Adamdighi jpg

শত বছরের লড়াই, সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আদমদীঘি থানা বগুড়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। ১৯৮৩ সালে আদমদীঘি উপজেলায় উন্নীত হলেও এটি প্রশাসনিক থানা রুপ লাভ করে আজ থেকে ঠিক ২০২ বছর আগে ১৮২১ সালে। থানার পাশেই প্রায় সাড়ে ৮’শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের জলাধার ‘আদমদীঘি’। মুলত এই আদম দিঘি থেকেই প্রশাসনিক আদমদিঘি নামকরণ হয়েছে। আদমদীঘি বাংলাদেশের বিখ্যাত এলাকাগুলোর একটি। বগুড়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশাসনিক অঞ্চলের খ্যাতি এসেছে নানান কারণে। দেশের প্রাচীন এবং বিখ্যাত রেল স্টেশন ‘সান্তাহার রেলওয়ে জংশন’ এর জন্য সারাদেশে এমনকি দেশের গণ্ডি পেরেয়ি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিত বগুড়ার সর্বপশ্চিমের এই উপজেলা। দেশের রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র থাকায় আদমদীঘির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ তৎপরতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বর্তমানে ১৬৮.৮৪ বর্গ কিলোমিটার প্রশাসনিক এড়িয়ার অধিবাসীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে আদমদীঘি থানার অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি জনাব মো. আনিসুর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার) এর নেতৃত্বে চৌকস ও মানবিক পুলিশ অফিসার হিসেবে খ্যাত বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী’র (বিপিএম) সার্বিক দিকনির্দেশনায় আদমদীঘির নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন আদমদীঘি থানার তরুণ অফিসার ইনচার্জ মো. রেজাউল করিম।

প্রায় আড়াই লাখ অধিবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চেতে আদমদিঘি থানা পুলিশ কতটুকু সফল? কিংবা স্বল্প সংখ্যক সদস্য নিয়ে কীভাবে চলছে থানার সার্বিক কার্যক্রম, অপরাধ প্রবনতাই বা কেমন, সেসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর ও উপজেলার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের সবুজ সংকেত ‘আদমদীঘি’ থানা।

 

 

বগুড়া জেলা শহর থেকে সরাসরি পশ্চিমে প্রায় ৪০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত আদমদীঘি থানার ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে সুদূর মক্কা থেকে আগত বাবা আদম শহীদ রহমতুল্লাহ আলাইহীর দীনি শিক্ষা ও জনসেবামুলক নানান কাজকর্ম। ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এ অঞ্চলে এসে মানুষের খাবার পানির দুর্দশা লাঘবে খনন করেন অংসখ্য পুকুর ও দীঘি। সেকারণেই মানুষের অন্তরে এলাকাটি আদমদিঘী হিসেবে পরিচয় দখল করে। বর্তমানে আদমদিঘী শুধু একটি উপশহর বা গ্রাম নয় বরং এটি একটি থানা ও উপজেলা মানচিত্র।

 

আদমদিঘীর শাসন-শোসনের ইতিহাসে রয়েছে এক ভিন্ন ঘটনা। জানা যায়, ১৭৮৬ সালে ব্রিটিশ জমিদারদের সাথে ফকির মজনু শাহ’র লড়াই হয়েছিলো আদমদীঘির সীমানাযুক্ত তৎকালীন ভোমরা বিলে। ফকির মজনু শাহের শীর্ষ সহযোগী সেই লড়াইয়ে শাহাদাৎ লাভ করেন। রক্তাক্ত হয় বিল ভোমরার পানি। সেই থেকে এই বিলের নাম হয়ে যায় রক্তদহ। ঐতিহাসিক সেই রক্তদহ বিলটি বৃহৎ অংশই আদমদীঘির সান্তার ইউনিয়নের সীমানাধীন।

আবার কাল অতিক্রমের ২০০ বছর পর ১৯৭১রেও রক্তাক্ত হয়েছিলো আদমদিঘীর মাটি। যুদ্ধ শুরুর ২ মাস আগেই বিহারিরা সান্তাহার রেলওয়ে অফিসার জিয়াউদ্দিনের বাসায় বোমা হামলা করে। এরপর থেকে সংঘাত ও সংঘর্ষ নিয়মিত হতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিহারিদের ইন্ধন দিয়ে বিরোধ আরো উস্কে দেয়। বিহারিদের দাপটের কারণেই আদমদীঘি উপজেলাকে শত্রুমুক্ত করতে বেগ পোহাতে হয়েছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অবশেষে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পশ্চিমারা সান্তাহার ছেড়ে পালিয়ে গেলে ৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর আদমদীঘি হানাদারমুক্ত হয়। সেই স্মৃতিকে ধারণ করে পূর্ব সান্তাহার শহীদ সুজিত গেট, রেলগেট সংলগ্ন স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের নামে শহরের বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। 

ইতিহাস পথ পরিক্রমণের সেই আদমদিঘী বর্তমানে বগুড়া-৩ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভূক্ত একটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উদ্বৃত্ত এলাকা। কৃষি প্রধান দেশের এ ভূখন্ডে ধান, গম, ষরিষাসহ আলু ও অন্যান্য দেশি সবজির সারাবছর উৎপাদন হয়। তবে, আদমদীঘির অর্থনীতির প্রধান উৎস মৎস্য ব্যবসা। অঞ্চলটি রেনু পোনা বিক্রয়ের জন্য নামকরা। এখানকার প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষই মাছের ব্যবসায়ের সাথে সংযুক্ত। বাকি ২৫ ভাগ মানুষ কৃষি কাজ, চাকরি, আর বিভিন্ন পেশায় জড়িত।

আধুনিতা ও নগরায়নের ছোঁয়ায় বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও ভারি শিল্পকাজেও নিয়োজিত আছেন। পরিসংখ্যান মতে খুবই অল্প সময়ে ৮ শ’র অধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে পুরো উপজেলা জুড়ে। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী মাদুর ও মৃৎ শিল্পও এখানকার অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। উল্লেখ্য যে উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের শাঁওইল বাজার এলাকাটি তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

 

উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আদমদীঘি। শিক্ষা দীক্ষায়ও জোর কদমে এগিয়ে চলছে বর্তমান প্রজন্ম। স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ ছোট্ট এ উপজেলায় রয়েছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থানীয়দের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ এখানে রয়েছে ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং একটি ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। ছাতিয়ানগ্রাম, নুসরতপুর, কালাইকুড়ি, আদমদীঘি, কুন্দগ্রাম, চাপাপুর ও সান্তাহার ইউনিয়নের মানুষদের লেনদেনের চাহিদা মেটানোর জন্য রয়েছে আদমদিঘীর ১৪টি প্রসিদ্ধ হাট-বাজার। আদমদিঘীর একমাত্র পৌরসভা হলো সান্তাহার পৌরসভা। যা সৃষ্টির পর থেকে খ শ্রেণিভুক্ত থাকলেও দেশের উন্নয়নের রেশ ধরে এগিয়ে চলা সান্তাহার পৌরসভা ২০১৭ সালে ক শ্রেণিতে উন্নীত হয়। বর্তমানে এটি উপজেলার প্রধান শহর এলাকা।

তবে, উপজেলা কার্যালয়, থানা ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ সেবাদপ্তরগুলো উপজেলার সদর ইউনিয়নের সীমানাধীন। সরকারি পরিসংখ্যান মতে উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১,৮৭,০১২ জন হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা দুই লক্ষ্য ছাড়িয়েছে। ৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর প্রশাসনিক সীমানা হিসেবে সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল উপজেলার সদর ইউনিয়ন। মোট ৭টি উপপ্রশাসনিক কাঠামোতে বিভক্ত আদমদিঘী উপজেলা মোট ১১২টি মৌজা ও প্রায় পৌনে দুইশ গ্রাম নিয়ে গঠিত। এই প্রশাসনিক অঞ্চললের কোনো কোনো এলাকা এক সময় নিরাপত্তা শংকা প্রবল থাকলেও বর্তমানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো প্রশাসনিক অঞ্চলে। দেশের বৃহত্তম রেল ইয়ার্ড হওয়ায় সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত এখানে নিত্যদিনের চিত্র। অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন এই রেলজংশন হয়ে সম্প্রতি পুনরায় চালু হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ রেলসংযোগ। আন্তদেশীয় গুরুত্বপূর্ণ এই রেলওয়ে জংশনের কারণে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে এখানে।

আদমদিঘী থানা অঞ্চলের সান্তাহার বাইপাস থেকে চালু রয়েছে ৪ কি.মি. বগুড়া-নওগা মহাসড়ক। তাছাড়াও আদমদিঘী উপজেলার বিভিন্ন এলাকার উপর দিয়ে চলে গেছে আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন রুট। এসব সড়ক-মহাসড়কে নানা কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। যা নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।