Sobuj Sonket Sherpur Thana

শেরপুর, এটি এমন একটি নাম যা  অতীত চিত্রের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ও এক মহাকালজয়ী ঐতিহাসিক প্রাচীন অধ্যায়। ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এ নামটি কেবল বগুড়া জেলার অত্র স্থানেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এ নামটির মাহাত্ন্য ও ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় কাশ্মির, আফগানিস্তান, ভারতের বীরভূম ও বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলাতে। যে মহান ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শেরপুর নামটি উদ্ভব হয়েছিল, ধারণা করা হয় তিনি হলেন আফগান বালক ফরিদখান। এ বালক বীর পরবর্তীকালে নরখাদক এক হিংস্র বাঘ হত্যা করে শেরখান নামে অভিহিত হন। তারই নামানুসারে যে কয়টি উল্লেখযোগ্য স্থানকে ঐতিহাসিক ভাষায় পরিচিহ্নিত করেন তার মধ্যে বগুড়া জেলার শেরপুর অন্যতম। শেরপুর প্রশাসনিক নামটি গত শতকের শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত হলেও শেরপুর নামটি আজ হতে প্রায় চারশ বছর পূর্বে ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করেছে। আর প্রশাসনিক শেরপুর থানা গঠন হয়েছে ১৯৬২ সালে। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৮৩ সালে শেরপুর থানা উপজেলা মানচিত্রে যাত্রা শুরু করে।

 

 

দেশের উত্তর ভু-খন্ডের “সুনামখ্যাত জেলা বগুড়ার” অন্যতম প্রশাসনিক অঞ্চল শেরপুর বগুড়া শহর থেকে ২২ কি.মি দক্ষিণে তথা সিরাজগঞ্জ জেলার হাটিকুমরুল গোলচত্তর থেকে ৩২ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জনপদ। প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের বসবাসরত এ মানচিত্রটি ২২৪টি মৌজা ও ৩২০টি গ্রামে বিভক্ত মোট ১০টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। আয়তন মোট ২৯৬.২৭ বর্গ কি.মি.। বিশালায়তনের শেরপুরের শহর এলাকা গড়ে উঠেছে ঢাকা বগুড়া মহাসড়কের কোল ঘেষে। সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সেবা দপ্তরসমুহসহ দোকানপাট বা বৃহত্তর বাজারগুলো এই মহাসড়ককে কেন্দ্র করেই। মহাসড়কে চলাচলকৃত পরিবহনগুলো তাদের যাত্রা বিরতিতে সাধারণত এখানকার মহাসড়ক সংলগ্ন হোটেলগুলোতে যাত্রা বিরতি করে। তাই এ শহরটি দেশের সকল বয়সি মানুষের একটি পরিচিত নগরী। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে থাকায় সড়কযোগাযোগে সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। চলমান কাজ শেষ হলে যোগাযোগের নতুনদ্বার উম্মোচন হবে শেরপুরে। অর্থনীতিতে শেরপুর উপজেলা উত্তরবঙ্গের সব উপজেলা থেকে উন্নত। এ শহরের বেশিরভাগ মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকুরীর সাথে সম্পৃক্ত। শহরে এবং শহরের গন্ডির বাইরে প্রচুর শিল্প ইন্ডাস্টী গড়ে উঠেছে। রয়েছে সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি ও ফিড মিল কারখানাসহ নানা প্রতিষ্ঠান।

বগুড়া দইয়ের যে নামজোশ সারাদেশে রয়েছে সেই দধির একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় শেরপুর থেকে। অর্থাৎ শেরপুর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দধি নির্মাণের সাথে অতপ্রতভাবে জড়িত। অন্যদিকে শহরের বাহিরের বেশিরভাগ মানুষই কৃষি কাজ করে। এবং তারা বৃহত আকারে গবাদিপশু পালন করে। শেরপুরের মহিপুর অঞ্চলে রয়েছে দুগ্ধ ও গবাদিপশু উন্নয়ন খামার।

শেরপুরের বেকার নারী ও গৃহবধুরা তাদের নিপুন হাতে তৈরি করে সুতোর টুপি। যা বর্তমানে বিশ্ব বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। এ উপজেলার শতাধিক গ্রামে টুপি বুননের কাজ করে লক্ষাধিক নারী। যা শেরপুরের অর্থনীতিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

শেরপুরের পল্লীগুলো সুশোভিত এক নয়নাভিরাম জনপদ। উপজেলার বুকচিরে বয়ে গেছে ইতিহাস খোচিত করতোয়া নদী। এর পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবাহমান হলহলিয়া বা বাঙ্গালিয়া নদী। এছাড়াও শেরপুরের গ্রাম ভেদ করে ছড়িয়ে গেছে ভাদাই ও ফুলজোড় নদীসহ মোট ৪টি নদী। এ নদীগুলো প্রত্যেকটি শেরপুর মাটির নিশ্বাস। যা বাচিয়ে রেখেছে শেরপুরের মানুষ ও প্রকৃতিকে। শেরপুরের কৃষি ক্ষেতে দেখা মিলবে নারীপুরুষের সমম্মিলিত কৃষি কাজ। তারা সাড়িবদ্ধভাবে পুরুষের পাশাপাশি নিজেরাও কাজ করে থাকে। তাদের উৎপাদিত প্রধান শস্য ধান, ভুট্টা, পাট, আলু। উৎপাদিত পন্যের দরপতন হয় উপজেলা বৃহত্তর ১৭টি হাট-বাজারে। এসব বাজারগুলোতে অন্যান্য পণ্যর পাশাপাশি প্রচুর তরমুজ এর আমদানি হয়। উল্লেখ্য যে, শেরপুর উপজেলার পরতে পরতে মাথা উচিয়ে দাড়িয়ে আছে সাড়ি সাড়ি নারিকেল গাছ। এসব গাছে উতপন্য নারিকেল গুলো সংগ্রহ করে সারা দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, আজকের শেরপুর এককালের মহানগরীর স্মৃতি বিজড়িত একটি পরিত্যক্ত খন্ড উপশহর মাত্র। পূর্বে এটি ছিল ধনে জনে পরিপূর্ণ এক বিশাল নগরী। অতীতে এ জনপদের প্রশংসায় মুখরিত ছিল সারাটি গাংগের সমগ্র বঙ্গ ভূমি। এ নগরীর খোশ নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দুরান্তরের দেশ ও মহাদেশে। মহা সুনামের এ ভূখন্ডে, অজ্ঞাত যুগে উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার অথবা বরেন্দ্র তিলক নামে অভিহিত করা হতো। কত রাজা মহারাজার শাসনাধীন শতাব্দী পার করেছে এই শেরপুর তার অন্ত নেই। এটি এককালে বৃহত্তর বগুড়ার জয়পুরহাট মহকুমার দ্বিতীয় মর্যাদাশীল এক ঐতিহাসিক শহর ছিলো। যাকে এক সময় উত্তবঙ্গের দিল্লি হিসিবেও অভিহিত করা হতো। আসলে শেরপুরের প্রাচীনত্ত পুরাতন দিল্লি অপেক্ষা কোন অংশেই কম ছিল না। যা এখনও অনুধাবন যোগ্য। সেসময় শেরপুরকে দালান বা কোঠা বাড়ীর শহর বলে ডাকা হতো। জমিদারী আমলে এখানে এত সংখক দ্বিতল, ত্রিতল প্রাসাদ তৈরী হয়েছিল যে, এগুলি নির্মাণ কল্পে অসংখ্য রাজমিস্ত্রিকে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হতো এবং উক্ত মহল্লাটি পরবর্তী কালে মিস্ত্রি পাড়া নামে অভিহিত হয়েছিল। কিন্তু সেই দালান কোঠার শহরটি ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই সকাল ৬টার সংঘটিত এক সর্বনাশা ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং জনপদের বিশাল সংখ্যক মানুষ  দালান চাপা পড়ে প্রাণ হারায়।

বর্তমানের শেরপুর শহরটি প্রাচীন শেরপুরের ভাংগা গড়ার পঞ্চম সংস্করণ। ইতোপূর্বে এই শহরটি কমপক্ষে চার বার চুড়ান্ত ধ্বংসাবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। অবশেষে আজকের শেরপুর দূর অতীতের স্মৃতি বক্ষে জুড়ে ক্ষুদ্রতম পরিসরে মহাকালের স্বাক্ষররূপে দাঁড়িয়ে আছে।

শহরের গন্ডিতে একই মহল্লায় একাধিক বৃহদাকার মসজিদের অস্তিত্ব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এককালে এ স্থানটি মুসলীম জনবহুল এলাকা ছিলো। হওতো সময়টি ছিল মুঘল ও সুলতানী আমল। পরে জমিদারি আমলে শেরপুর মুসলমান শূন্য জনপদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। অর্থাৎ সে আমলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, সৌগন্ধ বনিক প্রভৃতি গোষ্ঠি ছিলেন এখানকার দন্ডমুন্ডের অধিকর্তা। বর্তমানে শেরপুর উপজেলায় বাস করে প্রায় সাড়ে লাখ লক্ষ মানুষের যাদের সিংহ ভাগই মুসলীম সম্প্রদায়। মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত এখানে একাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারমধ্যে প্রায় সাড়ে চারশত বছর ধরে টিকে থাকা খেরুয়া মসজিদ অন্যতম।

পরিসংখ্যান মতে বর্তমান শেরপুর উপজেলার মোট মসজিদের সংখ্যা ৪৮০টি যার মধ্যে একটি উপজেলা মডেল মসজিদ। আর মন্দিরের সংখ্যা ৬৫টি। যার মধ্যে ঐহিত্যবাহী মা-ভবানীর মন্দির অন্যতম। রয়েছে একটি গীর্জা বা খ্রীষ্টীয় উপসণালয়।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।