Bogura Sadar Thana

বগুড়া দেশের একটি প্রাচীন ভূখন্ডের নাম। এ ভূ-খন্ডটি সেন, গুপ্ত, পাল প্রভৃতি রাজাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন বগড়া ১২৭৯ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। পরে তিনি বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বগড়া খান হিসেবেও পরিচিত ছিলো। তার নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয় বগরা। পরে শব্দের শ্রুতি মধুরতা আনতে বগরা থেকে শব্দটি বগুড়া শব্দে রুপান্তর হয়।

বগুড়া নামে “জেলা শহর” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই “বগুড়া নামে” থানা সৃষ্টি হয়েছিলো। সময়টি ছিলো ১৭৯২ সাল। পরে ১৮২১ সালে বগুড়া জেলার জন্ম হয়। তার পূর্বে বগুড়া থানা রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সময়ের প্রেক্ষাপটে সেই প্রাচীন “বগুড়া থানাকে” ভেঙ্গে আরও অনেক থানার সৃষ্টি হয়। এর ফলে বগুড়া থানাটি সদর থানা নামে রূপান্তর হয়। ১৯৭১ সালে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে আশির দশকে এসে দেশে আবারো শুরু হয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস। সেই সুবাদে বগুড়া সদর থানাকে বগুড়া সদর উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

সবুজ সংকেতের আজকের পর্বে থাকবে “বগুড়া সদর উপজেলার” প্রশাসনিক কার্যক্রম, মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও হালচালসহ, কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য মন্ডিত নানা নিদর্শন।
আজকের পর্বে থাকছে বগুড়া সদর থানার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সামাজিক পরিবেশ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নানা চিত্রায়নসহ অঞ্চলের অপরাধ ও অপরাধ নিধনে রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশে অধিকর্তা ডিআইজি মোঃ আনিসুর রহমান, বিপিএম(বার), পিপিএম(বার) এর সার্বিক নির্দেশনায় বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার জনাব সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বিপিএম এর তত্ত্বাবধানে বগুড়া সদর থানা পুলিশের সার্বিক কারযক্রম। এই পর্বের আইন-শৃংখলা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাইহান ওলিউল্লাহ।

 

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে প্রবেশদার এবং ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ বগুড়া সদর উপজেলা। যা প্রাচীন পুন্ড রাজ্যের রাজধানী হিসেবে দেশব্যাপি পরিচিত। রাজধানী ঢাকা থেকে এ জনপদের দুরুত্ব প্রায় ১৯০ কি.মি.। এর আয়তন মাত্র ১৭৭.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু লোকসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ। সে হিসেবে বগুড়া সদরকে উত্তরবঙ্গের অধিক ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ হিসেবেও ধরা হয়। বগুড়া সদর এর উত্তরে শিবগঞ্জ, দক্ষিণে শাজাহানপুর, পূর্বে গাবতলী এবং পশ্চিমে কাহালু উপজেলা। চারটি প্রশাসনিক সীমানার মধ্যভাগে অবস্থিত এই জনপদটি উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। এ উপজেলার উপর দিয়ে চলে গেছে একটি প্রশস্ত মহাসড়ক। যা উত্তরবঙ্গের সবগুলো জেলাকে সংযুক্ত করেছে।

বগুড়া সদর উপজেলার সবচেয়ে ব্যস্ততম স্থান বগুড়া সাতমাথা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি সড়কের মিলিতস্থান হচ্ছে এই সাতমাথা। এখানেই নির্মিত হয়েছে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর ছবি সমন্বিত বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাংলার বীর সন্তানদের ছবি দেখে স্বরণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগের কথা।

১৯৭১ সালে যখন সারাদেশ রণক্ষেত্র তখন এ বগুড়ার দামাল ছেলেরা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে ঝাপিয়ে পড়েছিলো শত্রু বাহিনীর উপর। জানা যায়, সদরের বিবিরপুকুর নামক স্থানে শত্ররা ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এবং শহীদনগরে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে করতোয়া নদীর পাশে মাটিতে পুঁতে রাখে।
কি নির্মম ছিলো সেই স্মৃতি। যা মনে পরে যায় এই সাত মাথার বীরশ্রেষ্ঠ স্কয়ার দেখলে। এ স্থানটিকে এ জেলার প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। প্রতিদিন সদরসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ সাতমাথা এলাকায় আসেন। ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তারা জেলা শহরে আসা-যাওয়া করেন। সাতমাথা গোল চত্তরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়িক নানা প্রতিষ্ঠান। এখানেই রয়েছে বগুড়া জিলা স্কুল, শহীদ খোকন পার্ক, জিপিও, সার্কিট হাউজ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সাতমাথা থেকে কবি নজরুল ইসলাম সড়ক তথা থানা রোড দিয়ে এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে, বগুড়ার ব্যিখাত দই এর দোকানগুলো। বগুড়ার দই বাংলাদেশের বিখ্যাত দুগ্ধজাত খাদ্য। বর্তমানে দেশের সকল অঞ্চলে দই পাওয়া গেলেও স্বাদে ও গুণে বগুড়ার দই অতুলনীয়। এর খ্যাতি মূলত ব্রিটিশ আমল থেকেই সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। ষাটের দশকের প্রথম ভাগে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে শুরু করে মার্কিন মুল্লুকেও গিয়েছে বগুড়ার দই। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাদের সহানুভূতি পেতে এই দই পাঠিয়েছিলেন। এতকাল পরে এসেও এর জৌলুশ এতটুকো কমেনি। বরং বগুরার দই চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই।

বগুড়া সদর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র নদীটির নাম করতোয়া। এটি বগুড়ার দক্ষিণ দিকে থেকে প্রবাহিত হয়ে বাঙালি নদীর সাথে মিশে ফুলঝুর নদী নামে হুরাসাগরে গিয়ে পড়েছে।
বর্ষাকালে করতোয়া নদীর দু’কুল ঝাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পানি। তখন থৈ থৈ পানিতে ভাসে উপজেলার পল্লী এলাকাগুলো। এ সময় কৃষিখাতে ব্যপক ক্ষতি দেখা দেয়।

পরিসংখ্যান মতে সদর উপজেলার মোট জমির পরিমাণ ১৭,৭৩৪ হেক্টর। তম্মধ্যে আবাদি জমি রয়েছে ১১.৭০০ হেক্টর। ধান, আলু, মরিচ, সরিষা, ভুট্টা ও গম এ অঞ্চলের প্রধান রপ্তানিযোগ্য কৃষি ফসল। তাছাড়া বিভিন্ন মৌসুমী শাক সবজি চাষ হয় এ অঞ্চলে। এসব পণ্য বাজারজাত করণের জন্য সদর উপজেলাতে গড়ে উঠে প্রায় ২৫টি হাট-বাজার।

তবে বগুড়া সদর উপজেলাকে বর্তমানে শিল্প নির্ভর একটি নগরী হিসেবে ধরা হয়। ১৯৬৪ ও ১৯৮০ সালে দুই দফায় উপজেলার ফুলবাড়ী মৌজায় মোট ৩৩.১৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিসিক শিল্প নগরী স্থাপন করা হয়েছিলো। বর্তমানে এখানে মোট ৯৩টি শিল্প কারখানা স্থাপন করে প্রায় ৬০০০ জন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র ফাউন্ড্রি শিল্প। পাশাপাশি বর্জ্য তুলা, ঝুট কাপড়, সাবান, বেডসীট মশারি কাপড়, জুট মিলস, পেপার মিলস, ফিড মিলস, সিমেন্ট কারখানা, পোল্ট্রিশিল্প সহ অসংখ্যা এগ্রো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বগুড়া সদর উপজেলায়। রয়েছে মোট ৫টি জুট মিল, ৭৬টি ব্যাংক শাখা, ৮৫০০ মে: টন ধারণক্ষমতা ০২টি খাদ্য গুদাম, ১১টি কোল্ড ষ্টোরেজ, ১টি একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ও ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৫০টির অধিক উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। তাছাড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী, শহীদ চাঁন্দু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ষ্টেডিয়াম, এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ নারী সংগঠন তথা পরবর্তীতে এনজিও হিসাবে পরিচিত ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ ( টিএমএসএস) এর সদর দপ্তর এ উপজেলাতেই অবস্থিত।

উল্লেখ্য সদর উপজেলাধীন রংপুর রোড নংলগ্ন নওদাপাড়ায় প্রকৃতির অপার সৌন্দোর্যের ছোয়ায় গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের একমাত্র পাচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল মমো ইন হোটেল এন্ড রিসোর্ট।
১৪৯টি রুম বিশিষ্ট উত্তরবঙ্গের একমাত্র পাচ তারকা মানের এ হোটেলে রয়েছে ২টি হ্যালিপ্যাড, ২টি বিলাশবহুল সুইমিংপুল এবং বয়েজ এন্ড গাল্স আলাদা আলাদা ২টি ফিটন্যাস সেন্টার। রয়েছে উন্নত পরিসেবার রেস্টুরেন্ড, ক্লাব লাউঞ্জ, বার, কফি বার, কন্ফারেন্স রুম, বারবিকিউ জোন ও বিশাল পরিসরের ফ্রি পার্কিং জোন।

২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিসিএল গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে মমো ইন হোটেল এন্ড রিসোর্ট যাত্রা শুরু করে। ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক কাজে বগুড়া অবস্থানকারীদের একমাত্র আস্থা এখন মমো ইন হোটেল এন্ড রিসোর্ট। উন্নত পরিসেবা, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বিলাসবহুল পাচ তারকা এ হোটেলটি শুধু বগুড়া সদরই নয় বরং সমগ্র উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।
মমো ইন হোটেল এন্ড রিসোর্ট।

সর্বপরি; বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত, বগুড়া জেলার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপজেলাটি হলো “বগুড়া সদর”। বগুড়া সদর উপজেলা মোট ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। পৌরসভাটি বগুড়া নামে প্রতিষ্ঠিত। ১৮৭৬ সালে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নগরী ও বাণিজ্যকেন্দ্র বগুড়া শহরের পরিচালনার জন্য বগুড়া পৌরসভা গঠন করা হয়েছিলো। তখন এর আয়তন ছিলো ২.০১ বর্গ কি.মি। পরে ১৯৮১ সালের ১লা আগস্ট এটিকে ক শ্রেণীতে উন্নীত করে আয়তন বাড়িয়ে ১৪.৭৬ বর্গ কি.মি. করা হয়। এরপর ২০০৬ সালে আবারো বাড়িয়ে ৬৯.৫৬ বর্গ কি.মি. আয়তনে ঘোষনা করা হয়। বর্তমানে শুধু পৌর আয়তনে বসবাস করে প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ। আর ১১টি ইউনিয়নে বসবাসকৃত জনসংখ্যা দুই লক্ষাধিক। ইউনিয়ন এলাকাগুলো হলো এরুলিয়া, ফাঁপোর, সাবগ্রাম, নিশিন্দারা , রাজাপুর, শাখারিয়া, শেখেরকোলা, গোকুল, নুনগোলা, লাহিড়ীপাড়া ও নামুজা।

উপজেলা সর্ব উত্তরের গোকুল ইউনিয়নের মেধ নামক স্থানটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এখানে রয়েছে বাংলার লোকগাথায় চির আম্লান বেহুলা-লক্ষিনদরের বাসর ঘর।
রয়েছে চাঁদমুহা হরিপুর-সাহার বিল এলাকায় চাঁদ সওদাগরের বসতবাড়ি, নামুজা ইউনিয়নের চিংগাসপুরে পদ্মাদেবীর বাড়ি এবং লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়নের রায়-মাঝিড়ায় কালু গাজীর কোর্ট।
উপজেলার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় সার্কিট হাউজ সংলগ্ন রয়েছে নবাববাড়ি। যা বর্তমানে প্যালেস মিউজিয়াম ও কারুপল্লী নামে বহুল পরিচিত। পাশেই রয়েছে বগুড়ার উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি যা ১৮৫৪ সালে স্থাপিত হয়েছিলো।

এছাড়াও রয়েছে শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য কয়েকটি বিশেষ স্থান। এ উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন তদানিন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ আলী চৌধূরী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক রোমেনা আফাজ, এম.আর আকতার মুকুল, বি.এম ইলিয়াস, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ও কণ্ঠশিল্পি আঞ্জুমান আরা সহ বহু গুনি ব্যাক্তিত্ব। বগুড়া সদর উপজেলার মোট গ্রামের সংখ্যা ৩৪১টি এবং মৌজার সখ্যা ৩১০টি।
প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত গ্রামগুলোর মধ্যভাগ দিয়ে চলে গেছে পিছ ঢালাই মহাসড়ক। বর্তমানে এ মহাসড়কটির উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এ কাজ সম্পূর্ণ শেষ হলে বগুড়া শহর দেশের সম্মৃধ্ধিতে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।