Chandina Thana

চান্দিনা…কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত একটি বিশেষ থানা অঞ্চল। এ এলাকার নামকরনের পেছনে রয়েছে রোমাঞ্চকর কল্পকাহিনী। জানা যায়, ১৬৭৫ সালে মির্জা হোসেন আলী খাঁ, মোঘল সুবাদার নিযুক্ত হয়ে বর্তমান চান্দিনায় সদর দপ্তর স্থাপনা করেন। সে সময় এ অঞ্চলের নাম ছিলো বরকামতা। এ স্থানটি বনাঞ্চলে ঘেরা থাকায় বাঘের ভয়ে সবাই আতঙ্কিত থাকতো। সুবাদার হোসেন আলী খাঁ বাঘকে ভয় দেখাতে উঁচু স্থানে গিয়ে গ্যাসের বাতি জ্বালাতেন। তাই স্থানীয় লোকজন এ জায়গাটিকে চাঁদনী বা চাঁদের আলোর ভিটা হিসেবে বলাবলি করতো। পরবর্তীতে, ইংরেজ শাসনামলে, নীলকুঠি সাহেবরা এ অঞ্চলটিকে চান্দিনা বলে আখ্যায়িত করলে এ নামেই পরিচিতি লাভ করে।

 

 

ইতিহাস বিজড়িত এ অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলার মানে এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক তথা ৬১তম উপ মহা-পরিদর্শক নুরেআলম মিনা ডিআইজি পদে যোগদানের পর থেকেই কুমিল্লা জেলাকে অপরাধমুক্ত রাখতে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলেছেন। তাঁরই নেতৃত্বে কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন আব্দুল মান্নান বিপিএম বার। তিনি তাঁর কর্মপরায়ণতায় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাঁর যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও নৈতিকতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই নিবিড় তত্ত্বাবধানে কাজ যাচ্ছে দাউদকান্দি সার্কেল তথা চান্দিনা থানা পুলিশ। তাদের নিয়ন্ত্রনে কেমন আছে থানাবাসী? এ অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি, সমসাময়িক চিত্র, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্রময় অঞ্চল,প্রাচীন ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের সবুজ সংকেত – চান্দিনা থানা।

ঢাকা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পূর্বাংশে এবং কুমিল্লা জেলা সদর হতে ২৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল চান্দিনা। ১টি পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চান্দিনা  থানা অঞ্চলের মোট আয়তন ২০২ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এর জনসংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। ইউনিয়ন সমূহ হলোঃ সুহিলপুর, বাতাঘাসী, মাধাইয়া, মহিচাইল, কেরণখাল, বাড়েরা, এতবারপুর, বরকইট, মাইজখোর, গল্লাই, দোল্লাই নবাবপুর, বরকরই এবং জোয়াগ ইউনিয়ন। এ থানা অঞ্চলের পূর্ব দিকে, বুড়িচং, বরুড়া ও কুমিল্লা আদর্শ উপজেলা, পশ্চিমে দাউদকান্দি ও চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলা, উত্তরে দাউদকান্দি, মুরাদনগর ও দেবিদ্বার উপজেলা এবং দক্ষিণে বরুড়া ও কচুয়া উপজেলা অবস্থিত।

চান্দিনা থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৮৭৬ সালে অতঃপর ১৯৮৩ সালে তা উপজেলায় উন্নীত হয়। এ অঞ্চলের জনমানুষদের সার্বিক আইনি সেবা প্রদানে দাউদকান্দি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এনায়েত কবীর সোয়েব ও তাঁর আওতাধীন অঞ্চল চান্দিনা  থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন আহাম্মদ মনজুর মোরশেদ। তারা তাদের কর্মতৎপরতা ও থানা অঞ্চলের জনমানুষের বৈশিষ্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেন পজিটিভ থিংকের ক্যামেরায়।

চান্দিনার কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় ভোরের পাখির ডাকে। গ্রামীণ কৃষকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন ফসলী জমিতে কিংবা পশুপালনে, ঠিক তেমনি শহুরে জনপদের ছুটে চলা শুরু হয় জীবিকার পানে…

১৯৭১ সালের রক্তঝড়া দিনগুলিতে চান্দিনার অকুতোভয় যোদ্ধাদের ছিলো সক্রিয় ভূমিকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অপারেশনে দিশেহারা হয়ে যায় পাকসেনারা। ১১ ডিসেম্বর তারা পালিয়ে যেতে শুরু করলে, ঘিরে ফেলে মুক্তিসেনার দল। অতর্কিত আক্রমনে ধূলিসাৎ হয় পাকবাহিনীরা। অতঃপর ১২ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় এ অঞ্চল। তাদের এ বীরত্বের স্মৃতি আজীবন স্মরণ রাখতে নির্মিত হয়েছে, ২টি বধ্যভূমি ও ৩টি গনকবর।

বর্তমানে বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে চান্দিনা থানা অঞ্চল। এ অঞ্চলে মোট শিক্ষার হার, ৫১ শতাংশ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ৫টি কলেজ, ৩২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং প্রায় ৫০টি মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছে

আইন ও সুশাসনের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় এ অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। ঢাকা-চট্রগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের কল্যাণে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। রয়েছে মোট ১২৩ কিলোমিটার পাঁকা রাস্তা, ২৪০ টি কালভার্ট সহ অভ্যন্তরীণ সড়কপথ। তবে, কিছু দুর্গম এলাকায় রাস্তাঘাটের উন্নতি চলমান রয়েছে। যাতায়াতে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হলেও জনগনের দোরগোড়ায় আইনি সেবা পৌঁছে দিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে চান্দিনা  থানা পুলিশ।

পুলিশি কর্মতৎপরতায় এ অঞ্চলের পেশাজীবীদের জীবনমানে এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। এ জনপদের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি। অর্থকরী ফসল উৎপাদনের বাইরেও শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন হয় এ অঞ্চলে। এছাড়া মৎস্য খামার, হাঁস মুরগির খামার ও গবাদিপশু পালন করে থাকে কৃষকেরা যা, চান্দিনা হাট ও নবাবপুর হাট সহ প্রায় ২৯টি হাটবাজারে বাজারজাত হয়। তবে ব্যতিক্রমী হিসেবে চান্দিনার ঐতিহ্যবাহী খাদি দেশ-বিদেশে প্রচুর সুনাম অর্জন করছে । বরকামতা ইউনিয়নের কাঠের পুল এলাকা সহ চান্দিনার বিভিন্ন জায়গায় খাদি কাপড় তৈরি হয়। তাছাড়া কুটিরশিল্পে বাঁশ ও বেতের কাজ, মৃৎশিল্পের ব্যপক প্রচল রয়েছে এ অঞ্চলে। এসবের বাইরে, ব্যবসা, চাকরি সহ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে চান্দিনাবাসী

তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে রয়েছে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১২টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র সহ ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তাছাড়া, গবাদিপশুর চিকিৎসায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল রয়েছে।  

চান্দিনার কৃতী সন্তান হয়ে আছেন একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক ও লেখক আলী জাফর ওয়াজেদ। জন্মগ্রহন করেন বীর মুক্তিযুদ্ধা, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও সাংসদ ডা. প্রান গোপাল দত্ত।

রয়েছে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন চান্দিনা প্রেস ক্লাব এবং দৈনিক চান্দিনার সময় সহ বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল।

এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তৎকালীন কুমিল্লা ও ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার ভৈরব সিংহের জমিদারবাড়ী। মহিচাইল ইউনিয়নে অবস্থিত এ বাড়িটির সুন্দর কারুকার্য আর সমাধিস্থল আজও মুগ্ধ করে পর্যটকদের।দর্শনার্থীদের আরো বিমোহিত করে জলজ উদ্ভিদের মায়াবী হাতছানি ঘুরঘার বিল। প্রায় ১শ একর জুড়ে বিস্তৃত এ বিলের লাল-সাদা শাপলা ফুলের পরশ ও স্নিগ্ধ জলরাশি যে কাউকে অবাক করবে। বর্ষাকালে এই বিলের প্রায় ৫০ এরও বেশি দেশি প্রজাতির মাছ আহরনে মেতে উঠে স্থানীয়রা। ঘুরঘার বিলের এ জীববৈচিত্র দেখতে সারা বছরই ভীর করে দেশ-বিদেশের নানা পর্যটক।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।