যদিকে অঞ্চলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও একই সময়ে তাদের জীবিকা তালাশে কর্ম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসময় শহরাঞ্চলের সড়কগুলো দখল করে নেয় রিক্সা ও ছোট যানবাহনগুলো। আশুলিয়ার প্রধান সড়কসহ অলি-গলি সবখানে তখন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে যানজটে।

আশুলিয়া থানাধীন জনসংখ্যা

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সাভার  উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১৪,৪২,৮৮৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭,৬৯,১১৭ জন এবং মহিলা ৬,৭৩,৬৬৮ জন। তবে আশুলিয়া থানা অঞ্চলের স্থায়ী বসবাসকারী জনসংখ্যা তুলনামূলক খুবই নগণ্য। পরিসংখ্যান মতে এ সংখ্যা দুই লাখেরও কম। আর অস্থায়ী সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।

কৃষি ও শিল্প বাণিজ্য নির্ভর আশুলিয়া

নানা পেশার মানুষের আবাসভূমি আশুলিয়ার কৃষি এলাকাগুলো ঋতু বর্ষ অনুযায়ী কখনো থইথই পানির উপর ভাসমান অঞ্চল কখনো সাড়ি সাড়ি ইটভাটার সাদা কালো ধোয়ায় পূর্ণ উত্তপ্ত মরুভূমি। তুরাগ নদের উভয় পাশের জমিগুলোতে কৃষাণের হাতের ছোঁয়ায় লাউ, শিম, টমেটো, কপিসহ নানা ধরনের সবজি চাষ হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও লাল, হলুদ, সাদা, কমলা গোলাপসহ দেশি বিদেশি ফুল চাষের জন্যও বিখ্যাত আশুলিয়ার কৃষি অঞ্চল। কৃষি ও শিল্প বাণিজ্য নির্ভর আশুলিয়া ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬১০ বর্গ কি.মি. আয়তনের লাল সবুজ মানচিত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারক হিসেবে বিশ্ব ব্যাপী পরিচিতি ধরে রেখেছে।

ইতিহাস সমৃদ্ধ আশুলিয়া

আশুলিয়া থানা অঞ্চলের আওতাধীন নবীনগর এলাকায় ঢাকা আরিচা মহাসড়কের কোলঘেষে  ৮৪ একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের ১৫০ ফুট উচ্চতা সম্পূর্ণ প্রধান মিনারসহ সাতটি ত্রিভুজাকৃতির মিনারের শিখর আজও মনে করিয়ে দেয় দেশের স্বাধীনতা অর্জনের বীরত্বপূর্ণ সেই লড়াইয়ের কথা।১৯৮২ সালে নির্মিত সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে রয়েছে একাধিক গণকবর, রয়েছে একটি কৃত্রিম  জলাশয়, হেলিপ্যাড, মসজিদ, অভ্যর্থনা কক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া। তাছাড়া আছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সবুজ অরণ্যালয়।  প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে অসংখ্য মানুষ এই স্মৃতি সৌধ দেখতে আসেন এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। প্রতি বছর বিজয় দিবস,স্বাধীনতা দিবস সহ বিশেষ জাতীয় দিবসে এখানে লাখো জনতার ঢল নামে।

মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি নিবেদিত হয় লাখো-কোটি শ্রদ্ধাঞ্জলি।স্বাধীনতার স্বতন্ত্র উন্মেষসহ নানা কারণেই আশুলিয়া থানা অঞ্চলটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র আশুলিয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থার টার্নিং পয়েন্ট

ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানা অঞ্চলাধীন প্রায় ৬৯৭.৫৬ একর এলাকা নিয়ে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুবিধা সম্পূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আশুলিয়া থানায় অবস্থিত। ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে দেশের প্রথম ও একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৭৩ সালে এটির নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম “জাহাঙ্গীরনগর” থেকে এই নামকরণ করা হয়।

অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলোর অবস্থানও আশুলিয়া থানায়।রয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ,ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ,মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ,গণ বিশ্ববিদ্যালয় ।এছাড়াও রয়েছে নানা শ্রেণির বিশেষায়িত নানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে।

চিকিৎসা সেবায় আশুলিয়া

বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প প্রধান অঞ্চল ও ঢাকা জেলার মেগাসিটির অংশ আশুলিয়া থানার প্রায় ২০ লক্ষ জনগণের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি সহ বেশ কিছু মেডিক্যাল কলেজ, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও অসংখ্য ক্লিনিক।

 

মনোমুগ্ধকর বিনোদনের স্থানে পরিপূর্ণ আশুলিয়া

একসময়ের জলাভূমি খ্যাত আশুলিয়ার বর্তমান নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও সবুজ শ্যামলের বাহার যে কাউকেই মনোমুগ্ধ করবে। অঞ্চলটির অন্যতম আকর্ষণ নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম বিনোদনকেন্দ্র  নন্দন পার্ক। প্রায় ১৩৫ বিঘা আয়তনের মনোরম এই পার্কটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রযুক্তি ও ডিজাইন নিয়ে ভারতের নিকো পার্কের সহায়তায় নির্মিত হয়েছে । আবার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ প্রমোদ ভ্রমণের জন্যে জামগড়ায় অবস্থিত ফ্যান্টাসি কিংডম দেশবাসীর খুবই প্রিয় একটি বিনোদন কেন্দ্র। ফ্যান্টাসি কিংডম থিম পার্কটি প্রায় ২০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত, এর প্রধান আকর্ষণ হল ওয়াটার কিংডম। প্রতিদিন শত শত মানুষের আগমনের মধ্যদিয়ে এই পার্কটি একটি আন্তর্জাতিক বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

আশুলিয়া থানার প্রখ্যাত ব্যাক্তিবর্গ

ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও বিনোদন, প্রায় সব দিক থেকেই আশুলিয়া এখন দেশের একটি অন্যতম থানা অঞ্চল। এ মাটি আলোকিত করে জন্ম নিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাবেক সাংসদ মোহাম্মাদ আনোয়ার জং তালুকদার, দেওয়ান মোহাম্মদ ইদ্রিস ও তরুণ ব্যবসায়ী তানভীর আহমেদ রোমান ভূঁইয়াসহ বহু কীর্তিমান পুরুষ।

আশুলিয়া প্রেস ক্লাব

স্থানীয় সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে লক্ষে ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর স্থাপিত হয় আশুলিয়া প্রেস ক্লাব। দৈনিক এশিয়া, সাপ্তাহিক বার্তা, বিচিত্রা, সাফকথা, ঢাকা অর্থনীতি নামে পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে সকল খবরাখবর উঠে আসছে নিয়মিত কাগজের পাতায়। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল।

অফিসার ইনচার্জ আশুলিয়া থানা

অধিক শিল্পকারখানা, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, ঘনবসতিপূর্ণ শহরের জটিল হিসাব-নিকাশ ও কঠিন জীবন বাস্তবতার ভিড়ে এলাকায় অপরাধের সংখ্যাও একই গতিতে বাড়ছে।সন্ত্রাস, জিম্মি, জমি দখলসহ সামাজিক নানা অপরাধ এখানেও মাথা চারা দিয়ে উঠতে চায়। যা রুখতে অঞ্চলের লাখো মানুষের পাহারাদারের ভূমিকায় মানুষের সেবায় ব্রত নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে আশুলিয়া থানার শতাধিক প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যসহ তাদের অভিভাবক থানার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একজন অফিসার ইনচার্জ জনাব এসএম কামরুজ্জামান পিপিএম।

জনাব এসএম কামরুজ্জামান পুলিশে বীরত্ব ও কাজের স্বীকৃতিতে অর্জন করেছেন, পিপিএম পদক। তিনি বলেন আশুলিয়া থানা অঞ্চলে পূর্বের চেয়ে ক্রমশ অপরাধ হ্রাস পাচ্ছে। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের একসাথে চলাফেরা থাকায় অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আশংকা থাকে। তিনি বলেন আশুলিয়া থানা পুলিশের তৎপরতায় অঞ্চলের মধ্যে বিদ্যমান অন্যান্য অপরাধের সাথে সাথে ধর্ষণ ও নারী শিশু নির্যাতন অপরাধগুলো অনেক কমে আসছে। যা আগামীতে থানা পুলিশের কঠোর পদক্ষেপে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন।

অফিসার ইনচার্জ এর এই নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতিতে ইতোমধ্যেই আশুলিয়াবাসী আশ্বস্ত হয়েছেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জানান বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেক আধুনিক। এখন থানার অভ্যন্তরেও অপরাধ সংগঠিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

তিনি আরও জানান সড়ক দুর্ঘটনারোধে সচেতনতার বিকল্প নেই, এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে আশুলিয়া থানা পুলিশ সর্বক্ষণ পাশে থাকবে। কারণ বাংলাদেশ পুলিশ হবে জনবান্ধব পুলিশ, বাংলাদেশ পুলিশ মানবতার পুলিশ।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।