Dupchanchia Thana

গায়ের মেঠোপথ আর আঁকাবাকা আইল ধরে ধানক্ষেত, বাজারের আধাপাকা সড়ক, পল্লিবাংলার অতিপরিচিত দৃশ্য নিয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমি এক প্রশাসনিক এলাকা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া থানা। এটি বগুড়া জেলার উত্তর-পশ্চিমের বৈচিত্রপূর্ণ একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুঁপচাচিয়া থানা। এরপর ১৯৮৩ সালের ১২ ডিসেম্বর উপজেলায় উন্নীত হয় দুপচাঁচিয়া। দুপচাঁচিয়াই বগুড়ার একমাত্র উপজেলা যেখানে দুটি পৌরসভা রয়েছে।

 

 

দুপচাঁচিয়া, নামটি অপরিচিত জনের নিকট প্রথমে একটু কঠিন মনে হলেও কয়েকবার চর্চা করলে সহজ হয়ে পড়ে। দুপচাঁচিয়াকে আদিকালে ধুপচাচিয়া লেখা হতো। কেন, কবে, কিভাবে এ নামটি বৃহত্তর আকার ধারণ করে একটি গ্রাম থেকে আজ উপজেলা মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে তার সঠিক অনুমান করা সম্ভব নয়। ধারণা করা হয় ধুপ থেকে প্রথমে ধুপচাচিয়া পরে উচ্চারণ সহজ করতে দুপচাঁচিয়া নামকরণ করা হয়েছে। অন্য একটি গ্রহণযোগ্য জনশ্রুতি হলো একসময় ‘ধূপছায়া’ নামক ঐতিহ্যবাহী তাতের শাড়ীর ব্যাপক প্রচলন ও উৎপাদন হতো এই অঞ্চলে। সেই থেকে পুরো এলাকার নাম হয় ধূপছাঁচিয়া। কালক্রমে যা দুপচাঁচিয়া নামে রূপান্তর হয়। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে  শের  খাঁর  আমলে প্রথম ভূমি জরিপ ও মৌজা নামকরণে আনুষ্ঠানিকভাবে দুপচাঁচিয়া নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ১৬২.৪৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ভোটার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। আর জনসংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লক্ষাধিক।

 

অর্থনীতি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও যুগের সাথে তালমিলিয়ে অপরাধের ধরন ও কাঠামো পরিবর্তন-পরিবর্ধন হচ্ছে নিয়মিত। অপরাধী চক্রের নিত্য-নতুন কৌশল ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিরলস কাজ করছেন দুপচাঁচিয়া থানায় কর্মরত একদল প্রশিক্ষিত পুলিশ অফিসার ও সদস্য। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি জনাব মো. আনিসুর রহমানের (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার) তত্বাবধানে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তীর নেতৃত্বে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দুপচাঁচিয়া থানার প্রধান অভিভাবক অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল কালাম আজাদ।

 

দইয়ের রাজ্য খ্যাত বগুড়া জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদরের অবস্থান। দুপচাঁচিয়া প্রশাসনিক সীমান্তের উত্তরে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল, পশ্চিমে আক্কেলপুর, দক্ষিণ-পশ্চিমে আদমদীঘি এবং পূর্বে শিবগঞ্জ ও দক্ষিণ-পূর্বে ও কাহালু উপজেলার অবস্থান। ১১৫টি মৌজা খতিয়ানে দুটি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত দুপচাঁচিয়া উপজেলা বগুড়া-৩ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভূক্ত।

 

উপজেলার পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহাসকি নাগর নদী। এছাড়া প্রাকৃতিক কোন ঝলধারা নেই এ উপজেলা সীমানাধীন। সম্পূর্ণ সমতল ভূমি বিশিষ্ট হওয়ায় দুপচাঁচিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি রয়েছে রেল যোগাযোগও। শিক্ষা-স্বাক্ষরতায়ও অনেকটা এগিয়ে দুপচাঁচিয়া উপজেলা। স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৭২ শতাংশ। সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৮৪টি। এছাড়া বেসরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাধারণ কলেজ, কারিগরি কলেজ ও মাদরাসা মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে আরো প্রায় ৮০টির কাছাকাছি।

এটি একটি কৃষি প্রধান জনপদ। মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ ভাগেরও বেশি মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রচুর শাকসবজি ও মসলা জাতীয় পণ্যও উৎপাদন হয় দুপচাঁচিয়ায়। রয়েছে উত্তরবঙ্গের প্রথম এলুমুনিয়াম ফ্যাক্টরি, তাতশিল্প ও চার হাজারেরও অধিক পুকুর বা জলাশয়। এসব পুকুর-জলাশয়ে মাছ চাষ ও রেণু উৎপাদন হয় ব্যাপক আকারে। যা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে দুপচাঁচিয়ার অর্থনীতিতে। এ উপজেলার বাৎসরিক খাদ্য চাহিদা মাত্র ৩৭,৯৯০ মেট্রিক টন এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ১,৩২,০০০ মেট্রিক টনেরও বেশি।

মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ২৪,০৫৪ হেক্টর। এরমধ্যে তিন ফসলি জমিই রয়েছে ১৪,৭৭৬ হেক্টরেরও বেশি। এখানে উৎপাদিত ধান, গম, আলু, সরিষা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলা-উপজেলায় রপ্তানি হয়। এই বিস্তৃর্ণ কৃষি ভূমিকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫ শতাধিক চাতাল ও চালকল গড়ে উঠেছে পুরো উপজেলা জুড়ে।

দুপচাচিয়ার তালোড়ায় অবস্থিত খান অটো রাইস মিল, উপজেলার অন্যতম কৃষি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বগুড়া জেলার প্রধান কৃষি ফসল ধানের সবচেয়ে বড় ক্রেতা খান অটো রাইস মিল।

এছাড়াও রয়েছে গৌরব অটো রাইস মিল ও বসাক অটো রাইস মিল নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান। দেশের সকল আইনগত বিধি নিষেধ মেনে কৃষক থেকে ধান সংগ্রহ, পরিস্কার, বাছাই, সিদ্ধ করা, শুকানো এবং চাল হওয়া পর্যন্ত সমস্ত কাজ  করে পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থায় সারাদেশে চাল রপ্তাণির মাধ্যমে দুপচাচিয়ার অর্থনীতিতে অসামন্য অবদান রাখছে।

এছাড়া ঊষা ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি দুপচাচিয়ার অন্যতম বেকারী প্রতিষ্ঠান। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধুতিতে প্রতিদিন প্রায় ১২ ঘন্টা উৎপাদন কাজ চলমান থাকে ঊষা ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে। এ প্রতিষ্ঠানটি বেকারী পন্য উৎপাদনের পাশাপাশি স্থানীয় প্রায় ২ হাজার নারী পুরুষের কর্ম নিশ্চিত করছে।

অন্যদিকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে দুপচাচিয়ার একমাত্র সুপার শপ “সুরুজ আলী সুপার শপ”। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সকল পন্যের সমাহারে সাজানো এ শপটি স্থানীয়দের নিকট একটি অন্যতম কেনাকাটার মার্কেট।

উল্লেখ্য যে, দুপচাচিয়ার মানুষের জন্য বিশেষ অবদান রাখছে SUBARASHII NIHONGO GAKUIN নামের প্রতিষ্ঠানটি। এটি জাপানিজ ভাষা সংক্রান্ত একটি স্কুল প্রতিষ্ঠান।

 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযদ্ধকালে দুপচাঁচিয়া অধীবাসীদের অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বগুড়া দখলের পরেরদিন ৭১- এর ২৩ এপ্রিল দুপচাঁচিয়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এক ঔষধ বিক্রেতাকে তার দোকানেই জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে করে হানাদাররা। আগের সন্ধা থেকেই দখল নিতে শুরু করে পুরো থানা সদর। চৌধুরীপাড়ার চৌধুরী বাড়িতে চালায় নির্মম গণহত্যা। হত্যাকাণ্ডের আনুমানিক দু’দিন পর একসঙ্গে প্রায় ২০ জনকে সমাধিস্থ করা হয় চৌধুরীবাড়ির শ্যাম সরোবরে। বিজয় অর্জনের শেষলগ্ন পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পদ্মপুকুর ও চৌধুরীপাড়া বধ্যভূমি আজো সেই বেদনাবিধুর স্মৃতি স্মরণে স্থানীয়দের চোখের কোণে জল নামিয়ে আনে।

 

শত বছরের পুরোনো জনপদ হিসেবে এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক নানান স্থাপনা ও দর্শনীয় স্মৃতিচিহ্ন। চামরুল ইউনিয়নের প্রাচীন গ্রাম হিসেবে বেড়ুঞ্জ এলাকায় রয়েছে অনেক পুরাতন পুকুর, অট্টালিকা, মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, আরব সাধক সৈয়দ হোসেন আলীর স্মৃতিচিহ্ন, শাহ সুলতান বলখী রহ. এর স্মুতি বিজড়িত ধাপসুলতানগঞ্জ, উপমহাদেশের বিখ্যাত পুরাধা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত গান্ধী ভিটা ও প্রাচীন গোবিন্দপুর মন্দির। এছাড়াও অবিভক্ত বাংলার এক্সাইজ কমিশনার মরহুম খান বাহাদুর মোতাহার হোসেন খান নির্মিত নান্দনিক সৌন্দর্যের ‘সাহেব বাড়ী’ পরিণত হয়েছে উপজেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনায়।

দুপচাচিয়া উপজেলার প্রকৃতি ও বাসস্থান অনুযায়ী জনপদটিকে ২ ভাগে বিভক্ত করা যায়।

একটি হলো নৈসর্গিক পল্লী নগর, যার পরতে পরতে গড়ে উঠেছে সবুজ অরণ্যের ছায়ায় ঘেরা গুচ্ছ বসতি আর বিস্তৃর্ণ মাঠ আরেকটি হলো বাণিজ্যিক ও বিভিন্ন সেবাদপ্তর প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা শহর এলাকা। মূলত দুপচাচিয়ায় দুটি শহর রয়েছে। এর একটি উপজেলা সদর তথা দুপচাচিয়া পৌরসভা ও আরেকটি তালোড়া পৌরসভা। দু’দুটি পৌরসভাই স্ব-স্ব কারণে বিশেষত্বের স্থান নিয়েছে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।