Gabtoli Model Thana

দেশের উত্তরবঙ্গের সুনামধন্য ও ঐতিহাসিক জনপদ বগুড়া জেলার সদর, শিবগঞ্জ, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি, ধুনট ও শাহজাহানপুর উপজেলা সীমানার মধ্যভাগে উত্তর দক্ষিণে লম্বালম্বি ভাগে বিভক্ত প্রায় ৩০ কি.মি. দৈর্ঘের একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল গাবতলী। এটি ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি থানা সীমানা। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৮৩ সালে রুপান্তরিত উপজেলা মানচিত্র। প্রায় ১১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত গাবতলী থানা এখন গাবতলী মডেল থানায় রুপান্তরিত হয়েছে। তবে ঐতিহাসিককালে গাবতলি নামকরণে রয়েছে গাবগাছকে ঘিরে এক অন্য রকম ইতিহাস। সেই প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বর্তমান গাবতলী উপজেলার সমসাময়িক বিষয় নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের সবুজ সংকেত। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির তত্বাবধানে বগুড়া জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশে কেমন চলছে গাবতলী মডেল থানার প্রশাসনিক কার্যক্রম? অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কতটুক সফল গাবতলি মডেল থানা পুলিশ? এ সম্পর্কেও থাকবে নানান বিশ্লেষণ। গাবতলি মডেল থানার অভিভাবক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত আছেন অফিসার ইনচার্জ সনাতন চন্দ্র সরকার।

 

 

বগুড়া জেলার অন্যান্য থানা অঞ্চলের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বিভিন্নস্থানে সঠিক ভাবে লিপিবদ্ধ হলেও গাবতলীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কেউ কখনো তেমন তুলে ধরেনি বা এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক চর্চায় তেমন করে কেই মনোযোগ দেয়নি। যতটুকু জানা যায়, এ অঞ্চলটির পূর্বনাম ছিলো গোবিন্দনগর। এটি শ্রীমান শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ রায় বাহাদুর এর জমিদারি অঞ্চল ছিল। তদানিন্তন পোলাদর্শী পরগনার অন্তর্গত দিনাজপুরের ফুলবাড়ি এস্টেটের অধীন ছিলো এই গোবিন্দনগর। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের চৌধুরী বাড়ির দুই সন্তান; কালে চৌধুরী ও ফতেহ চৌধুরী ব্যবসার উদ্দেশ্যে সওদাগরি করতে দুধকোমর নদীর পাশে “বর্তমান সর্দার পুকুর নামক স্থানে” নৌকা ভিড়ায়। তখন এই অঞ্চলে তেমন কোন জনবসতি ছিল না। তাই তারা রাত্রিযাপনের জন্য কোন জায়গা বা আবাসস্থল না পেয়ে দুধকোমর নদীর উপকূলে একটি গাবগাছের নিচে শীতলপাটি বিছিয়ে রাত্রি যাপন করেন। ঘটনাক্রমে সেই তরুণ দুই যুবক স্থানীয় দুটি মেয়েকে বিয়ে করে এই গাবগাছের কাছে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রা কালে ও ফতেহ চৌধুরীর নিকট শিক্ষা এবং বিচারের জন্য আসা যাওয়া শুরু করেন। আগতদেরকে সেই গাবগাছের তলায় পাতা, মাচার উপর বসতে দেওয়া হতো।

এছাড়া মাঠে কাজ করার সময় ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজনও এই গাবগাছের তলায় বসে ক্লান্তি দূর করত। পরবর্তিতে রেল লাইন করার জন্য রেল কোম্পানির লোকজন এসে এই গাবতলাতেই তাবু গাড়ে। স্থানীয় লোকজনের দাবির মুখে এই স্থানটিকে গাবতলী নামে নথিভুক্ত করা হয়। সেই থেকে গোবিন্দনগর হয়ে ওঠে আজকের গাবতলী।

বর্তমানে বিবিধ কারণে সেই গাবগাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে চলেছে। গাবগাছের অভ্যান্তরেই একটি পাকুড় গাছ জন্ম নিয়েছে। যা গাবগাছকে অনেকটা অক্টোপাসের মতো গিলে ফেলেছে। এ জনপদের মাটি থেকে হয়তো ঐতিহাসিক এই গাবগাছটি একদিন বিলিন হয়ে যাবে চিরতরে, তবে; গাবতলী নামটি রয়ে যাবে চিরকাল, যতদিন এই ভূখন্ডটি থাকবে পৃথিবীর মানচিত্রে। গাবতলী নামটি আজ ২৩৯.৬১ বর্গকিমি আয়তনের একটি জনপদ। এ জনপদটিকে মোট ১৩টি উপপ্রশাসনিক কাঠামোতে ভাগ করা হয়েছে। এর ইউনিয়ন ১২টি ও একটি পৌরসভা।

পৌরসভাটি ২০০২ সালে গাবতলী ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গাবতলী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই নামে ইউনিয়নটিও বহাল রয়েছে। অন্যান্য ইউনিয়নগুলো যথাক্রমে নেপালতলী, সোনারায়, কাগইল, রামেশ্বরপুর, মহিষাবান, দক্ষিণপাড়া, দূর্গাহাটা, বালিয়াদিঘী, নাড়ুয়ামালা, সুখানপুকুর এবং নশিপুর ইউনিয়ন নামে স্বগৌরবে সীমানা দখল করেছে ৩০ কি.মিটার দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১০ কি.মিটার প্রশস্তা সম্পন্য গাবতলী উ্পজেলার মানচিত্রে। এর মোট গ্রাম সংখ্যা ২১১টি যা ১০৪টি মৌজায় বিভক্ত রয়েছে। বগুড়া জেলা শহর থেকে গাবতলীর দুরত্ব মাত্র ১০ কি.মি.। গাবতলী উপজেলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে মোট ৬৭, ৬৮৫টি পরিবার। তাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ।

বৃহত এই জনগোষ্টির ৯৭ ভাগই মুসলীম এবং ধনি-দরিত্র সব শ্রেণির মানুষের আবাসস্থল। গাবতলি উপজেলা ব্যবসা-বানিজ্যে একটি সমৃদ্ধ উপজেলা। এখানকার হাট-বাজারগুলো উপজেলার সফল ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত আছে। তন্মাধ্যে দাঁড়াইল বাজার, পাঁচমাইল, পেরী, গোলাবাড়ী, শাক-সবজি তরকারী ও কাঁচামালের বড় একটি পাইকারী বাজার হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও নাড়ুয়ামালা ও সুখানপুকুর কলেজ, তরনীর হাট, পেরীহাট এবং মহিষাবানে গরু ছাগলের বিরাট হাট বসে। মুলত এ জনপদের মানুষ কৃষি ভিত্তিক ব্যবসার উপর প্রতিষ্ঠিত। কৃষি ভিত্তিক বিবিধ খামার, ক্ষেত, ছাড়া কোন বৃহত্তম বাণিজ্যিক কল-কারখানা গাবতলীতে নেই। সরকারি পরিসংখ্যান মতে গাবতলীর মোট জনসংখ্যার ৭৬৮৮১ জন মানুষ সরাসরি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত আছেন। এর বাইরে একটি বড় অংশ দিনমজুর ভিত্তিক কৃষক। যারা অর্থের বিনিময়ে নিজের শ্রম বিক্রি করে মাঠে ফসল ফলায়।

আরেকটি অংশ বিবিধ পশু খামারে শ্রমের সাথে জড়িত। এরমধ্যে গরু-মহিষের দুগ্ধ খামারের সংখ্যাই বেশি। দুগ্ধ খামার ও মাংসাসী অন্যান্য গবাদি পশুর খামার মিলিয়ে আনুমানিক সংখ্যা ৪৫০ টির বেশি। এছাড়াও প্রায় তিন শতাধিক হাসমুরগির খামার রয়েছে গাবতলী উপজেলায়।

সর্বপরি গাবতলী উপজেলা অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি স্বনির্ভর উপজেলা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন জনসেবা ও সমাজসেবামুলক সরকারি দপ্তরসহ বেসরকারি বহু সংখ্যাক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্তমান গাবতলী উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে উপজেলার যোগাযোগ খাতে। উপজেলার এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে যোগাযোগের জন্য নির্মিত হয়েছে একাধিক পাকা সড়ক। তবে কিছু কিছু এলাকার সড়কগুলো সংস্কারের অভাবে একটু ঝুকিপূর্ণ হয়ে আছে।

উপজেলার উপর দিয়ে চলে গেছে ১০ কি.মি. রেল পথ। রয়েছে গাবতলী ও সুখানপুকুর নামে দুটি রেল স্টেশন। পূর্বকালে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো উপজেলার প্রধান ৩টি নদীকে ঘিরে। সেকালে নদীগুলোর ছিলো ভরা যৌবন। বর্তমানে নদীগুলো বিবিধ কারণে সংকোচিত হয়ে পড়েছে। উপজেলার পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে বাঙ্গালি নদী, উত্তর দিক হয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে ইছামতি ও মধ্যভাগ দিয়ে বিভিন্ন এলাকার স্পর্শ করে বয়ে গেছে গজারিয়া। নদী গুলোর সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ২৯ কিলোমিটার। যা প্রচীনকালের যোগাযোগের অবিছ্চেদ্দ অংশ ছিলো।

উল্লেখ্য যে, গাবতলী উপজেলায় প্রাচীন নিদর্শন সমুহের কোন বিশেষ স্থাপনা বর্তমানে না থাকলেও এ উপজেলার প্রকৃতির স্বাদ নিতে অনেকেই আসেন গাবতলীর মাটিতে। আবার প্রতিবছরের বঙ্গাব্দ মাঘ মাসের শেষ তিন দিনের মধ্যে আগত বুধবার অথবা ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার উপজেলার গোলাবাড়ি বাজারের কাছাকাছি মহিষাবান গ্রামের পোড়াদহ নামক স্থানে একটি ঐতিহাসিক মেলা বসে। যার ঐতিহ্য ৪শত বছরেরও বেশি। এ মেলায় নানা প্রজাতির বিশালাকার মাছের কেনা বেচা হয়। যা জেলার অন্যতম এবং একমাত্র মৎস উসব। ঐতিহ্যবাহী এ মেলা হয়ে ওঠে সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও মতের মানুষের এক মহামিলন কেন্দ্র। অর্থনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর এ মেলায় কোটি টাকার বেশী লেনদেন হয় এবং লেনদেনের একটা বড় অংশ উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত গামী হয়। ফলে গাবতলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের সকল শ্রেনি পেশার মানুষের মুখে।

এই সুপ্রশংসিত গাবতলী উপজেলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও কখনো কখনো দেখা দেয় নানা অসংগতি, যা নিয়ন্ত্রণ ও জনজীবনের সার্বিক আইন শৃংখলা পরিস্থিতি সুষ্ঠ রাখতে কাজ করছে, গাবতলী মডেল থানা পুলিশের অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। গাবতলী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ উপজেলা সম্পর্কে আরও নানান বিষয় তুলে ধরেন পজিটিভ থিংক এর ক্যামেরায়।

শিক্ষার দিকেও উন্নয়নের হাওয়া বইছে গত এক যুগ ধরে। গাবতলী উপজেলায় ১টি সরকারি কলেজসহ মোট ১০ কলেজ রয়েছে। রয়েছে প্রায় অর্ধশত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১৭০ এর অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়।

 

 

 

 

 

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।