Kalihati jpg

কালিহাতী উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য 

খটঘট শব্দে মুখর ৩০১.২২ বর্গ কি.মি. আয়তনের একটি বিশাল জনপদ। সাড়ি সাড়ি সবুজ বৃক্ষরাজি, আর ছোট ছোট টিনের ঘরগুলো দেখতে বসতি স্থান মনে হলেও আসলে মুলত এগুলো একেকটি শ্রমঘর। একদিকে ভোরের আলো ফোটে আরেক দিকে ঘরগুলো শ্রমিক ও যন্ত্রশব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। এসব ঘরেই তৈরি হয় বিশ্বখ্যাত বল্লা তাতের শাড়ি। ঐতিহাসিক যুগে বসাক সম্প্রদায়ের হাত ধরে এ অঞ্চলে তাঁতের কাজের সুচনা হয়েছিলো। সেই ঐতিহাসিক সময়গুলো এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান নিলেও তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য আজও বহমান টাঙ্গাইল জেলার ৬ষ্ঠ বৃহত্তর প্রশাসনিক অঞ্চল কালিহাতী উপজেলায়। এখানে প্রায় ৫০ হাজার তাঁত শিল্প অনবরত উপজেলার অর্থনীতির বৃহত্তর জোগান দিয়ে চলেছে।

বিভিন্ন পেশায় কালিহাতী

তবে কালিহাতী উপজেলা মুলত কৃষি নির্ভর একটি জনপদ। মোট আয়ের প্রায় ৫০ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। আর শিল্প মাধ্যম থেকে আয়ের পরিমাণ ৫ শতাংশেরও কম। বাকি ৫৫ শতাংশ আয় আসে অন্যান্য পেশা থেকে। কালিহাতী উপজেলার ঐতিহাসিক গল্প, কৃষক, জেলে, তাতী, ব্যবসায়ী, ধ্বনী, গরিবের বর্তমান জীবন ধারা ও এখানকার অপরাধ, আইন প্রয়োগ, সামাজিক শাসন সকল কিছুর একত্র বিবরণ নিয়েই পজিটিভ থিংক এর আজকের ১০৭তম বিশেষ আয়োজন।

 

 

কালিহাতীর শীতের সকাল

একটি শিশির ভেজা সকাল। কালিহাতী অঞ্চলের প্রকৃতির চিত্র সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে এ সময়টাতেই। কিন্তু শীতের সকালে কুয়াশার কারণে সূর্য না দেখা যাওয়ায় প্রকৃতির রং একটু ঘোলাটে মনে হয় ক্যামেরায়। তারপরও পজিটিভ থিংক টিম কালিহাতীর প্রকৃতি উপভোগ করতে ও প্রকৃতির কিছু সুন্দর মুহুর্ত ক্যামেরায় ধারণ করতে, অপার সৌন্দর্যে ঘেরা মৎস শিকারীর হাওরে পৌছে যায়। দিগন্ত জোড়া ধু-ধু পতীত ভূমি তার মাঝেই জলে পূর্ণ নিম্নভূমি! যা শত মৎস শিকারীর ভীরে এক অন্যরকম সৌন্দর্য়ের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ গায়ে কাটা দেয়া ঠান্ডার মধ্যেই নেমে পড়েছে পানিতে। তারা বিশাল আকারের জাল দিয়ে শেওলা ও কচুরীপানায় বদ্ধ পানি ঘিরে এক অভিনব পদ্ধুতিতে মাছ শিকারের পায়তারা করছে। আর অন্যরা ধর্মজাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। এসব দেখতে শহুরে মানুষের ভীষন ভালো লাগে। কিন্তু গায়ের মানুষের কাছে হয়তো এটা ভীষন কষ্টের। তারা জীবিকার দায়েই এসব করে থাকে।

শীতের মাঝামাঝি এ সময়ে টাঙ্গাইলের হাওড় বাওড়ে প্রচুর সাদা বকের দেখা মিলবে। গুটি গুটি পায়ে লম্বা ঠোটে বক পাখির মাছ শিকার দেখতেও ভীষন ভাল লাগে।

কালিহাতী উপজেলায় নদী-নালা

কালিহাতী উপজেলার হাওড়-বাওড়, নদী-নালা, শহর-নগর সবকিছুই ভিষন সুন্দর। এ উপজেলার যৌবন শুরু হয় প্রভাতে আর শেষ হয় রাতের শেষ প্রহরে। তবে সারা নিশি জেগে থাকে উপজেলার মধ্যভাগ দিয়ে চলমান দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কটি। পাখির চোখে দেখলে এ সড়কের চিত্রটিও ভীষন সুন্দর লাগে। সড়কের দুই পাশে ঘন অরণ্য। মনে হয়, একটি বিশাল সবুজায়নের মধ্যভাগকে দ্বিখন্ডিত করার জনই এই সড়কের সৃষ্টি হয়েছিলো।

অবশ্য বর্তমানে এ এলাকার সেই ঘন বনায়ন আর নেই। কালের ঘূর্ণয়নে এখন বনায়নের ফাঁকে ফাঁকে নির্মাণ হয়েছে বিভিন্ন বসত ভিটা। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে এখানকার নদী-নালা। ৩০১.২২ বর্গ কি.মি. আয়তনের ১৩টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বয়ে গেছে কালীহাতির ছয়টি নদী পথ।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নদীটির নাম যমুনা নদী।

কালিহাতী উপজেলার ইতিহাস

উল্লেখ্য, কালিহাতী উপজেলার অতীত ইতিহাস একটি গৌরবময় অধ্যায়। তবে তৎকালিন কালিহাতী অঞ্চলে আলাদাভাবে তখনো প্রশাসনিক নগর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ব্রিটিশ শাসনকালের একদম শেষভাগে তথা ১৯২৮ সালে কালিহাতী অঞ্চলে প্রথম একটি পুলিশ স্টেশন গড়ে ওঠে। পরে ১৯৮৩ সালে কালিহাতী থানাটি উপজেলার স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর ১৯৯৮ সালে উত্তরবঙ্গের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়। এসময় সেতুর পূর্ব এলাকার আইন শৃংখলা আরও মজবুত ও সুদৃঢ় করার লক্ষে্য স্থাপন করা করা হয় বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা। বঙ্গবন্ধু সেতুটি চালু হওয়া ও সময়ের ব্যবধানে কালিহাতী উপজেলার উপর দিয়ে চলমান ২৩ কি.মি. জাতীয় মহাসড়কটি চার লেনে উন্নিত হওয়া, উপজেলার যোগাযোগ খাতের এক বৃহত্তর সংযোজন।

তাঁত শিল্পে কালিহাতীর অবদান

কালিহাতী থানা অঞ্চলে বিবিধ ব্যবসা কারযক্রমের পরিধি দিন দিন বাড়ছেই। যা একটি উপজেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিরও অন্যতম কারণ। এক সময় এখানকার তাতশিল্পগুলো হস্তচালিত যন্ত্রে পরিচালিত হত। কালের বিবর্তনে এখন এই শিল্পটি যন্ত্র শক্তিতে রূপ পেয়েছে। কালিহাতী অঞ্চলের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বল্লা অঞ্চলের তাতের শাড়ি। কারিগরদের হাতের কোমল স্পর্শে উৎপন্ন এই শাড়িগুলো সাড়া দেশে ধনী-গরিব সকলের কাছেই সমানভাবে জনপ্রিয়।

তাছাড়া এই শিল্প মাধ্যমটির কারণেই কালিহাতী থানার শতশত নারী-পুরুষ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে এ উপজেলাতেই রয়েছে বৃহৎ সুতার মিল। এসব সুতা কারখানাতেও কাজ করছে শত শত শ্রমিক। যা উপজেলার অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখছে।

কালিহাতী উপজেলায় ঐতিহাসিক স্থানসমূহ

কালিহাতী উপজেলা জুরে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থান। এককালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান তথা এতিহাসিক রাজবাড়ির অবস্থান ছিলো কালিহাতী থানাধীন বল্লা ইউনিয়নের গাছ চারান গ্রামে। যা এখন সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। তবে রয়েছে সেকালের ইসলামী ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শণ প্রায় ৪শ বছরের প্রাচীণ রাজবাড়ি মসজিদ।

অন্যদিকে এলেঙ্গা বাস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ৭০০ মিটার দুরে রয়েছে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এলেঙ্গা জমিদারবাড়ি।

এছাড়াও কালিহাতী উপজেলার অন্যতম প্রত্নতাত্বিক নিদর্শণ মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত কদিম হামজানি মসজিদ। বংসাই নদীর তীরে অবস্থিত কদিমহামজানি গ্রামে এই মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি স্থাপনা।

সুতরাং ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের জন্য কালিহাতী উপজেলা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

তাছাড়া এলেংগা রিসোর্ট, বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস, কালিহাতি পার্ক ও বঙ্গবন্ধু সেতু রিসোর্ট তো রয়েছেই।

এমন নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ কালিহাতি থানা সীমানাধীন রয়েছে দেশের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

উপজেলার মানুষকে বহুমুখী বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কালিহাতিতে নির্মিত হয়েছে বিশাল পরিসরের একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

বিভিন্ন পেশায় কালিহাতী

কালিহাতী উপজেলার মোট জনসংখ্যা আনুমানিক পাচ লক্ষাধীক। রয়েছে ২টি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন। এছাড়াও রয়েছে একটি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র তথা মগড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্র। সবমিলিয়ে কালীহাতি থানা অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার ব্যপারে তেমন কোন সংশয়ের কারণ নেই। এখানকার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কৃষাণ, দিনমুজুর, ভবঘুরে সাবাই নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করছে নিজেদের মত করে।

 

সর্বপরি কালিহাতী থানা অঞ্চল আইন-শৃংখলার দিকে অত্যান্ত জনবান্ধব, আধুনিক শিক্ষা বান্ধব, উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, মানউন্নিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নমূখি একটি সম্মৃদ্ধ নগরী।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।