Sobuj Sonket Shibganj jpg

এককালের বাংলার রাজধানী ও দেশের অন্যতম প্রাচীন পুরাকৃর্তির নগর বগুড়ার শিবগঞ্জ। যা ইতিহাসে পুণ্ড্রুবর্ধন বা পুণ্ড্রুনগর নামে পরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এটি আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের একটি প্রাচীন জনপদ। ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ প্রাচীন এই জনপদটি শিক্ষা, সভ্যতা ও আধুনিকতায় আজও উন্নত। এ জনপদের প্রাচীন ও বর্তমান সংস্কৃতি, জীবনাচার ও এখনকার অর্থনীতি, অপরাধ, নিরাপত্তার সাথে যোগসূত্র মিলিয়ে দেখতে আজ আমরা ‍ছুটে যাবো বগুড়ার শিবগঞ্জে। এটি একটি উপজেলা মানচিত্র যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ। তবে শিবগঞ্জ থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো আজ থেকে ১০৫ বছর আগে। বর্তমানে উপজেলার ৩১৫.৩৩ বর্গকিলোমিটারের অধিবাসীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে শিবগঞ্জ থানার অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য। রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি জনাব মো. আনিসুর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার) এর নেতৃত্বে চৌকস ও মানবিক পুলিশ অফিসার হিসেবে খ্যাত বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী’র (বিপিএম) সার্বিক দিকনির্দেশনায় শিবগঞ্জের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুর রউফ।

 

উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় নাম বগুড়া জেলার প্রধান শহর হতে ১৯ কিমিঃ উত্তরে গাংনই ও করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল শিবগঞ্জ। এ শিবগঞ্জ শুধু বগুড়া জেলার জন্য অতীতের মর্যাদাই বহন করে না! বরং সারা বাংলাদেশে যে কয়টি বিশেষ স্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম স্থানের কৃতিত্ব অর্জন করেছে। এ উপজেলাতেই রয়েছে ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়। এছাড়া প্রাচীন সম্রাজ্যগুলোর কেন্দ্র হিসেবে মৌর্য, পাল, সেন ও মোঘল আমলের নানা স্থাপনা এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো এখানকার মাটি খুড়লেই বেরিয়ে আসে হাজার হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন, ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রাচীন সভ্যতার বহু স্মৃতি। বহু সম্রাজ্য ও শাসকের উত্থান-পতন, শোষণ-তোষণ, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে নানা ঘাত পেরিয়ে ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্য হয়েছে এই শিবগঞ্জ অঞ্চল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ যোদ্ধা প্রফুল্ল চাকী এই শিবগঞ্জের বিহার গ্রামেই জন্মেছিলেন। এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রের পরিচালক, লেখক ও সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেনও এই শিবগঞ্জের সন্তান। অর্থাৎ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই অঞ্চলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ৭১’-এর ৪ এপ্রিল শিবগঞ্জের ময়দানহাট্টা ইউনিয়নের এক পরিবারের ১৬ সদস্যকে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সেই নির্মমতাকে স্মৃতিতে রেখে এখনো কাদে এ মাটির স্বাধীনতাকামি শতাধিক গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা।

 

করতোয়া ও গাংনাই নদীর সংযোগ তীরে গড়ে ওঠা শিবগঞ্জে একসময় পুরোটাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধিপত্য ছিলো। তারা ছিলো শিবপুজারী। তাই এলাকায় প্রচুর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে তৎকালিন পাড়াগুলোতে পৃথক পৃথক একেকটি গঞ্জ গড়ে উঠে। পরবর্তীতে অঞ্চলটি শিব ও গঞ্জ শব্দের মিলনে শিবগঞ্জ নামে রূপ পায়।

 শিবগঞ্জের উত্তরে গাইবান্ধার গোবীন্দগঞ্জ ও পশ্চিমে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল ও কালাই উপজেলা। এছাড়া দক্ষিণ ও পুর্ব দিকে সীমানা বিস্তার করেছে বগুড়ার সদর, কাহালু, দুপচাঁচিয়া, সোনাতলা ও গাবতলী। অর্থাৎ ৮টি পৃথক প্রশাসনিক সীমানা ঘিরে অবস্থিত বর্তমান শিবগঞ্জ উপজেলা বা শিবগঞ্জ থানা সীমানা।

এটি বগুড়া-০১ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত একটি জনপদ। মোট ১২টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা, ১৪২ মৌজা ও ২১২টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত শিবগঞ্জ প্রশাসনিক অঞ্চল ইতোপূর্বে বহুবিধ অপরাধের কুখ্যাতি কুড়ালেও এখন এটি একটি আদর্শ জনপদ।

শিবগঞ্জ মূলত কৃষি নির্ভর একটি জনপদ। এখানে প্রচুর ধান ও আলু চাষ হয়। অন্যান্য ফসলের মধ্য রয়েছে ভুট্টা, গম, কলা, পাট ইত্যাদিসহ নানান দেশী-বিদেশি শাক সবজি। এছাড়া এখানে প্রচুর মাছ চাষ হয়। রয়েছে ৭ শতাধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। নেই কোন বৃহৎ শিল্প কারখানা। উপজেলার ৫লক্ষাধিক মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে উপজেলার প্রধান বাজার ছাড়াও রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৩৫টি হাট-বাজার।

বাজার ও বসতি এলাকা ব্যতিত এখানকার অন্যান্য সীমানার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য খুবই সুশোভিত এবং ঐতিহাসিক। প্রকৃতির প্রধান উৎস উপজেলা অসংখ্যা হাওর-বাওর নদী। করতোয়া ও গাংনাই নদী ছাড়াও নাগর ও বাঙ্গালী নদী নামে আরো দুটি নদী বয়ে গেছে শিবগঞ্জের ওপর দিয়ে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি নদীর উপশাখা রয়েছে শিবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। এই নদী ও উপশাখাগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে বগুড়ার প্রাচীন ঐতিহ্যের মহাস্থানগড়। এই মহাস্থানগড়ের জন্য প্রতিদিন শতশত পর্যটকের আনা-গোনা ঘটে শিবগঞ্জে।

শিবগঞ্জ উপজেলায় মহাস্থানগড় ছাড়াও রয়েছে আরও অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রয়েছে বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, খোদারপাথর ভিটা, কালীদহ সাগর, ভীমের জঙ্গল, গোকুল বেহুলার বাসর, মাহী সাওয়ার রহ. এর মাজার, হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এর মাজার, মানকালীর দ্বীপে ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ধংসাবশেষ মসজিদের অবশিষ্টাংশ ও দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্র। যা শিবগঞ্জ তথা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিশেষ অবদান।

ঐতিহাসিক শিবগঞ্জ থানা শিক্ষা-দীক্ষায়ও এগিয়ে চলেছে অন্যান্য অঞ্চলের সাথে পাল্লা দিয়ে। রয়েছে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানসহ প্রায় আড়াই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।