Shajahanpur Thana

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশেলে গড়া সবুজ প্রকৃতির মেলাবন্ধনে দৃষ্টিজুড়ানো বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা। শহরের বুকচিড়ে বয়ে চলা ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক এ উপজেলার যোগাযোগে এনেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এ উপজেলাটি বগুড়া জেলা সদর থেকে দক্ষিণে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একটি জনপদ। উপজেলা মানচিত্রের মোট আয়তন ২২১.৮ বর্গকিলোমিটার। এখানকার স্থায়ী বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।

অঞ্চলের জননিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ নজর রাখছেন বাংলাদেশ ‍পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি জনাব মো. আনিসুর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার) এর নেতৃত্বাধীন বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর তত্বাবধাণে শাজাহানপুর থানার প্রশিক্ষিত বিশাল ইউনিট। যার সরাসরি নেতৃত্বদান করছেন শাজাহানপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শহিদুল ইসলাম।

 

 

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় পৌনে দুইশো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার জনবসতির প্রাচীনত্ব সাড়ে ৪০০ বছরেরও বেশি। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ষোড়শ শতাব্দিতে করতোয়া নদীপথে জলদস্যুরা মাঝিদের বেশ ধরে লোকালয়ে প্রবেশ করে দস্যুতা করতো। তখন এলাকাবাসী তৎকালীন সুবেদার সম্রাট শাহজাহানের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়। সম্রাট শাহজাহান তাৎক্ষণিক একটি সেনাদল পাঠায় যারা বর্তমান ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের পূর্ব পার্শ্বে মাটি দিয়ে করে সেনা ছাউনি স্থাপন করে অবস্থান শুরু করে। ফলে সম্রাট শাহজাহানের বদান্যতায় এই জনপদ জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পায়। ঐতিহাসিক সেই অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই জনপদের নামকরণ করা হয় শাজাপুর। ব্রিটিশ আমল থেকে ভূমি নামজারির সকল রেকর্ডে মৌজাটি এখনো শাজাপুর মৌজা নামেই বহাল আছে। কালক্রমে যা শাজাহানপুর নামে রূপলাভ করে। তবে প্রশাসনিক শাজাহানপুরের যাত্রা হয়েছিলো ২০০২ সালে “মাঝিড়া” নামে বগুড়ার নতুন উপজেলা মানচিত্র গঠনের মধ্য দিয়ে। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের চেষ্টায় সেই মাঝিড়া নামটি পরিবর্তন করে নামকরণ হয় শাজাহানপুর। যা বর্তমানে বগুড়া জেলার একটি উপজেলা ও থানা মানচিত্র নামে স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত।

ঐতিহাসিক পটভূমির পাশাপাশি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেরও দগদগে স্মৃতি রয়েছে শাজাহানপুরের মাটিতে। এখানকার বাবুর পুকুর গণকবর বা বাবুর পুকুর বধ্যভূমিটি এখনো চোখের কোণা ভিজিয়ে দেয় বর্তমান প্রবীণ ব্যক্তিদের। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এখানে রচনা করে এক নির্মম ইতিহাস। বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো করে নিয়ে যাওয়া হয় শাজাহানপুরের খরনা ইউনিয়নের বাবুর পুকুরের এক নির্জন এলাকায়। তারপর একে একে ১৪ জন বীর মুক্তিসেনানীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি রক্তচোষা হানাদাররা। নিথর দেহগুলোকে বায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেতে ওঠে নির্মম এক অমানবিক খেলায়। বাবুর পুকুরের বধ্যভূমিতে বীর সেনাদের কবর এবং স্মৃতিস্তম্ভ শ্রদ্ধার নিদর্শন হয়ে আজও প্রেরণা যোগায় গৌরবের।

বর্তমান শাজাহানপুর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির একটি জনপদ। মাটির পরশে মিশে জীবিকা অন্বেষন করে এখানকার ৫৫.৪৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী। কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ধান, আলু, ভূট্টা, ডাল ও শষাকসবজি। বিশেষ করে উপজেলার পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক শাকসবজি উৎপাদিত হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সেসব শাকসবজি চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মধ্যে তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, সূচিশিল্প, বাঁশ ও বেতের কাজ এবং বেশ কয়েকটি ভারি শিল্প-কলকারখানা বিশেষ অবদান রাখছে শাজাহনপুরের অর্থনীতিতে।

গোহাইল, খাদাশ, জামাদারপুর, টেংগামাগুড়, উমরদিঘী, কামাড়পাড়া, শাহনগর, রাণীরহাটসহ অংসখ্য প্রাচীন হাট-বাজার এখনো এখানকার অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে মানুষের বাণিজ্য চাহিদা পূরণ কর চলছে ।

 

শিক্ষা-দীক্ষায়ও পিছিয়ে নেই প্রাচীন ঐতিহ্যের শাজাহানপুর প্রশাসনিক অঞ্চল। এ অঞ্চলে রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৬ শতাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যা এখানকার জনগোষ্ঠীর শিক্ষা এবং ধর্মীয় আচার পালনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পূর্বেই উল্লেখিত যে, এ জনপদটি বগুড়া জেলার অতি নিকটতম একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এ উপজেলার মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গেছে ১৪ কি.মি. ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক। এবং এর পশ্চিম সীমানা দিয়ে চলে গেছে বগুড়া-নাটোর ১৬ কি.মি. মহাসড়ক।

দেশের সকল জেলার সাথে সহজ যোগাযোগ থাকায় থাকায় বর্তমানে শাজাহানপুর বেশ পরিচিতি দখল করেছে এখানকার পর্যটন শিল্পকে ঘিরে। তার মধ্যে শাজাপুর গড়, খরনার জমিদার বাড়ি, খাদাশ রাজবাড়ি, মাদলা জমিদার বাড়ি, পণ্ডিত শাহ নির্মিত ঐতিহাসিক গোহাইল জামে মসজিদ, বৌদ্ধ মঠ, মৃৎশিল্পে গ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর বিজয়াঙ্গন গুলো পরিদর্শন করতে প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। স্থানীয়দের জানান, এইসব পুরাকৃর্তি নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারিভাবে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ, নয়তো অচিরেই ঐতিহ্যগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।