maxresdefault 5 jpg

সুউচ্চ অট্টালিকার শহর! তারই মাঝে কোন ঠাসা একেকটি ভবনগুলো শ্রমিকের পরিশ্রান্ত ঘ্রাণ ও শাই শাই শব্দে মুখর। এ শহরের গলি পথগুলো খুবই সংকীর্ণ। প্রতিদিন সূর্যদয়ের সাথে সাথে ব্যস্ত হওয়া এ শহর আবার শান্ত হয় রাতের মধ্যভাগে। পরদিন ভোর থেকে আবারো একইভাবে মেতে ওঠে ইট পাথরের এই ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। এর বিস্তৃর্ণতা ছড়িয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী তীর ধরে প্রায় ২০ কি.মি. সীমানা নিয়ে। আর এর বাইরের প্রায় ৭৫ ভাগ জনপদ প্রকৃতির অপার মহিমায় গড়া নিবিড় শান্ত পল্লী গ্রাম।

একপাশে বুড়িগঙ্গা অন্যপাশে ধলেশ্বরী নদীর স্রোত অঞ্চলের প্রকৃতির ভারসাম্য ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।

 

 

১২টি ইউনিয়ন বিশিষ্ট ১৬৬.৮৭ বর্গ কি.মি. আয়তন সীমানার এ ভূখন্ডের নাম কেরাণীগঞ্জ উপজেলা। ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার উপকন্ঠে অবস্থিত, শিল্পে সমৃদ্ধ প্রাচীন এ থানা সীমানার উত্তরে মোহাম্মদপুর, সাভার, পূর্বে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা, দক্ষিণে নবাবগঞ্জ ও পশ্চিমে মানিকগঞ্জ জেলা অবস্থিত।

উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২০ লক্ষাধিক এবং কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা নগরীর জনসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ। মোট পরিবারের সংখ্যা ১ লক্ষ ২০ হাজার প্রায়। নির্বাচনী এলাকা-ঢাকা ১৭৫, নদ-নদীর সংখ্যা ২টি, হাট-বাজার মোট ১৬টি, মোট জমির পরিমাণ ৮৪০২ হেক্টর, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ৬টি, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ১টি, উপজেলা পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ১টি, কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র ১টি, গবাদী পশুর খামার ৭০৫টি, পোল্ট্রি খামার ১৮৩টি এবং আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৪টি।

এ উপজেলাটি দুটি থানা এলাকা নিয়ে বিভক্ত রয়েছে। তার একটি ৫টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা, আর অন্যটি ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার নামকরণ

বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী বিধৌত কেরাণীগঞ্জের ইতিহাস সর্ম্পকে ভাবতে গেলে আমাদের সর্ব প্রথম জানা প্রয়োজন এই এলাকার নামকরণ কিভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে। কিন্তু এটা সত্য যে, কেরাণীগঞ্জের নামকরণের পিছনে কোন প্রকার ইতিহাস ভিত্তিক সমর্থন আমরা এখনো খুঁজে পাই নি। তথাপি বাংলায় কররান বংশের রাজত্বকালের ইতিহাস ভিত্তিক আলোচনা থেকে কেরাণীগঞ্জ নামকরণের কিছুটা যৌক্তিক সমর্থন পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, আফগান ও পাঠান জাতির একটি উন্নত বংশ শেরশাহ ও তার ছেলে ইসলাম শাহ আফগানিস্তানের কিরান এলাকা থেকে এসে একটি পৃথক বংশের সূচনা করেন। যাদেরকে বলা হতো কররানী। বাংলার কররানী শাসক গোষ্ঠির শেষ সময় আনুমানিক ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কররানীরা এ এলাকায় কিছু কাল অবস্থান করেন। সম্ভবতঃ এ অবস্থানই কেরাণীগঞ্জ নামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রাচীন স্থাপত্য, হিন্দু, মুসলিমদের মিশ্র সংস্কৃতি সম্বলিত এ অঞ্চলটি বহুকাল পূর্বের একটি প্রশাসনিক জনপদ। ঐতিহাসিকভাবে উল্লেখ রয়েছে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী এবং তার এক খালাকে এ এলাকায় কারাবন্দী রাখা হয়েছিলো। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ঢাকা জেলায় পরিচালিত অধিকাংশ গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা হয়েছিলো এ থানা নগরী থেকেই। সুতরাং কেরাণীগঞ্জ থানার নাম ইতিহাসের পাতায় চিরকালই থাকবে চির অম্লান।

আধুনিক কেরাণীগঞ্জ উপজেলা

বর্তমানে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলটি একটি আধুনিক শিল্প নগরে পরিণত হয়েছে। নানাবিধ ব্যবসা, শিল্প-কারখানা, বিভিন্ন ধরনের বিনোদন পার্ক, মনোরম পরিবেশের কফি হাউস, আন্তর্জাতিক মানের অনেকগুলো রিসোর্ট ও বর্তমানে কয়েকটি আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠতে শুরু করেছে এ শহরকে কেন্দ্র করেই।

কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা নগরী এক সময় এমন ছিলো না। পুরো অঞ্চলটিই ছিলো সবুজে ঢাকা নৈসর্গিক পরিবেশের একটি অরণ্য ভূমি অঞ্চল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের প্রয়োজনে এখানে গড়ে উঠতে শুরু করে একেকটি ব্যবসাকেন্দ্র ও নানা প্রয়োজনীয় স্থাপনা। সেই ধারাবাহিকতায় মানুষের নৈমিত্তিক বিভিন্ন দাপ্তরিক সমস্যা সমাধানে একে একে গড়ে উঠতে শুরু করে নানান সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। উপজেলা ভূমি অফিস, উপজেলা নির্বাচন কমিশন, উপজেলা শিক্ষা অফিসসহ নানা দাপ্তরিক অফিস স্থাপিত হয় তৎকালিন কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলে।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার উন্নত প্রযুক্তি

যুগান্তরের এ সময়ে এখন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, বিবিধ শিল্পকারখানা, ব্যাংক-বীমা, এনজিওসহ নানা জনকল্যাণমুখী সংস্থাও। বাবুবাজার ব্রীজ সংলগ্ন কদমতলী মোড়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বখ্যাত জার্মান প্রযুক্তির সর্বাধুনিক ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) সুবিধাযুক্ত ইবনে সিনা ডায়াগনেস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে তুলনামূলক সবচেয়ে কম খরচ ও দক্ষ কর্মীদের আন্তরিক সেবার মাধ্যমে ইবনে সিনা ইতোমধ্যেই সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার কৃষি ও পেশা

কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য কোন প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও রাজধানী ঢাকার অদুরের এ থানা নগরীতে ব্যাপক কৃষি ফসল উৎপন্ন হয়। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছে এখানকার কৃষক। তাছাড়া ভূট্টা চাষের জন্য বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে এ অঞ্চলটি। তবে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দি হওয়ার কারণে প্রতিবছর বেশ ক্ষতির মধ্যে পড়ে কৃষকেরা।

অন্যদিকে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা নগরীতে স্থায়ী বসবাসকৃত মানুষের প্রধান অংশই বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসার সাথে জড়িত। অন্য অংশ চাকুরী ও কৃষি পেশার সাথে জড়িত রয়েছে। তাছাড়া কেরানীগঞ্জ অঞ্চলে খুব বেশি চোখে পড়বে পোশাক শিল্প থেকে উচ্ছিষ্ট বর্জের ব্যবসা।

অঞ্চলের একদিকে বুড়িগঙ্গা ও অন্যদিকে ধলেশ্বরী নদী বেষ্টিত থাকায় কেরানীগঞ্জ অঞ্চলের কর্মজীবি একাংশ মানুষ নদী নির্ভর জীবন নির্বাহ করে থাকে। তাই এখানকার খাল-বিলগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি মৎস অভায়রণ্য।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্য ঃ লুঙ্গি

উল্লেখ্য, উপজেলার রুহিতপুর-রামেরকান্দা গ্রামের রুহিতপুরী লুঙ্গি কেরাণীগঞ্জের ঐতিহ্য বহন করে। একসময় শুধু এ ইউনিয়নেই সাড়ে তিন হাজারের অধিক তাঁত শিল্প ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ তা আর ধরে রাখতে পারছে না এখানকার মানুষ। তাই সেই রুহিতপুরী লুঙ্গির ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তপ্রায়।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার শিক্ষা

অন্যদিকে শিল্প নগরী কেরাণীগঞ্জ শিক্ষা-দিক্ষায় অনেক বেশি এগিয়ে আছে। সরকারি পরিসখ্যান অনুযায়ী কেরাণীগঞ্জ অঞ্চলের ৮৫ শতাংশ মানুষই শিক্ষার আলোয় আলোকিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়সহ অনেকগুলো মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলে।

কেরানীগঞ্জ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে এর কিছু সাধারণ তথ্য অবশ্যই জানা দরকার।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার সম্মানিত ব্যক্তি-বর্গ

কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত ব্যাক্তিদের মধ্যে যারা অন্যতম তারা হলেন, উপজেলার ওয়াসপুর এলাকার কৃর্তি পুরুষ মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ান, শাক্তা ইউনিয়নের বামুন গ্রামের সভ্রান্ত পীর বংশে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশ কৃষি বিজ্ঞান তথা কীটতত্ত্বের একটি সুপরিচিত নাম ড. এম জেড আলম ও মধুরচর গ্রামে জন্ম নেয়া কমান্ডার আব্দুল হাই অন্যতম।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার বিশেষ স্থাপনা- বৃদ্ধ নিবাস

উল্লেখ্য, কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা নগরীতে রয়েছে একটি বৃদ্ধ নিবাস। বিচিত্র পৃথিবীতে কত মানুষই তার শেষ বয়সে মায়ার বাধন ত্যাগ করে থুবড়ে পড়ে থাকে রাস্তায়। যাদের ঠাই হয় এমন কোন বৃদ্ধাশ্রমে। গত বছর আগষ্ট মাসে একটি গণমাধ্যমের পাতায় উঠে আসে নিজের ঘর-বাড়ি থেকে বিতারিত বৃদ্ধ আব্দুল জব্বারের হৃদয়স্পর্শী গল্পটি। তিনি পথের ধারে বসে কাদছিলেন দেখে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে উপজেলার শাক্তা ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রামে অবস্থিত একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান আপন ঘরে পৌছে দেন। অতঃপর বৃদ্ধ আব্দুল জব্বার শত অসহায়দের ভিড়ে খুঁজে পান নিজের ঠিকানা।

নানা গুণে বিশেষায়িত কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা অঞ্চল একটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ভুখন্ড। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, সবুজ বৃক্ষের সমাহার আর নান্দনিক রূপে সজ্জিত বিভিন্ন স্থাপনা। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট, হোটেলগুলো গুণে ও সৌন্দর্যে বিশ্বমানের। রয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট ও বিনোদন কেন্দ্র। খাচার ভেতর চরে বেরানো, ময়ুর, খোরগোশ ও হরিণের পালগুলো সত্যিই মুগ্ধ করবে পশু প্রেমীদের।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।