maxresdefault 3 1 jpg

নয়নাভিরাম ঘাটাইল

প্রকৃতির অভয়ারণ্যের অন্যতম ভূ-পৃষ্ঠ। ঘন বনাঞ্চল বেষ্ঠিত পাহাড়ি জনপদ। শতশত বর্গ কি.মি. জুড়ে এমন বনায়নের দেখা পাওয়া, এখন বাংলাদেশের জন্য খুবই দুষ্কর। মাঝে মাছে কলার বাগান আর দুএকটি টিনের দোচালা ঘর ছাড়া, যতদুর চোখ যায়, উপরে আকাশ আর নিম্নভুমি অরণ্যের সবুজায়ন। তারই মাঝে পিচঢালাই সড়কে দুরন্ত গতিতে কিছু গাড়ির ছুটে চলা।

দেশের সুনামধন্য টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলা, সত্যিই এ এক ভীষণ সুন্দর নগর। এ নগর পরিক্রমণকালে আপনি মুগ্ধ হবেন বনাঞ্চলের পাখির কিচির মিচির শব্দে। মুগ্ধ হবেন এর ঐতিহাসিক কয়েকটি স্থাপনা দেখেও। আপনাকে আরও অবাক করবে এ নগরের কিছু কাল্পনিক গল্প। একমুহুর্তেই আপনাকে ধাধায় ফেলে দিবে অন্ধবিশ্বাসীদের শতবছরের নিশান। সবমিলিয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার শিহরণ।

 

 

ঘাটাইল নামকরনের ইতিহাস

সবুজ বনায়ন আর লাল মাটির অঞ্চল ঘাটাইল। খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ০.৯০ মিলিয়ন বছর পূর্বে গঠিত এ ঘাটাইল নগরের নামকরণের ইতিহাসে জানা যায় এক সময় এ অঞলের উপর দিয়ে নদীপথে নিয়মিত গুদারা নৌকা চলাচল করতো। সে সময় নৌকা ঘাটে আসা-যাওয়ার জন্য অনেক উঁচু আইল ব্যবহার করতে হতো। ধারণা করা হয়, সেই থেকেই ঘাট ও আইলের মিলিত শব্দে ঘাটাইল নামের উৎপত্তি ঘটে। সে সময় তথা আজ থেকে দেড় শত বছর পূর্বে ঘাটাইল অঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো পার্শবর্তী গোপালপুর থানা থেকে। ১৮৭২ সালে গোপালপুর থানার অধীনে এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। সময়ের ঘুর্ণয়নে ১৯০৬ সালের ১৬ জুন ঘাটাইলকে একটি পূর্ণাঙ্গ থানা ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৮৪ সালে ঘাটাইল থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। পরে ১৯৯৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঘাটাইল শহরের ১১.০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় । উল্লেখ্য, আয়তনের বিচারে ঘাটাইল উপজেলা টাঙ্গাইল জেলার সবচেয়ে বড় অঞ্চল। বর্তমানে এ উপজেলার সীমানা নির্ধারণ রয়েছে ৪৫১.৩০ বর্গ কি.মি. এলাকা জুড়ে। আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। তবে ভোটাধিকার জনবল মাত্র ২,৮৬,২০৭ জন। মোট ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত ঘাটাইল উপজেলার গ্রামের সংখ্যা ৪১১টি।

ঘাটাইলের স্থাপনাসমূহ

২৩টি সরকারি অফিস, ৩টি শায়ত্ব শাষিত অফিস, ১টি থানা, ১টি পুলিশ ফাঁড়ি, ১৬টি ব্যাংক, ২টি সাব রেজিষ্টার অফিস, ৫টি সিনেমা হল ও ১টি অডিটোরিয়াম রয়েছে ঘাটাইল উপজেলায়। মোট ৭০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রায় ২ শত প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪৪টি মাদ্রাসা ও মোট ৭টি মহাবিদ্যালয় অবস্থিত রয়েছে ঘাটাইল উপজেলায়। এছাড়া ঘাটাইল উপজেলার স্বাস্থ্যখাতে রয়েছে ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৭৫টি ছোট-বড় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

 

ঘাটাইলের অর্থনীতি

জেলার সর্ব উত্তরে অবস্থিত টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উভয়পাশে বিস্তৃত এ জনপদের মানুষ প্রধানত কৃষি নির্ভর। তাছাড়া চাকুরি ও ব্যবসা পেশাতেও এখানকার এক চতুর্থাংশ মানুষ জড়িত রয়েছে। উপজেলার ৮৮.৪৫ বর্গ কিঃ মিঃ বনভূমি ব্যতিত অবশিষ্ট অংশ বংশাই নদী বিধৌত সমতল ভূমি হওয়ায় ঘাটাইলের মাটি কৃষি অত্যন্ত কৃষি সহায়ক। এখানকার প্রধান অর্থকরী ফসল ধান, পাট, আঁখ, সরিষা, ড্রাগন, কলা ও আনারস। যার সিংহভাগ পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়ে থাকে। পূর্বের ভূমি জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঘাটাইল উপজেলায় মোট ৩১৫০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। তাছাড়া মৎস্য চাষ, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার, আসবাবপত্রের কারখানা, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প ও ইটভাটাসহ প্রভৃতি এ উপজেলার অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি।

ঘাটাইলের নদীপথ

ঘাটাইলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিনটি শাখা নদী। বংশী, ঝিনাই ও লৌহজং নামের নদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিবছর অঞ্চলের খাল বিলগুলোতে প্রাণের সঞ্চার হয়। এ অঞ্চলের প্রকৃতি ভীষণ সুন্দর। শীত মৌসুমের শুরুতে প্রচুর অতিথি পাখির সমাগম ঘটে ঘাটাইলের হাওর-বাওরে।

ধর্মীয় ইতিহাসে ঘাটাইল

টাঙ্গাঈল জেলা সদর থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. উত্তরের এ অঞ্চলের মানুষ তুলনামুলক ধর্মপরায়ন। শতকরা ৯৫.৪ জন মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এছাড়া ৩.৪% হিন্দু এবং ১.২% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে ঘাটাইল উপজেলায়। উপজেলা জুড়ে রয়েছে ৩৬২টি মসজিদ, ৩০টি মন্দির ও ১টি গির্জা। উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, সাত গম্বুজ বিশিষ্ট ধলাপাড়া জামে মসজিদ, যা ১৯১৭ সালে স্থানীয় জমিদার ছমির উদ্দিন চৌধুরী উপজেলার ধলাপাড়া গ্রামে নির্মাণ করেন। এটি উপজেলার বিশেষ স্থান হিসেবে সুপরিচিত। তাছাড়া ধলাপাড়া গ্রামেই দাঁড়িয়ে রয়েছে শত বছরের ঐতিহাসিক স্থাপনা চৌধুরীবাড়ি। এটি প্রায় ৮ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত উপজেলার একমাত্র শতবর্ষী আলিশান অট্টালিকা। অন্যদিকে উপজেলার সাগরদিঘী ইউনিয়নে রয়েছে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে পাল বংসের রাজার খননকৃত একটি দিঘী।

নৈসর্গিক ঘাটাইল

এই ধলাপাড়া ইউনিয়নেই রয়েছে আরেকটি বিশেষ স্থান হিসেবে খ্যাত যার নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। মুলত বহু প্রাচীন একটি তমালগাছকে কেন্দ্র করেই এটি গড়ে উঠেছে। এই গাছকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষের মুখে প্রচলিত আছে নানান কাল্পনিক ঘটনাবলী।

এছাড়া উপজেলার সাগরদিঘী ইউনিয়নে রয়েছে উপজেলার একমাত্র বৃহত্তম ও প্রকৃতির নৈসর্গিক পরিবেশের বিনোদনকেন্দ্র অনিক নগর পার্ক। এসমস্ত নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে ভ্রমণ করার জন্য একজন পর্যটককে অবশ্যই সর্বনিম্ন তিন দিন সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে। তবেই ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি বনায়ন, বাহারিসব বৃক্ষের সমাহার, রঙ বেরঙের পাখি ও প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। এর মাঝেই চোখে পড়বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৯ পদাতিক ডিভিশনের প্রধান সদর দপ্তর শহীদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস। পাহাড়ি বনাঞ্চলে তাদের রয়েছে কঠিন নজরদারি। তাদের শৃংখলবদ্ধ অনবরত চলাচলে আপনার শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঘাটাইলের অবদান

সবশেষে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কনে ঘাটাইল উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ অঞ্চলটি দখল করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সেসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনী ও খন্দকার আবদুল বাতেন নেতৃত্বাধীন বাতেন বাহিনী। যুদ্ধকালীন ঘাটাইলে মোট ৯টি বড় সংঘর্ষ ও ৩১টি ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়।এসব যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৪৪ জন সদস্য শহীদ হন। তাদের জীবনের বিনিময়েই ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ঘাটাইলকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। তাদের স্মৃতি স্মরণে ঘাটাইল থানা প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে একটি শহীদ মিনার।

কীর্তিমানের ঘাটাইল

ঘাটাইল উপজেলার মাটিতে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন বহু কীর্তিপুরুষ। তার মধ্যে বিশিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি মুক্তিযোদ্ধা জনাব শামছুর রহমান, বীরবিক্রম খোরশেদ আলম, বীর প্রতিক ফজলুর রহমান, বিশিষ্ট নাট্যভিনেতা মামুনুর রশিদ, শহিদুজ্জামান সেলিম অন্যতম।

সর্বোপরি, ঘাটাইল উপজেলা, নামে, সুনামে, গুণে ও সৌন্দর্যে একটি প্রসিদ্ধ উপজেলা। দিন দিন অর্থনীতির মানদন্ডে দেশের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য একটি উপজেলা হিসেবেই গড়ে উঠছে। যেমনি ভাবে সম্মৃদ্ধ হচ্ছে এখানকার শিল্পায়ন, তেমনিভাবে এগিয়ে চলেছে উপজেলার যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।