Daudkandi

ছবির মতো সাজানো দিগন্তবিস্তৃত মাঠজুড়ে হলুদ সরিষার প্রাণান্তকর আলিঙ্গন মেঘনা ও গোমতী নদীর অববাহিকায় গড়া বিচিত্র চিত্রপটে রাঙা এই জনপদটির নাম দাউদকান্দি। এ অঞ্চলের নামকরণে রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। ১৫৬৪ সালে সোলেমান কররানী মুঘল সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ খান কররানী ক্ষমতায় আসলে তার নামানুসারেই এ অঞ্চলটি লোকমুখে দাউদকান্দি নামে পরিচিতি লাভ করে।

ঐতিহাসিক এ অঞ্চলটি ১৮৫৮ সালে থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে যা পরবর্তীতে উপজেলায় উন্নীত হয়। চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক জনাব নুরেআলম মিনার একনিষ্ঠ কর্মদক্ষতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে;  কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন আব্দুল মান্নান বিপিএম বার। তিনি তাঁর কর্মপরায়ণতায় অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাঁর যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও নৈতিকতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই নিবিড় তত্ত্বাবধানে দাউদকান্দি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার এনায়েত কবীর সোয়েব এর আওতাধীন অঞ্চল দাউদকান্দি মডেল থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন মোঃ মোজাম্মেল হক। তাদের নিয়ন্ত্রনে কেমন আছে থানাবাসী? অপরাধ রোধে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে দাউদকান্দি মডেল থানা পুলিশ? এসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর নিয়ে সবুজ সংকেতের আজকের আয়োজনে থাকছে অপরাধের ধরন, বৈচিত্রময় অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সহ সকল বিষয়াদি নিয়ে আজকের সবুজ সংকেত – দাউদকান্দি মডেল থানা।

ঢাকা থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং কুমিল্লা জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি জনবহুল এলাকা দাউদকান্দি। ১ টি পৌরসভা ও ১৫ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত দাউদকান্দি মডেল থানা অঞ্চলের প্রায় ২১০ দশমিক ২১ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ডে বসবাস করেন সাড়ে ৩ লক্ষ মানুষ। ইউনিয়নসমূহ হলো: উত্তর দাউদকান্দি, সুন্দলপুর, বারপাড়া, গৌরীপুর, জিংলাতলী, উত্তর ইলিয়টগঞ্জ, দক্ষিণ ইলিয়টগঞ্জ, মালিগাঁও, মোহাম্মাদপুর পশ্চিম, মারুকা, বিটেশ্বর, গোয়ালমারী, পদুয়া, পশ্চিম পাঁচগাছিয়া ও দৌলতপুর। এ অঞ্চলের পূর্বদিকে চান্দিনা উপজেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী, চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলা, উত্তরে মেঘনা উপজেলা ও তিতাস উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলা অবস্থিত।

নদীমাতৃক এ অঞ্চলের জনজীবন শুরু হয় সকাল থেকেই। দেখা মেলে দাউদকান্দি ট্রলার ঘাটে শত মানুষের বালু উত্তোলনের দৃশ্য। কেউ বা ফসলী মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সোনালী ধানের ফলনে আবার কেউ কেউ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটে চলে শহরের অলিগলি…।

একাত্তরের কালজয়ী মুক্তিযুদ্ধে দাউদকান্দি অঞ্চলের রয়েছে এক মহিমান্বিত ইতিহাস। সে বছরের ২০শে নভেম্বর ঈদের দিনে হঠাৎ মর্টার সেলের বিকট শব্দে জেগে উঠে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙ্গালী। তবুও দাউদকান্দির স্থানীয় মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা দমে না গিয়ে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। প্রায় ১৫ ঘণ্টার সম্মুখযুদ্ধের পর বিজয়ী হন মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন হানাদারদের প্রায় ৭০ জন সৈন্য নিহত হয়। এভাবে ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগে শক্রমুক্ত হয় দাউদকান্দি। মহান স্বাধীনতার অসামান্য এই স্মৃতিকে অম্লান রাখতে নির্মিত হয়েছে “মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ও পাঠাগার” এবং গোয়ালমারী সীমানা প্রাচীর সহ কয়েকটি বধ্যভূমি।

বিপুল জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে দাউদকান্দি মডেল থানা অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ জনপদে প্রায় ১৯০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রায় ৯৩ টি নার্সারি স্কুল, প্রায় ৪৪ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬ টি কলেজ ও ৩২ টি মাদ্রাসা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সর্বদা সোচ্চার রয়েছে দাউদকান্দি মডেল থানা পুলিশ।

ঢাকা থেকে কুমিল্লার প্রবেশদ্বার এই দাউদকান্দি। ফলে, যোগাযোগ খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষণীয় এ অঞ্চলে। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কল্যাণে খুব সহজেই দাউদকান্দি থেকে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে পারে জনসাধারণ। এ সড়কের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে হাইওয়ে পুলিশ। (বাইট আছে দিতে পারেন) অভ্যন্তরীন যোগাযোগে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পাকারাস্তা ও ৪০ কিলোমিটার আধা-পাকারাস্তা রয়েছে যা জনসাধারণের চলার পথকে সহজ করছে। তবে দাউদকান্দি উত্তর, পদুয়া ও পাঁচগাছিয়া এই ৩ টি ইউনিয়নের রাস্তাঘাট এখনো বেশ দুর্গম। যাতায়াতে কিছুটা বেগ পেতে হলেও এসব এলাকায় দাউদকান্দি মডেল থানা পুলিশ জনবান্ধব আইনী সেবা পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, অচিরেই এসব রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কার্যক্রম সাধিত হবে বলে প্রত্যাশা করছে এলাকার জনসাধারণ।

আইন শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রনে থাকায় এবং ভৌগোলিক অবস্থার কারণে বেশ স্বাবলম্বী হয়েছে দাউদকান্দি থানা অঞ্চলের মানুষ। উর্বর মাটি ও উন্নত সেচ ব্যবস্থা এ অঞ্চলের কৃষিখাতে ব্যাপক সাফল্য এনেছে। অর্থকরী ফসল ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে শাকসবজিও উৎপাদিত হতে দেখা যায় এ অঞ্চলে। এ অঞ্চলের যে জমি দেয় ধানের যোগান, সে জমিই আবার হয়ে উঠে অফুরন্ত মাছের ভান্ডার। ইতোমধ্যেই ‘দাউদকান্দি মডেল’ নামে খ্যাত অঞ্চলটির প্লাবন ভূমিতে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর মাছ চাষের কারণে সারাদেশে বিপ্লব ঘটেছে। সরকারি জরিপ অনুসারে, গ্রাম পর্যায়ে প্রায় ২৩৩ টি হাস-মুরগি’র খামার ও প্রায় ৯৭ টি গবাদিপশুর খামার রয়েছে। এমনকি বাণিজ্যিকভাবে আম, জাম, পেয়ারা ও বাঙ্গিসহ অনেক ফল-ফলাদি চাষ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে এ থানা অঞ্চলের মানুষ।

থানাবাসীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে ১ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩ টি হাসপাতাল, ১৫ টি ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ৯ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ গবাদিপশুর চিকিৎসায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল রয়েছে।

এখানেই জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৯৫২ এর ভাষাসৈনিক এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর জসিম উদ্দিন আহমেদ। একুশে পদকপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জন্মস্থানও এই দাউদকান্দি থানা অঞ্চল। দাউদকান্দির গোমতী ও মেঘনা নদী তীরবর্তী প্রাকৃতিক দৃশ্য মুগ্ধ করে অনেককেই। তাছাড়া শিশু কিশোরদের খেলাধুলার জন্য যারিফ আলী শিশু পার্ক রয়েছে। এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে দাউদকান্দি নিউজ সহ বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টাল এবং সাংবাদিকদের সংগঠন দাউদকান্দি প্রেস ক্লাব রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।