kahalu jpg

সময় পাল্টেছে! এখন গ্রাম বা শহর প্রতিটি বাড়িতেই বৈদ্যুতিক ব্যবহার শুরু হয়েছে। তাই আরাম-আয়েশ, গল্প-গুজব বা ঘুম! সবকিছুই নিজ ঘরের চার দেয়ালের মাঝে। এমন চিত্র এখন সারাদেশেরই। কিন্তু আজকের গল্পটি ছিলো বগুড়া জেলার অন্যতম প্রাচীণ ও ঐতিহাসিক জনপদ কাহালু উপজেলাকে ঘিরে।

কাহালু অঞ্চল প্রশাসনিক থানা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো ১৯২৮ সালে, যা ১৯৮৩ সালে উপজেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছে।

খ্রীষ্ট্রপূর্ব হাজার বছরের প্রাচীন এ জনপদটির ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তসহ এর বর্তমান অবকাঠামো, মানুষের জীবনমান, শিক্ষা, অর্থনীতি ও আইন-শৃংখলা বিষয়ক বাস্তবিক চিত্রায়ন নিয়েই সাজানো হয়েছে সবুজ সংকেত এর আজকের পর্ব।

 

 

দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা থেকে ১৮৮ কি.মি. উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ঐতিহাসিক একটি জেলা বগুড়া। এই বগুড়া জেলা যে কয়টি প্রশাসনিক অঞ্চল দ্বারা গঠিত তার মধ্যে একটি অন্যতম অঞ্চল হলো “কাহালু উপজেলা”।

ঠিক কোন কাল থেকে এ জনপদটি মানুষের বসবাসের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলো, তার সঠিক কোন ইতিহাস পর্যালোচনা এখনো হয়নি। তবে এ ভূ-খন্ডের কিছু প্রাচীন নিদর্শন দেখলে মনে হয়, এটি হাজার কাল আগে থেকেই একটি সভ্য জাতীর বসবাস স্থল ছিলো। কাহালু সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ যতটুকো ধারণা পোষন করেন তা হলো, তৎকালীন দরবেশ গাজী জিয়া উদ্দীন সাহেবের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হযরত শাহ সুফী সৈয়দ কালু নামের এক ধর্ম জাযক এ অঞ্চলে এসে অঞ্চলের পথভ্রষ্ট মানুষকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করতে থাকেন। তার সুকৌশল এবং মানুষের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। পরে তার মৃত্যুর পর স্থানীরা উক্ত দরবেশের নাম অনুসারে এলাকাটিকে কালু নামে সম্মোধন করতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় কালু নাম থেকে কাহালু নামে পরিবর্তন ঘটে এবং দুরদূরান্তের মানুষের মুখে এ নামেই পরিচিতি পায়।

ব্রিটিশ শাসনামলে বগুড়া জেলা বিভিন্ন পরগনায় বিভক্ত ছিলো। সে সময় কাহালু এলাকাটি সৈয়দ তোরাব আলী চৌধুরীর জমিদারি পরগনার একটি অংশ ছিলো। জমিদার তোরাব আলী চৌধুরীর রাজকার্য পরিচালিত হতো কাহালুর মুরইল গ্রামে জমিদার বাড়ি থেকে। জমিদার বাড়ির সেই আদি রূপ এখন বিলুপ্তির পথে। জীর্ণ দশায় পড়ে থাকা এই বাড়ীর পশ্চিম পাশে রঙ্গিণ পাতায় দাড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৪শত বছরের একটি প্রাচীন গাছ। এ গাছটি স্থানীদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। যার কোন ফুল বা ফল নেই। দেখতে কিন্তু মোটেও প্রাচীন নয়! একদম শান্ত প্রকৃতির সাধারণ আকৃতির গাছের মতই। এর অবস্থান কাহালু উপজেলা সদর থেকে ৬ কি.মি. দুরত্বে উপজেলা মানচিত্রের পূর্ব সীমান্তের ৫নং মুরইল ইউনিয়নে।

জমিদারি আমলে এ অঞ্চলের মানুষকে সবচেয়ে সুখি মানুষ বলা হতো। হয়তো এখনো সুখি! কিন্তু সময়ের আদলে পাল্টে যায় অনেক কিছুই। শুধু মুরইল ইউনিয়ন নয়, বরং পুরো কাহালু উপজেলা জুড়েই পাল্টে গেছে প্রকৃতির রূপ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও  মানুষের জীবনমান। একসময় কাহালুর বসতি ঘরগুলো ছিলো মাটির নির্মিত একতলা-দোতলা বিশিষ্ট। কিন্তু সেই চিত্র আর খুব চোখে পড়ে না। আজ মাটির ঘরের পরিবর্তে তৈরি হয়েছে ইট-পাথরের উচু নিচু শত শত স্থাপনা।

প্রাচীন আমলের যে ঘরগুলো, রাতের বেলা মাটির প্রদ্বীপে সামান্য আলো পেত, আজ সে ঘরগুলোই বৈদ্যুতিক আলোতে ঝলমলে। তার মানে! সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। সেই হিসাবের পাল্লায় একটি বড় ভুমিকা পালন করে কাহালুর অর্থনীতি। দিন বদলের পালায় কাহালুতে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০টি বৃহৎ শিল্প-কারখানা।

 

কাহালুতে গড়ে উঠে পেপার মিল, সুতার মিল, জুট মিল, এগ্রো, ফিড, ব্যাগ এবং নেট কারখানার মত বড় বড় কারখানা সহ প্রায় ২শ এর অধিক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।

ফলে কাহালুকে শিল্প নির্ভর অঞ্চল বললে ভুল হবে না। তবে প্রকৃত পক্ষে কাহালু উপজেলা একটি কৃষি প্রধান জনপদ।

কাহালু উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, আলু, সরিষা ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হয়ে থাকে। তাছাড়া উপজেলা সদর এলাকাসহ উপজেলার হাজার অধিক ছোট বড় পুকুর গুলোতে বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করা হয়।

এই উপজেলাতে কয়েকটি বড় বড় হাট ও বাজার রয়েছে। সাপ্তাহিক বিভিন্ন দিনে উপজেলার মোট ২২টি হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। আর স্থানীয় বাজারগুলো রাতের বেলা ব্যতিত প্রায় সব সময়ই ক্রেতা বিক্রেতার ভিরে প্রাণবন্ত থাকে। এসব বাজারে প্রায় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উপজেলার অনেক গ্রামে পারিবারিক ও বাণিজ্যিক ভাবে গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী, কবুতরসহ নানা জাতের পাখি লালন পালন করা হচ্ছে। যা উপজেলার অর্থনীতিকে আরও বেশি সম্মৃদ্ধ করে তুলছে।

 

কাহালু উপজেলাতে তৈরি হয় তালপাতার বিভিন্ন হাতপাখা। দেশের সিংহভাগ হাতপাখার জোগান দেয় এখানকার তৈরি তালপাতার হাতপাখা। কাহালু উপজেলার হাতপাখার আলাদা কদর রয়েছে দেশজুড়ে।  গরমের শুরু থেকেই দেশে তালপাতার এই হাতপাখার কদর বাড়তে থাকে।

কাহালু উপজেলাকে বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও ব্যবসায়িক জনপদ হিসেবে ধরা হয়। বগুড়া জেলা সদর থেকে মাত্র ১২ কি.মি. পশ্চিমে ২৩৮.৭৯ বর্গকিমি আয়তন নিয়ে বিস্তৃত কাহালু উপজেলাটি মোট ১০টি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত।

উপজেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ৬.৮৩ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট, ৯টি ওয়ার্ডের সমন্বয়ে গঠিত জনপদটি কাহালু পৌরসভা। পৌর এলাকা ব্যতিত উপজেলার মোট ২৭১ টি গ্রামকে ৯টি ইউনিয়নে বিভক্ত করা হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হলো বীরকেদার, কালাই, পাইকড় , নারহট্ট, কাহালু, মুরইল, দুর্গাপুর, জামগ্রাম ও মালঞ্চা ইউনিয়ন।

কাহালু উপজেলা দিনে দিনে নগরায়িত হচ্ছে। মানুষ এখন যেমনি নৈসর্গিক গ্রামীন প্রকৃতিকে ভালোবাসে তেমনি পছন্ন করে বর্তমান আধুকায়নের ইট-ইমারতের ভবনে বাস করতে। শুধু বসবাস নয় বরং বিবিধ অফিস-আদালত বা সরকারি স্থাপনাগুলো এসব আধুনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি। সে দিক থেকে কাহালু আর পিছিয়ে নেই।

অর্থাৎ নগরীর একদিকে গড়ে উঠছে উচু-নীচু ইট-ইমারতের ভবন আরেক দিকের মানুষ এখনো ধরে রেখেছে ঐহিত্যের প্রিয় বাসস্থান মাটির ঘর।

উপজেলার পৌর এলাকা ব্যতিত ৯টি ইউনিয়নেই রয়েছে সবুজ রঙয়ে আচ্ছাদিত দৃষ্টিনন্দন কৃষি ক্ষেত। সাড়ি সাড়ি বৃক্ষের ছায়া প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে মেঠো বা পিচঢালাই সড়ক পথ। আর ছোট ছোট গ্রামীণ বসতির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্যা খাল-বিল।

উপজেলার পশ্চিম সীমান্ত ঘেসে বয়ে গেছে কাহালুর একমাত্র নদী “নাগর”। যা উপজেলার জীববৈচিত্রকে আর সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে।

এ উপজেলা উপর দিয়ে চলমান রয়েছে একটি রেল পথ ও একটি আন্তজেলা মহাসড়ক। যা উপজেলাকে দেশের সাথে সহজ যোগাযোগ রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি কাহালু উপজেলা আজ আর পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্য খাতেও। কাহালু উপজেলায় যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত নানা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। গড়ে উঠেছে ব্যাংক-বীমা, এনজিও, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, বাংলাদেশ বেতার বিভাগ, স্বাধীনতা কমপ্লেক্স, কৃষি অফিস, ভুমি অফিসসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় স্থাপনা। এসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় কাহালু উপজেলা, দিন দিন একটি উন্নত নগরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

এ কারণে কাহালু উপজেলা বর্তমানে বগুড়া জেলার অন্যতম বিশেষ নগরী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। তাছাড়া এ উপজেলায় রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্যের নানা বিশেষায়িত নিদর্শন। মুরইল ইউনিয়নে অবস্থিত অচিন গাছ, এবং মুরইল জমিদার বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পাইকড় ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহাসিক যোগীর ভবনের মন্দির এবং দধি সাগর, উপজেলা সদরে অবস্থিত কালু পীরের মাজার এবং হযরত সৈয়দ মোকাররম কালিমি চিশতী গরীর নওয়াজ দিল্লীওয়ালার মাজার, কাহালু বাজারের পশ্চিমে অবস্থিত জমিদার বাড়ীর নট মন্দির, নারহট্ট ইউনিয়নে অবস্থিত দরগাহাট সুলতানের মাজার, দূর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত পাঁচপীর মাজার, এবং দূর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত সতীকন্যা সাহেবানীর মাজার কাহালু উপজেলার অন্যতম বিশেষ স্থান।

যা কাহালুকে দেশের মানুষের কাছে বিশেষ ভাবে পরিচয় তুলে ধরে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধেও কাহালুর অবদান সর্ব গৃহিত। রণাঙ্গণের দীর্ঘ নয় মাস অতিক্রম করে কাহালুকে ১৩ ডিসেম্বর শত্রমুক্ত হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছিলো।সেই থেকে প্রতি বছর ১৩ ডিসেম্বর দিনটিকে ‘‘কাহালু হানাদার মুক্ত দিবস’’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। যার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কাহালু উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হোসেন আলী। কাহালুবাসীর অন্তরে এ নাম চিরকালই অমর থাকবে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।