Sobuj Songket Thumbnail Template do not delete 1 jpg

বাংলাদেশ নদী বিধৌত এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। বলা হয়, শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০ টি নদ-নদীর বিপুল জলরাশি বাংলাদেশের ২২,১৫৫ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরমধ্যে কিছু নদী আকার এবং গুরুত্বে বিশাল। এসব নদীকে বড় নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যার একটি নাম “যমুনা”। যার প্রবল স্রোতের সাক্ষী দেশের অগনিত মানুষ।

কিন্তু এক কালের সেই খরস্রোতা যমুনার অংশবিশেষ এখন চর সাদৃশ্য জনপদ।  তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে প্রাণহীন এক মরুভূমির পিঠ। যেন যমুনা এখন মরুভূমি; ধু-ধু বালুচর।  দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে যমুনায় এখন আর পাল তোলা নৌকা অথবা লঞ্চ-স্টিমার চলেনা বললেই চলে। পালতোলা নৌকার বদলে এখন যমুনার বুকে চলাচল করে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, আর ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল, নছিমন অথবা ভটভটি।  এমনই একটি জনপদের জীবনচিত্র নিয়েই পজিটিভ থিংক নির্মাণ করেছে আজকের প্রামাণ্যচিত্রটি।

আজকের পর্বে থাকছে সিরাজগঞ্জ জেলার সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত যমুনা নদী বিধৌত প্রাচীন থানা অঞ্চল চৌহালী উপজেলা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বিবরণ।

 

 

চৌহালি উপজেলা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা যা ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত।  ইউনিয়নগুলো হলো, সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়ন ,স্থল ইউনিয়ন, ঘোরজান ইউনিয়ন,উমারপুর ইউনিয়ন, খাষকাউলিয়া ইউনিয়ন, খাসপুকুরিয়া ইউনিয়ন এবং বাঘুটিয়া ইউনিয়ন।চৌহালির ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে খাষকাউলিয়া ইউনিয়নকে উপজেলা সদর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৭ সালে বৃহত্তর মিরকুটিয়া ইউনিয়নকে ভেঙ্গে খাষকাউলিয়া ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও ২০১৪ সালে উপজেলা সদরসহ এ ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ এলাকা যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। চৌহালির মোট আয়তন ২১০ বর্গ কি.মি.।  রয়েছে ১টি পৌরসভা, ১৩১টি গ্রাম ও ১০০টি মৌজা।  এক সময় এর আয়তন সীমানা আরোও দীর্ঘ ছিলো। পরে চৌহালীর প্রায় ৩৫ বর্গ কি.মি. এলাকা পার্শবর্তী অন্যান্য উপজেলার সাথে যুক্ত হয়। এর উত্তরে বেলকুচি ও পশ্চিমে শাহজাদপুর উপজেলা।দক্ষিণে পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা ও মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলা এবং পূর্বে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলা সীমানা অবস্থিত।

চৌহালীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামল তথা ১৮৮৮ সালে চৌহালিতে প্রথমে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা যা ১৯০৪ সালে থানায় উন্নীত করা হয় । এর দীর্ঘকাল পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৮৪ সালে সিরাজগঞ্জকে আলাদা জেলায় উন্নীত করা হয় এবং একইসাথে চৌহালি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে চৌহালী উপজেলার নামকরণে রয়েছে একটি চমৎকার গল্প, বলা হয় বর্তমান স্থল ইউনিয়নের চৌয়াইল নামক মৌজায় পাকরাশি জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত একটি বাজার ছিলো। বাজারে চার কেজি দুধ একসাথে এক কেজি হিসেবে বিক্রি হত। এ দেশে চার সংখ্যার পন্যকে একসাথে মিলিয়ে হালি হিসেবে বিক্রি করা হয় বলে লোকমুখে চৌহালী নামের উৎপত্তি হয়। কালক্রমে সেই নামটিই এখন একটি উপজেলা মানচিত্রে ঘোষিত হয়েছে।

 

চৌহালি একটি চরাঞ্চল এলাকা। চৌহালি সীমানার প্রায় ৮০ ভাগ ভূমি যমুনা নদীর চর।

যার ফলে বন্যা মৌসুমে, যমুনা নদীর ভাঙ্গনে উপজেলার স্থলভাগ প্রায়শই নদীতে বিলীন হয়ে যায়।  সর্বশেষ ২০১৪ সালে উপজেলার স্থলভাগের প্রায় ১০ ভাগ যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। সে বছর চৌহালি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সসহ আরো অনেক প্রশাসনিক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় সেগুলো স্থানান্তর করা হয়। তছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ, সরকারি-বেসরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেশ কয়েকবার করে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব কারণে চৌহালি উপজেলাটি দেশের মানুষের কাছে প্রবল বন্যা দুর্গত এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর পানি যখন হ্রাস পায়, তখন নদী বক্ষে জেগে উঠে অসংখ্য চর-ডুবোচর। তখন খেয়ালি এই নদীর গতিপথ বোঝা বড়ই দুষ্কর হয়ে হঠে।বর্তমানে যমুনা তার খেই হারিয়ে নানা শাখা-প্রশাখা, আর চর-ডুবোচরে নিজেকে প্রকাশ করছে।  যারা সারা বছর প্রকৃতির বিচিত্র লিলা-খেলা দেখতে পছন্ন করেন তারা চৌহালি উপজেলায় ভ্রমণ করলে ভোগ করতে পারবেন প্রকৃতির আসল স্বাদ। ঋতুর দেশ বাংলাদেশে কতরূপ যে ছড়িয়ে আছে? তার সবটুকো দেখা মিলবে চৌহালির চরাঞ্চলে।  তাছাড়াও চৌহালিতে রয়েছে যমুনা নদীর পাড় ও নদী রক্ষা বাধ।

যমুনা নদী চৌহালী উপজেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত।উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন যথা খাসকাউলিয়া, বাগুটিয়া, উমরপুর, খাসপুকুরিয়া ও ঘোড়জান এবং পশ্চিম পারে সোদিয়া ও চাঁদপুর নামে দুটি ইউনিয়ন।

চৌহালি উপজেলার প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম নৌপথ। উপজেলার এক ইউনিয়ন থেকে অপর ইউনিয়নে যেতেও স্থানীয়রা নৌকা ব্যবহার করেন।  এ উপজেলায় মাত্র ৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা রয়েছে। উপজেলার পূর্বাংশের সাথে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের সাথে এ উপজেলার সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু নেই।  তবে সিরাজগঞ্জ সদর থেকে সিরাজগঞ্জ-এনায়েতপুর সড়ক হয়ে নৌকাঘাট ব্যবহার করে উপজেলা সদরে যাতায়াত করা যায়।  সে হিসেবে সিরাজগঞ্জ সদর থেকে এর চৌহালি উপজেলার দুরত্ব দারায় প্রায় ৯০ কি.মি.।

সব মিলিয়ে বলা যায় প্রকৃতির বিচিত্র লিলার সাথে তাল মিলিয়ে জীবন নির্বাহ করে এখানকার প্রায় ২ লক্ষ মানুষ।  এই বিপুল সংখ্যাক মানুষের ৯৯.৫ শতাংশই মুসলিম ধর্মালম্বী।  আর হিন্দু ধর্মালম্বীর সংখ্যা মাত্র ০.৫ শতাংশ। মোট জনসংখ্যার সিংহভাগই কৃষি পেশার সাথে জড়িত। চীনাবাদাম, রসুন, পেয়াজ, ধান, পাট, গম, তিল এবং শাকসবজি চৌহালির প্রধাণ কৃষি ফসল । পরিসংখ্যান মতে চৌহালির চাষযোগ্য কৃষি ভূমির পরিমাণ মোট ৭২৫০.৭৬ হেক্টর।

ব্রিটিশ শাসনামলে অঞ্চলটি অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া একসময় তাঁত শিল্প ও চুড়ির ব্যবসার জন্য চৌহালি এলাকাটি খুবই বিখ্যাত ছিল। কিন্তু আজ সেসব শুধুই অতীতের গল্প। বর্তমানে চৌহালিতে প্রায় ২০ হাজার তাঁত রয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছু পরিবার মৎস ও পশু খামারের ব্যবসায় জরিত।

চৌহালি অঞ্চলে অপুষ্টি, পরিবেশগত স্যানিটেশন সমস্যা, ডায়াবেটিস, সংক্রামক রোগ প্রভৃতি বেশি দেখা যায়।  তুলনামুলক দারিদ্রহার বেশি থাকায় চৌহালিতে মানসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা কম।  যদিও দিন বদলের সাথে সাথে এ পরিবেশ এখন বদলাতে চলেছে।

তাছাড়া পূর্বের জরিপ অনুযায়ী শিক্ষার হারেও অনেক পিছিয়ে ছিলো উপজেলাটি। বর্তমানে বেশ উন্নীত হয়েছে শিক্ষার মান।

চৌহালির অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য প্রতিষ্ঠিত আছে মোট ১৫টি ব্যাংক শাখা এবং ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সরকারি সেবা দপ্তরসমুহের প্রায় সকল শাখাই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এ জনপদে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।