Dhunat Thana

ধুনট বগুড়া জেলার একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল যার প্রারম্ভিক যাত্রা হয়েছিলো ১৯৬২ সালে থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের প্রেক্ষিতে ধুনট থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করা হয়। বর্তমানের ধুনট ২১২টি গ্রামের সমন্বয়ে ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় বিভক্ত। এর মোট আয়তন ২৪৭.৭৫ বর্গ কি.মি.। ধুনটের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক চার লাখ অতিক্রম করেছে। যা ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে ৩ লক্ষেরও কম ছিলো। অর্থাৎ বর্তমান ধুনট জনপদটি নিসন্দেহে একটি ঘন জনবহুল এলাকা এবং জেলা শহরের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনেক বেশি।
বৃহৎ এই জনগোষ্ঠির প্রশাসনিক নিরাপত্তার জন্য ধুনট থানায় কর্মরত রয়েছে একজন অফিসার ইনচার্জের নেতৃত্বে অফিসারসহ ৫৬জন পুলিশ সদস্য। যারা নিষ্ঠা ও সততার সাথে জনসেবার প্রতিশ্রুতিতে দিবারাত্রি কাজ করে চলেছেন।

বর্তমানে রাজশাহী রেঞ্জ এর ডিআইজি মোঃ আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার সুদ্বীপ কুমার চক্রবর্তী ধুনট থানা এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগি বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কঠোরতা বাড়ছে থানা পুলিশের আইন প্রয়োগে। যার নেতৃত্ব দানে রয়েছেন থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রবিউল ইসলাম। তিনি কতটুকু সফল ধুনট থানার একজন অফিসার ইনচার্জ হিসেবে? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তরসহ ধুনট উপজেলায় বিদ্যমান সকল খুটিনাটি বিষয়ের স্পষ্ট ভিডিওচিত্র নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আজকের সবুজ সংকেত “ধুনট”।

 

 

নদী যখন তার উত্তাল ঢেউয়ের মাধ্যমে ধংসযজ্ঞ শুরু করে মানুষের বসত ফিটায়, আবাদি জমি, ক্ষেত-খামারে! তখন সে নদীর পরিচয় ঘটে সেই নগরের মানুষের কাছে সর্বগ্রাসা নদী নামে।
বগুড়া জেলার অন্তর্গত জেলা শহর হতে দক্ষিণ পূর্বে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে ধুনট উপজেলার মানুষের কাছে যমুনা নদীর পরিচিতি তেমনি সর্বগ্রাসা নদী নামে। এ অঞ্চলের বসতি স্থাপনকাল থেকে এখন অবধি কত মানুষ যে তাদের সহায় সম্বল হাড়িয়ে নিঃস্ব হয়েছে তার হিসাব কখনোই করা হয়নি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে, জুন-জুলাই মাসে যমুনার পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে এ অঞ্চলের মানুষের হৃদপিন্ডের গতিও বৃদ্ধি পায়। এই বুঝি তলিয়ে যাবে, তাদের স্বপ্ন! এই বুঝি আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে তাদের পূর্ণ পরিবার! এমনি আতংকের মধ্যেই দিনতিপাত হয় ধুনট উপজেলার নদী প্রান্তে বসবাসকৃত মানুষগুলোর। তাদের এই দুঃখ দুর্ধষার অবসান ঘটাতে ২০০৩ সালে যমুনার ভাঙন রোধে ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের আটাচর গ্রাম থেকে কাজিপুর উপজেলার ঢেকুরিয়া পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও দুটি স্পার নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বর্তমানে সেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও স্পার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা খুবই নাজুক। তাই বন্যা মানেই ধুনটের মাটি ও জীব জগতের ভোগান্তির অধ্যয়।

নদীর পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ধুনটের ফসলি মাটিগুলো জেগে ওঠে সম্পূর্ণ সুস্বাস্থ্যে। তখন উপজেলার কৃষি জনপদে ভিশন ব্যস্তার রেশ শুরু হয়। বন্যার পানিতে পলি জমে থাকা মাটিতে চাষ আরম্ভ হয়, তিল, মশুর, খেসারী, মরিচ, পেয়াজ, চীনা বাদাম, ভূট্রা, সরিয়া, ধান এবং নানা রকম সবজি। পলি সম্মৃদ্ধ উর্বর এই ফসলি জমিগুলো তখন ধুনটের কৃষাণী পরিবারের কাছে হয়ে ওঠে স্বপ্নবীজ। যমুনার গায়ে ভেসে ওঠা ভান্ডারবাড়ি চর যেন তখন পরিণত হয় সোনার ফসলের মাঠ। মাঠের পর মাঠ যতদুর চোখ যায়, দেখা সবুজ ভুট্টার ক্ষেত।

যমুনা ছাড়াও ধুনট সীমানার উপর দিয়ে বয়ে গেছে বাঙালী নদী। এই নদী দয়ে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। যার ফলে এখানকার জনসংখ্যার একটা মোটা অংশ মাছ শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া একশ্রেণির মানুষ কুচিয়া চাষে অনুপ্রাণিত হয়ে বাণিজ্যিক উপায়ে কুচিয়া চাষ করছে। এবং কেউ কেউ স্থানীয় ডোবা, খাল-বিল থেকে কুচিয়া ধরে বাজারে বিক্রিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এক সময় বাঙ্গালী ও যমুনা নদী ছিল ধুনট উপজেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম, কিন্তু তা সংকোচিত হয়ে সড়ক পথের উপর প্রভাবিত হয়েছে। ধুনট উপজেলার নিমগাছী ইউনিয়নে বাঙালী নদীর উপর নির্মিত হয়েছে ব্রীজ। যা অঞ্চলের সাধারন মানুষের যাতায়াত ও মালামাল আমদানি রপ্তানিতে অনেক সহজ করে তুলেছে। ব্রীজটি হওয়ার কারণে নিমগাছী ইউনিয়ন হয়ে ধুনট উপজেলা হতে বগুড়া জেলা সদরে যাতায়াতের সহজতা তৈরি হয়েছে। ইতোপূর্বে গুরত্বর অসুস্থ্য ব্যক্তিকে জেলা সদরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব ছিলনা বর্তমানে যা সহজ হয়েচৈ। আইনশৃঙ্খলার কোন অবনতি দেখা দিলেও তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাস্থানে পৌছাতে পারছেন এই ব্রীজ নির্মাণের ফলে। তাছাড়া এলাকার অনেক বেকার যুবক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কারণে বিভিন্ন পেষায় নিয়োজিত হয়েছেন এবং এলাকায় বিপনী বিতান ও ভাল ভাল মার্কেট গড়ে উঠেছে। উল্লেখ্য যে ধুনট উপজেলার বেকার নারী ও গৃহবধুদের তৈরি টুপিশিল্প এখন আন্তর্জাতিক বাজার দখল করেছে।

ধনট নদী এলাকা হওয়ায় নদীভাঙন আর বন্যার কারণে প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা বেড়ে চলছিলো। এমনসময় ধুনট উপজেলার বেশকিছু বাসিন্দা নতুন পেশার সন্ধান করতে থাকে। প্রায় চার দশক আগে বগুড়ার ধুনট উপজেলার নিমগাছী গ্রামে কয়েকজন গৃহবধু কুরুশকাঁটা দিয়ে টুপি তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে এই টুপিগুলো বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে গেল শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয়। এতে গৃহবধূরা বাড়তি আয়ের জন্য টুপি তৈরি শিখে তার উৎপাদন বাড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে ধুনট উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে তা পাশের শেরপুর উপজেলার গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। গৃহবধুদের পাশাপাশি তাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও কিশোরী মেয়েরাও টুপি তৈরিতে মনোযোগী হন। যা বর্তমানে বিভিন্ন উপায়ে দেশ-বিদেশের বাজারে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের টুপি রফতানি করছে। ধুনট উপজেলার কালের পাড়া, নিমগাছি, চিকাশী, গোসাইবাড়ী, ভান্ডারবাড়ী, এলাঙ্গী, মথুরাপুর, গোপালনগর, ও ধুনট ইউনিয়নের দেড়শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক নারী-পুরুষ এ পেশায় জড়িত। টুপির কর্মজজ্ঞকে ঘিরে কুটির শিল্পের আদলে নানামুখী কারখানাও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কেউ টুপি রপ্তানির প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলেছেন। কেউবা টুপির উপযোগী সুতা তৈরি কারখানা স্থাপন করেন। অনেকেই টুপি ধোলাইয়ের জন্য কারখানা গড়ে তুলেছেন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ধুনটের এই টুপি শিল্পই এ উপজেলার অর্থনৈতিক হাতিয়ার। যার পরিশ্রমী হাতগুলো নারীদের।
অন্যদিকে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন ধুনট উপজেলার পাকুড়িহাট গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার। এটা তাদের বাপদাদার পেশা। পাকুড়িহাটার মতো, নলডাঙ্গা, আনন্দগঞ্জ, কান্দুনিয়া, দাঁড়াকাটা, রুদ্রবাড়িয়া, সোনাহাটা, বেলকুচি ও বাঁশহাটাসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের জীবিকার একমাত্র পথ বাঁশের সামগ্রী তৈরি করা। বাঁশ দিয়ে শুধু চাটাই নয়, এখানে আরও তৈরি হয় খলপা, তালাই, ডোল, খালইসহ আরও অনেক কিছু।

সর্বপরি বলা যায় ধুনট নদী ভাঙ্গন উপজেলা হলেও অর্থনৈতিক দিকে বেশ স্বাবলম্বি। এটি বগুড়া ৪ আসনের অন্তর্ভূক্ত একটি প্রশাসনিক জনপদ। এ জনপদের মানুষ খুবই পরিশ্রমি। কর্মক্ষম জনশক্তির মধ্যে রয়েছে যেমনি কাজের প্রতি ভালোবাসা তেমনি নতুন প্রজন্ম তথা তাদের সন্তানদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষারপ্রতি বিশেষ অনুরাগ। ধুনট উপজেলা সদরের ধুনট সরকারি এন ইউ পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় অত্র এলাকার শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয় যা ১৯৪১ সালে স্থাপিত। এছাড়া ধুনট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও গোসাইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের বেশ সুনাম রয়েছে উপজেলা জুড়ে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ধুনট সরকারি কলেজ যা স্থাপিত হয় ১৯৭২ সালে। এছাড়া ধুনটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ! জালশুকা হাবিবুর রহমান কলেজ। এবং ইসলামি শিক্ষার জন্য আছে জোড়খালী ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা। ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি ধুনট উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।