Atghoria Thana jpg

এ পর্বে থাকছে আটঘরিয়া থানার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সামাজিক পরিবেশ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চিত্রায়নসহ থানা এলাকার বিভিন্ন অপরাধ সংক্রান্ত বাস্তবিক চিত্র।

চন্দ্রাবতী, ইছামতি, রত্নাই, চিকনাই ও কমলা নদী বিধৌত এবং সানকিভাঙা, গজারিয়া, কৈডাঙি, খলসাবাড়ি, হোগলবাড়ি, আঠারো খাদা, কলমিগাড়ি, মধুগারি, চত্রা, জলকা, গুবিদ, গারুল প্রভৃতি বিলের জলধারায় সিক্ত একটি প্রাচীন প্রশাসনিক নগর আটঘরিয়া। কৈবর্ত বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রাহ, সিপাহী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের গৌরব-দীপ্ত এবং বেরুয়ান, বংশীপাড়া যুদ্ধের গৌরবে মহিমান্বিত; শিক্ষাবিদ ইদ্রিস আলী, সঙ্গীত-সাধক শহীদ এম এ গফুর, বরেণ্য আলেম মওলানা ইয়াকুব আলীর স্মৃতি-ধন্য ভূখন্ড এই আটঘরিয়া।

 

 

নদী-বিল-জলাশয়ের জলধারায় সিক্ত, তরু-লতা-বৃক্ষরাজি শোভিত, ফুল-ফল-ফসলে ভরা আটঘরিয়া সত্যিই অতুলনীয়। এ-যেন স্রষ্টার অপার লীলামহিমায় সৃষ্ট এক অপূর্ব শিল্পকর্ম। জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু-বৈষ্ণব-ইসলাম-খ্রিস্টা কত ধর্মের মানুষের চিন্তাধারা যে এখানকার মানুষের প্রাণপ্রবাহে মিশেছে তার ইয়ত্তা নেই। গুপ্ত-পাল-সেন-পাঠান-মোগল-বৃটিশ বেনিয়া আর খান সেনাদের শাসন-দুঃশাসনের কত কীর্তি যে এই মাটিতে লীন হয়েছে তারও সীমা-পরিসীমা নেই। এই মাটির ভাঁজে ভাঁজে লেগে আছে অগণিত মুক্তিকামী নর-নারীর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এই মাটিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে অমিততেজী মুক্তিসেনা। এখান থেকেই লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত-সুপ্রশিক্ষিত পাকসেনা। এখানকার আকাশে-বাতাসে কান পাতলে এখনও ভেসে আসে স্বাধিকার-প্রমত্ত মানুষের উদাত্ত কণ্ঠের ধ্বনি। অগণিত সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-বৈরাগী, অলি-আউলিয়া-পির-গাউস-কুতুবের পদচিহ্ন বুকে নিয়ে মহাকালের মহাসড়কে হেঁটে চলছে আটঘরিয়া। মৃধার মসজিদ, খানবাড়ি মসজিদ, বেরুয়ান জামে মসজিদ, একটি মাঠ, অনেকগুলো দিঘি ও সারিবদ্ধ গাছপালা দেখে অনুমান করা হয় এ-অঞ্চল এক সময় অতীব গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল।

হিন্দুয়ানী ঐতিহ্য গোড়রী মন্দিরসহ নানা পুরাকীর্তিতে অনন্য আজকের আটঘরিয়া পাবনা জেলার এক সমৃদ্ধ উপজেলা। শ্রীকোলের সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ, সড়াবাড়িয়ার আকাশ-ছোঁয়া তালগাছ-জামগাছ, সারি সারি নারিকেল ও সুপারি গাছ এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যের সোনালি দিনের সাক্ষ্য কার্পাস তুলার শুভ্রতা জানান দেয় আটঘরিয়ার পুরনো দিনের সমৃদ্ধ ইতিহাস।

 

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়- জনগণের জান-মাল রক্ষার্থে ১৯১৫ সালের ১৫ জানুয়ারী  প্রথমে আটঘারিয়াতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে আটঘরিয়া মৃত লালন সিংহের স্ত্রী মাতঙ্গিনী সিংহ ১১ বিঘা জমি দান করেন। উক্ত জমির উপরিই ১৯৩৪ সালে আটঘরিয়া থানা ভবন নির্মাণ হয়।

 

আটঘরিয়া বহুকালের পুরানো জনপদ। জানা যায়, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনামল তথা খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-৩০০  সালে “পোদ জাতির” আটজন মানুষ সর্বপ্রথম আটঘরিয়ায় বসতি স্থাপন শুরু করে। সেই আট জনের বসতিকে কেন্দ্র করেই আটঘরিয়া নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

রাজশাহী বিভাগের অতি প্রাচীন একটি জেলা পাবনা। যা এখন ১১টি থানায় বিভক্ত। তন্মধ্যে আটঘরিয়া থানা অন্যতম।

১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং পরিবর্তিত প্রশাসনিক নীতির ফলশ্রুতিতে থানা পরিষদ ও থানা প্রশাসন পূনর্গঠন অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে আটঘরিয়া থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করা হয়। তখন থেকে ২০০১ সাল অবধি আটঘরিয়া থানার কারযক্রম পরিচালিত হত উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন জুড়ে, যথা মাঝপাড়া, চাঁদভা, দেবোত্তর, একদন্ত ও লক্ষীপুর। পরে লক্ষীপুর ইউনিয়নকে আটঘরিয়া থানা থেকে পৃথক করে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত আতাইকুলা থানার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে আটঘরিয়া থানার সীমানার আয়তন হ্রাস পেয়ে দ্বারায় ১৪৩.৪১ বর্গ কিঃমিঃ। বর্তমানে ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে আটঘরিয়া থানার প্রশাসনিক কারযক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

কাল অবিরাম গতিতে প্রবাহিত হয়। ইতিহাসের ভাঙা-গড়ায় সৃষ্টি হয় নানা জনপদ। কালের এই ভাঙা-গড়ার লীলাখেলায় গড়ে উঠে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমির প্রসিদ্ধ জনপদ, বর্তমান পাবনা জেলার অন্যতম সমৃদ্ধ ভূখন্ড, আটঘরিয়া নামের উপজেলা।

আটঘরিয়ার উন্নতি-অগ্রগতিতে রয়েছে এখানকার তাঁত শ্রমিক ও কৃষক। কৃষকদের উৎপাদিত ধান-পাট-শিম-পেঁয়াজ-রসুন-মরিচ ও বিচিত্র সবজি এ-অঞ্চলকে করেছে বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতির দৃপ্ত পথিক।

প্রধান প্রধান অর্থকারী ফসলের মধ্যে শিম ও পাট অন্যতম। প্রতি বছর আটঘরিয়া উপজেলায় প্রায় ১৪,৯৬২ বিঘা জমিতে শিমের আবাদ হয়। আবাদকৃত জমি হতে প্রায় ৩৪,০০০ মে: টন ফলন পাওয়া যায়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। আটঘরিয়ার প্রায় সবত্রই পাটের আবাদ হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় দেবোত্তর ও একদন্ত ইউনিয়নে। প্রতি বছর প্রায় ২৭,১২০ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ হয়। যা আটঘরিয়ার একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি।

তছাড়া পেঁয়াজ, রসুন, কলা, শিম, মাছ, পোল্ট্রি খামার, তাঁত ও দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত আটঘরিয়া থানা অঞ্চল।

পাবনা জেলা শহর থেকে মাত্র ১৩ কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদ কার্যালয়। আটঘরিয়া থানা অঞ্চলের সকল সেবাদপ্তরগুলো গড়ে উঠেছে এই উপজেলা কার্যালয়কে কেন্দ্র করেই।

 

১৮৬.১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট আটঘরিয়া উপজেলাটি পাবনা-৪ সংসদীয় আসনের আসনের অন্তর্ভূক্ত। উপজেলার মোট মৌজার সংখ্যা ১১১টি, গ্রাম ১৩০টি ইউনিয়ন ৫টি যার ৪টি ইউনিয়ন আটঘরিয়া থানাধীন। এবং পৌরসভা ১টি। চাঁদভা এবং দেবোত্তর ইউনিয়নের আংশিক এলাকা নিয়ে গত ২০ জুলাই ২০০৬ সালে আটঘরিয়া পৌরসভা গঠিত হয়। এর আয়তন ১০.৫০ বর্গ কিঃ মিঃ।

উপজেলার ১নং ইউনিয়নের নাম মাজপাড়া। এর আয়তন ৪০.৮৩ বর্গ কি.মি.। মোট ২৫টি মৌজা ও ৩২টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত মাজপাড়া ইউনিয়নের লোকসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর অবস্থান উপজেলার সর্ব পশ্চিম প্রান্তে। এর পরই 30.76 বর্গ কি.মি আয়তন সীমানা নিয়ে দাড়িয়ে আছে ২নং চাঁদভা ইউনিয়ন। মোট ২১টি মৌজা ও ২৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত চাদভা ইউনিয়নে বাস করে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

উপজেলার ৩নং ইউনিয়নের নাম দেবত্তর ইউনিয়ন। উপজেলার ঠিক মধ্যবিন্দু এর অবস্থান। মোট ২৬টি মৌজা ও ৩০টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত দেবোত্তরের আয়তন ৩০.৬৬ বর্গ কি.মি.। এ ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। আটঘরিয়া শহর বলতে এখন দেবোত্তরকেই বাঝানো হয়। উপজেলার বেশিরভাগ অফিস এখানেই নির্মাণ করা হয়েছে।

উপজেলার ৪নং ইউনিয়নের নাম একদন্ত। এর আয়তন ৩৩.৯৪ বর্গ কি.মি.। একদন্ত ইউনিয়নটি পান চাষ ও তাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এ ইউনিয়নের চাচকিয়া লুঙ্গি দেশ জুড়ে প্রশংসিত। সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালোমানের সুতার লুঙ্গি তৈরি হয় এখানেই। চাঁচকিয়া লুঙ্গি এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, ২৩টি মৌজা ও ২৮টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত এই ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটি অতি পুরোনো এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এর মাঝেই পরিষদের যাবতীয় কাজ পরিচালিত হচ্ছে।

ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ লিয়াকত হোসেন আলাল বলেন, পুরোনো এ ভবনে আমাদের সর্বক্ষন আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। যখন তখন ভবনের ছাদ থেকে ইট, বালি খসে মাথার উপর পড়ে।

নতুন ভবন নির্মানের জন্য মোট ২০ শতাংশ জায়গার প্রয়োজন, কিন্তু পরিষদের রয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ।

 

বাউল সাধক লালন শাহের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এই আটঘরিয়া উপজেলা। লোককবি মালেক সরকার, পুঁথিপাঠক আবু মুছা, সমাজহিতৈষী ও  নাট্যপরিচালক-নির্দেশক ও ঔপন্যাসিক ড. জহির বিশ্বাস, ডিজিএফআই-এর সাবেক প্রধান, মেজর জেনারেল (অব.) নজরুল ইসলাম রবি, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক এ টি এম ফখরুল ইসলাম সুজা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ড. আব্দুল কাদের, বারডেম হাসাপাতালের খ্যাতিমান চিকিৎসক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ এই আটঘরিয়ার সূর্যসন্তান।

 

অন্যদিকে আটঘরিয়াকে বলা হয় বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষা-সমৃদ্ধ এলাকা। এ উপজেলায় স্থাপিত হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। মোট ৭টি কলেজ, ২টি সিনিয়র মাদ্রাসা, ১৫টি দাখিল মাদ্রাসা, ২০টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ সরকারি-বেসরকারি মোট ৭৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, শহিদ আব্দুল খালেক উচ্চ বিদ্যালয় ও শিবপুর ত্বাহা ইসলামী ফাযিল মাদ্রাসা।

 

এ জনপদে বসবাস করে মোট ২৯,৫৭৫টি পরিবার। আটঘরিয়া উপজেলাতে রয়েছে ৫টি পোস্টঅফিস, ১টি সরকারি হাসপাতাল, ১৭টি ক্লিনিক ও স্বাস্থসেবা কেন্দ্র, ৭টি ব্যাংকের শাখা ও ১১টি প্রসিদ্ধ হাট-বাজার। যা আটঘরিয়ার অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।