রূপালী পর্দা কাঁপানো একসময়ের সাবানা, ববিতা, কবরীসহ অনেক অভিনেত্রীর নাম ছিলো বাংলার ঘরে ঘরে ও দর্শকদের মুখে মুখে । নব্বই দশকের সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর কথা মনে পড়ে যায় যাদের হাত ধরে উৎসব মুখর হয়  সিনেমাহলগুলো। গ্রাম-গঞ্জে একটা সময় নিদারূণ ভাবে দালানের ওয়ালে ও বাজারে এমনকি মাইক হাতে নিয়ে মাইকিং করতো নতুন নতুন ছবির । আর সেই সব সিনেমা দেখতে ভির করতো পরিবার-পরিজন নিয়ে ফ্যামিলিসহ সব শ্রেণির লোকজন। গ্রাম-বাংলায় জারিগান, বাউলগান, সার্কেসসহ যেসব পরিচিত ছিল তার মধ্যে এসব সিনেমা ছিলো অন্যতম। আর এই চলচিত্রের অগ্নি অভিনয় যেমন  পাকাপোক্ত ছিলো তেমনি থাকতো নতুন নুতন কুশিলবদের পদচারণা । এভাবে একসময় একবিংশ শতাব্দিতে এসে জনপ্রিয় হতে শুরু করে অপু বিশ্বাসসহ  ও তাঁদের কুশিলবরা ।

অপু বিশ্বাস

অপু বিশ্বাসের  শৈশব ও কৈশোর

বাংলা চলচ্চিত্রের কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে  তারকা অভিনেত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন অবন্তি বিশ্বাস নামধারী পর্দায় পরিচয় অপু বিশ্বাস। অপু বিশ্বাস উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত প্রাচীন জনপদ বগুড়ার কাটনার পাড়ায়  ১৯৮৯ সালের ১১ই অক্টেবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরপর শুরু হয় তার শৈশব ও কৈশোর । তাঁর শৈশব কেটেছিলো বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তবে তিনি এসওএস হারম্যান মেইনার বিদ্যালয়ে প্রবেশের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পর্যায় ক্রমে আলোর মেলা তারপর ক্রিসেন্ট হাই স্কুল এবং মাধ্যমিকে ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ণ শুরু করেন। স্কুল জীবনে মা-বাবার অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন মঞ্চে নাচতে শুরু করেন। অপু বিশ্বাসের নাচের প্রতি আগ্রহ ও দৃষ্টিনন্দন থাকায় তাঁর ফ্যামিলি তাঁকে ওস্তাদ ও নৃত্যগুরু আবদুস সামাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ও শুরু হয় তার নাচের তালিম। নৃত্যে বিশেষ পরদর্শী থাকায় লাইলী মজনু নৃত্যনাট্যে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শক মহলে সারা পেতে থাকেন । পরবর্তীতে একাডেমিকভাবে হাতিখড়ি হয় বুলবুল ললিতাকলায় । এর কিছুকাল পর জেলা শিল্পকলায় বেশ কিছু মঞ্চে অতিনিপূণ ভাবে নুপূরের শব্দে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন।মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন মঞ্চনাট্যে অভিনয়ের এক প্রতিযোগিতায় দশম স্থান অধিকার করেন।

https://youtu.be/WaugBCS6eQw

যে ভাবে বড় পর্দায় পরিচিতি পায় অপু বিশ্বাস

অপু বিশ্বাস নানান অভিনয়ের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দর্শকদের নজরের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের পরিচালকদের নজর কারেন। ২০০৫ সালের দিকে তাঁর মূল নাম অবন্তি চরিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন জনপ্রিয় পরিচালক আমজান খানের কাল সকাল সিনেমার মাধ্যমে দর্শক মহলে সারা ফেলতে শুরু করেন।২০০৬ সালের দিকে ফখরুল ইসলাম মানিকের কোটি টাকার কাবিন মুভির মূল চলচিত্রে সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা শাকিব খানের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে পরিচিত পান। আবার, ছবিটি দর্শকমহলে বেশ সারা মিললে ও তার জুটি গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে রাতারাতি তিনি জনপ্রিয়তারশীর্ষে উপনীত হন।শাকিব-অপু জুটি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠে ও এফ আই মানিকের পরিচালনায় ছবিটি ব্যবসা সফল একটি অনাবাদ্য সিনেমা হয়ে দাড়ায়। একইভাবে ঐ বছরে অপু-শাকিবের যৌথ ভালোবাসায় চাচ্চু, পিতার আসন এবং দাদীমা চলচ্চিত্রের পর্দায় সফল ভাবে নির্মাণ করেন। ২০০৭ সালের শুরুর দিকে অবন্তিবিশ্বাস বাংলার অন্য এক ক্যারিয়ার তুঙ্গে তৎকালীন অভিনেতা সৈয়দ মোহাম্মাদ আসলাম তালুকদার মান্না সাথে মেশিনম্যান নামে ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর, পুনরায় অপুবিশ্বাস কাবিন নামা নামে একটি ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রে মেইন আর্টিস্ট হিসাবে থাকেন। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০০৮ সালের গোড়ায় অপু-শাকিব জুটিতে আমার জান আমার প্রাণ, তুমি স্বপ্ন তুমি সাধনা, মনে প্রাণে আছো তুমি এবং ঐ সালে শেষের দিকে ও ২০০৯ সালের প্রথমে ভালোবাসার লাল গোলাপ, মন যেখানে হৃদয় সেখানে, মায়ের হাতে বেহেস্তের চাবিসহ বেশ কিছু মুভিতে সফলভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে জান আমার জান চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসাবে বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনে পুরস্কারে ভূষিত হন। ‘মনে বড় কষ্ট’ সিনেমায় অপু বিশ্বাসের বিশেষ ও দর্শকদের মন মাতানো অভিনয়ের ফলে ‘মেরিল প্রথম আলো’ তারকা-দর্শক জরিপের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীর মনোনোয়ন লাভ করেন।

ধারাবাহিক ভাবে সিনেমার শাকিব-অপু জুটির  প্রায়  ২০১৫ সালের প্রথমদিকেও রাজাবাবু-দ্য পাওয়ার ও রাজা ৪২০ এবং লাভ ম্যারেজ সিনেমায় বিশেষ ভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারপর, প্রযোজক মুহাম্মাদ মোস্তফা কামাল রাজের সম্রাট দ্য কিং ইউ হিয়ার সিনেমায় ভারতের ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত সাথেও অভিনয় করেন।

২০১৭ সালে অপু বিশ্বাস দীর্ঘ দশমাস মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে আবার অভিনয়ে ফিরেন। বুলবুল বিশ্বাসের পরিচালনায়  একটি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক পরিবার ও বেড়ে উঠা থ্রিলারধর্মী সিনেমায় আনিসুর রহমান মিলন ও ঢাকার কিং শাকিবখানের সাথে  দেখা যায়।  দীর্ঘদিন বিভিন্ন পরিবারিক ও জটিলতায় আবার তিনি দেবাশিষ বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে  বাপ্পী চৌধুরীর সাথে শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ সিনেমার পর্দায় আসেন। তাঁর এই সিনেমা ক্যারিয়ারে প্রায় একশতের অধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেন।শুধু কিং খানের বিপরীতেই কর্মজীবনে প্রায় ৭২টিরও অধিক চরিত্রে দেখা যায় তাকে। কর্মজীবনে অর্জন করেছেন বাচসাস পুরস্কার অর্জন এবং মেরিল প্রথম আলোর ছয়বার পুরস্কারের মনোনয়ন।

অপুর বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার কিংখানের বিপরীতে অভিনয় করা এ অভিনেত্রী ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিলের দিকে শাকিবখানকে বিয়া করেন। একটি বেসরকালী টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে ২০১৭ সালের দিকে অপু বিশ্বাস কিংখানের সাথে বিয়ার কথা প্রকাশ করেন। তিনি এ জানান, দীর্ঘ গোপনে সম্পর্ক থাকার পর হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে পরিবর্তন হয়ে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে নাম রাখেন অপু ইসলাম খান। বিয়ার দীর্ঘ ৮ বছর পর  ২০১৬ দিকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় তাঁর পুত্র সন্তান আব্রাম খান জয় জন্মগ্রহণ করেন।

আরও জানুন:‘১৫ মিনিটে গুলশান থেকে কাওরান বাজার!’

নানান নাটকীয়তার মাধ্যমে ২০১৭ সালের দিকে ঢালিউড অভিনেতা তালাকের জন্য আবেদন করেন। তবে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও নাটকীয়তার মাধ্যমে এ দম্পতির ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তালাক হয়ে যায়। এবং আইন অনুসারে তাঁদের সন্তান আব্রাম খান জয়কে তাঁর মায়ের কাছে রাখা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, বর্তমানে এ ঢালিউড অভিনেত্রী  বাপ্পী চৌধুরীর সাথের সাথে বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে পর্দায় নতুন নতুন ছবি নিয়ে আসতেছেন।

বিবাহ বিচ্ছেদের পর আবারও সিনেমায়

জীবন আসলে অসার । মূলত জীবনের আসল রহস্য নিগূঢ় থাকে কর্মে। নানান নাটকীয়তার পরও অপু বিশ্বাস সংসার ত্যাগ করলেও ক্যারিয়ারে একটু প্রভাব ফেলাতে দেননি । গড়ে তোলেছেন আপন ভুবন। বাধা-বিপত্তিকে এগিয়ে নিতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন নিজের জন্য। দর্শকদের নিত্য নতুন বিনোদন দেওয়ার জন্য নিজেকে সেই ভাবে তৈরি করেছেন । প্রতিনিয়ত জিম করেন । জিমের পাশাপাশি তিনি পুরোনা সব আশা-ব্যর্থতা মুচে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। একটা সময়ের নিজের সন্তান নিয়ে ঘুরেছেন আত্ম স্বীকৃতের জন্য । বর্তমানে দর্শকদের নতুন সিনেমা দেওয়ার জন্য এবং নিজেকে ফিট রাখার জন্য অনুশীলন করেই চলেছে।

মুক্তিযুুদ্ধ ভিক্তিক সিনেমা ‘প্রিয় কমলা’য় তিনি

জানা যায়, বিভিন্ন সিনেমামায় নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টার জন্য ।কখনো সাজতে হয় নায়িকার ভূমিকায় কখনো বা দর্শকের ভূমিকায় কেননা একটি চলচ্চিত্র বা সিনেমা ফুটে উঠে গল্পে আর সেই গল্প যদি ভালো লাগার এবং সাড়া ফেলানো মতো কিছু না হয় তাহলে শ্রমেই সার্থক হয় না। একজন আর্টিস্ট হিসেবে যে সব গুণ থাকা দরকার সব গুলোই আয়ত্ত করতে হয়। ছোট বেলা থেকে বেড়া উঠার গল্প যেমন ছিলো নৃত্য দিয়ে ঠিক তেমনি বড় পর্দায় ও সেভাবে উপস্থাপন করতে হয়। প্রিয় কমলা নামের সিনেমায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বেড়ে উঠা ও সেই সাথে আবহমান বাংলার চিরাচরিত রূপকে ফুটে তোলা হয়। আরও তোলে ধরেন একজন প্রেমিকারুপে গ্রামের প্রধান মতবরের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ভুলতে না পারা এক প্রেমিকের কথা । যিনি দেশের জন্য যুদ্ধে নিজেকে নিঃস্বর্গ করেছিলো । মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সম্বলিত শাহরিয়া খান জয়ের পরিচালনায় ফুটে উঠে একজন প্রেমিকের আত্মত্যাগ, পরিবার পরিজনসহ ভালোবাসার সুসময় গুলো । যা আজও মনে করে সেই চিরচারিত রূপকে । মনে করিয়ে দেয় ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও আলবদর, রাজাকারদের নির্মম অত্যাচার ও বেঁচে থাকা।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।