Dhubaura

ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫৪ কি.মি. উত্তরের পাহাড়ি ও সমতল এলাকা নিয়ে গঠিত একটি উপজেলা যার নাম ধোবাউড়া। ধোবাউড়া উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ফুলপুর উপজেলা ও পশ্চিমে হালুয়াঘাট উপজেলা এবং দক্ষিন ও পূর্বে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা ও দূর্গাপুর উপজেলা।

ধোবাউড়া একটি প্রাচীন জনপদ। এর পূর্ব নাম ছিলো ‘জিক্কোয়া বাজার’। অষ্টাদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এ এলাকায় স্বর্গীয় বাবু গৌরিবল্লভ সেন নামে এক বিশিষ্ট জোতদার ও সম্মানিত ব্যক্তি বসবাস করতেন। তৎকালীন তাঁর মালিকানাধীন এক পুকুরের পাড়ে সীতা নামক এক ধোপার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ধোপা বাস করতেন। যে পুকুরের পাড়ে তারা বসবাস করতেন সেই পুকুরটি এখনো ‘সীতার দীঘি’ নামে পরিচিতি। কথিত আছে যে,  সীতা নামক ওই ধোপাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। এর দুই দিন পর ওই পুকুরে তাঁর লাশ ভাসতে দেখা যায়। ইহা একটি ভৌতিক কান্ড মনে করে তাঁর নেতৃত্বাধীন ধোপারা ভয়ে কাউকে না জানিয়ে ওই পুকুরের পাড় তথা এ এলাকা ছেড়ে অজানা স্থানে চলে যান। তখন থেকে এলাকাটি ধোপাউড়া নামে পরিচিত হতে থাকে এবং কালক্রমে ধোবাউড়া নামে একটি গ্রাম ও মৌজা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই গ্রামের নাম ধরেই পরবর্তী সময়ে ধোবাউড়া ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। ধোবাউড়া ইউনিয়নের নামেই ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত থানার নাম রাখা হয় ‘ধোবাউড়া থানা’। ১৯৮৩ সালে ‍ধোবাউড়া থানাটি ধোবাউড়া উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। ইতিহাসে সীতা নামক সেই ধোপার মৃত্যুর রহস্য অজানা থাকলেও বর্তমান সময়ে ধোবাউড়া থানা পুলিশের পক্ষ্যে অপরাধমুলক যেকোন রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব।

কারণ এ থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ টিপু সুলতান অপরাধী অনুসন্ধানে একজন দক্ষ্য ও কর্তব্যপরায়ণ অফিসার। তিনি ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের প্রধান, সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত দেবদাস ভট্টাচার্যের তত্বাবধানে ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞার নির্দেশনা অনুযায়ী তার আওতাধীন অঞ্চলের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বদা সাহসীক ভূমিকা পালন করেন।

 

 

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী লালমাটি পাহারের পাদদেশের সীমানা ঘিরে অবস্থিত ২৫১.৮৮ বর্গকিমি আয়তনের ছোট্ট একটি জনপদ ধোবাউড়া। এ উপজেলাটি মাত্র ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ইউনিয়নগুলো দক্ষিণ মাইজপাড়া, গামারিতলা, ধোবাউড়া, পোড়াকান্দুলিয়া, গোয়াতলা, ঘোষগাঁও ও বাঘবেড় নামে প্রতিষ্ঠিত। ৭টি ইউনিয়নের দুটি ইউনিয়ন মেঘালয় রাজ্যের সীমানার সাথে মিলিত হয়েছে। ধোবাউড়া উপজেলা সীমানায় রয়েছে গাড় পাহাড় ও চিনামাটির পাহার। যা দেখতে সারা দেশ হতে প্রতিদিন অনেক লোক আসে ধোবাউড়ায়। পাহারের পাদদেশে বিস্তৃর্ণ ভাবে ছড়িয়ে আছে সবুজ কৃষি ভূমি। পাহারের গায়ে আছে টিন কাঠের নির্মিত ঘরের অনেক বসতি। পর্যটকদের কাছে এ জনপদের ভালোলাগা থাকে সব ঋতুতেই। বিশেষ করে আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ধোবাউড়ার আনাচে-কানাচে ও কৃষাণের মাঠে যতদূর চোখ যাবে ততদূরই চোখে ভাসবে সবুজ পাতার বিস্তৃর্ণ ধান ক্ষেত। মুলত এটাই এখানকার মানুষের প্রধান অর্থকারী ফসল। অনেকেই মাছ চাষ করেও জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে, উপজেলার পাড়ায় পাড়ায় বেশ কিছু উদ্দ্যোক্তার সমাহার ঘটেছে। তবে হাতির তাণ্ডবে চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে দেশের সীমান্তবর্তী এই উপজেলা। মেঘালয়ের শেষ সীমান্তে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিন মাইজপাড়া ও ঘোষগাঁও ইউনিয়নের সামীন্ত ঘেষে আধিবাসি অধ্যষিত গ্রামের মানুষের  ঘুম ভাঙে হাতির আক্রমণে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা হাতির পাল গ্রামের ফসলি জমি থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি ও গাছপালা তছনছ করে ফেলে। কদাচিৎ বন্য হাতির পাল কতৃক আহত ও প্রানহানির ঘটনা ঘটে | এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আতঙ্ক আর নির্র্ঘুম রাত কাটাতে হয় গ্রামবাসীকে। হাতির তাণ্ডবের ফলে শত শত বিঘা জমির ফসল ঘরে তুলতে পারছে না গ্রামবাসী। জীবন-জীবিকা হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। যা নিয়ন্ত্রণে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যান্ত জরুরী।

ধোবাউড়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ। এ জনপদে বাস করে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। এখানে নানান জাতের মানুষ একসাথে বসবাস করে। এ উপজেলায় গারো, হাজং প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।

 

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই, হদি, বর্মন ও বংশীসহ বিভিন্ন জাতি-গোত্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মিলে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের বসবাস রয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ নৃতাত্ত্বিক পরিবারের সদস্যরা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অথচ এককালে এদের সবকিছুই ছিল। ছিল  গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। কিন্তু  কালের আবর্তনে সবকিছু হারিয়ে আজ প্রায় দিশেহারা তারা। এখন এদের অধিকাংশের নেই নিজস্ব  কোনো জমি-জমা। এসব জনগোষ্ঠীর পরিবারের সদস্যরা বন বিভাগের জমির উপর ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাসের পাশাপাশি শ্রম বিক্রিসহ নানাভাবে পরিবারের  সদস্যদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বাকি ৩০ ভাগ নৃতাত্ত্বিক জসগোষ্ঠীর পরিবারের সদস্যদের জমি থাকলেও বন্য হাতির তাণ্ডবে গত ১২/১৪ বছর ধরে তাদের ফসল ও বসত বাড়ী ক্ষতিসাধিত হচ্ছে |

ধোবাউড়া উপজেলার উপর দিয়ে বয়েছে কয়েকটি নদী। এরমধ্যে নিতাই ও কংস নদী অন্যতম। এককালে এ নদীগুলোই ধোবাউড়ার যাতায়াতের অন্যতম পথ ছিলো। এখন নদী পথের গুরুত্ব অনেকাংশে কম। উপজেলার অভ্যান্তরীন ও দূরবর্তী অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য আঞ্চলিক কিছু সড়কপথ তৈরি হয়েছে। তবে নেই কোন মহাসড়ক বা আন্তঃজেলা সড়ক। উপজেলার বেশ কিছু জায়গায় নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে যাতায়াতের জন্য এখনো নৌকা বা খেয়ার প্রচলন রয়েছে। যোগাযোগ খাতে এটি উনুন্নত দিক হলেও এর নৈসর্গিক পরিবেশ প্রকৃতি প্রেমিদের আপন করে রেখেছে।

উল্লেখ্য যে, ময়মনসিংহের অন্যান্য উপজেলার তুলনায় ধোবাউড়ার শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন উন্নত না। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ও কিন্ডার গার্ডেন স্কুলসহ সব ধরনের শিক্ষা মাধ্যম চালু আছে। উল্লেখ্য যে, ধোবাউড়া এলাকায় নারী শিক্ষায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করে চলেছে ধোবাউড়া মহিলা ডিগ্রী কলেজ।

অন্যদিকে উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নে রয়েছে মনসাপাড়া এডভেন্টিস্ট সেমিনারী এন্ড স্কুল এটি ময়মনসিংহের একটি অন্যতম মিশনারী স্কুল। অত্যান্ত পরিপাটি ও সৌন্দর্য ঘেরা এ প্রতিষ্ঠানে আঙ্গিনায় রয়েছে সাড়ি সাড়ি নারিকেল গাছসহ নানান জাতের বৃক্ষ। এখানে পাহারী কিশোরীদের নৃত্যের দৃশ্য খুবই প্রশংসনীয়। এই মিশনারী স্কুলকে কেন্দ্র করে পর্যটকগনের বেশ আনাগোনা থাকে ধোবাউড়া উপজেলায়।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।