Haluaghat Sobuj Songket Thumbnail jpg

নানাজন নানামত
ফুলেফুলে গাঁথা
মনোচোখ জেগে আছে
সাথে স্বাধীনতা।

এমন অনেক নেই
এখানে যা আছে,
দুর থেকে শোনা নয়
এসে দেখো কাছে,
এই মাটি হাওয়া দেয়
মানবতা পাঠ
ধর্মের সম্প্রীতি
হালুয়ার ঘাট।

দেশের উত্তর সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহ জেলার একটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হালুয়াঘাট। এর দক্ষিণে ফুলপুর ও পূর্বে ধোবাউড়া উপজেলা। পশ্চিমে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলা এবং উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। বাংলাদেশ ভারতের অন্তঃসীমান্তবর্তী নদী ভোগাইসহ কংস ও মালিজি নদী বিদৌত হালুয়াঘাট একটি কৃষি নির্ভর অঞ্চল। তবে এখানে কয়লা আমদানী ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। এ কয়লা ব্যবসার খাত থেকে প্রতি বছর সরকারের অনেক রাজস্ব আদায় হয়। তাছাড়া এ ব্যবসায় স্থানীয় অনেক শ্রমিক জড়িত রয়েছে যা স্থানীয় হালুয়াঘাটের বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।

দেশের সীমান্তবর্তী এ উপজেলার আইন শৃংখলার মান বজায় রাখা ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের কাছে সবসময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যার প্রধান নেতৃত্বে রয়েছেন রেঞ্জের অভিভাবক অতিরিক্ত আইজিপি দেবদাস ভট্টাচার্য বিপিএম। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তার যুগোপযুগি সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রেখে অত্যান্ত সফলভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছেন ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা। তার দূরদর্শীপূর্ণ গতিশীল নেতৃত্বে হালুয়াঘাটকে অপরাধমুক্ত ও সর্বদা নিরাপদ রাখতে অত্যান্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছেন হালুয়াঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ সুমন চন্দ্র রায়।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১৬১ কি.মি. উত্তরে, মেঘের সাম্রাজ্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমানা ঘেসে অবস্থিত ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন প্রশাসনিক অঞ্চল হালুয়াঘাট। ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে হালুয়াঘাট উপজেলা সদরের দূরত্ব মাত্র ৫৫ কি.মি.।

হালুয়াঘাট নামের পেছনে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশত বছরের প্রাচীন এক গল্প। ১৬৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো একসময়ের দর্শা নামক নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সব ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালচাষিরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অবশ্য অনেকেই ভিন্ন আরেকটি মত প্রকাশ করেন। সেটি হলো, হালুয়া নামক এক ব্যক্তি ঘাটটি নিয়ন্ত্রণ করেন বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট।

ব্রিটিশ শাসনামলে অঞ্চলটির নিরাপত্তা বাড়াতে ১৯১৬ সালে হালুয়াঘাট নামে থানা গঠন করা হয় এবং পরে ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এরপর গত দশকে তথা ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারী ৯.২৫ বর্গ কি.মি. আয়তনে শহর কেন্দ্রীক ৯ ওয়ার্ডের সমন্বয়ে হালুয়াঘাট পৌরসভা গঠন করা হয়। বর্তমানে হালুয়াঘাট উপজেলার প্রশাসনিক এলাকা ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বিভক্ত রয়েছে। মোট গ্রামের সংখ্যা ২১০ টি ও মৌজার সংখ্যা ১৪৫টি। সম্পূর্ণ উপজেলার আয়তন ৩৫৭.৮০ বর্গকিমি যা হালুয়াঘাট থানার আওতাধীন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ উপজেলার এক পাশ ঘিরে রেখেছে ভারতের মেঘালয়ের মেঘছোঁয়া বড় বড় সব পাহাড়। মুক্ত আকাশে এখান থেকেই দেখা যায় বড় তুরা পাহাড়টিও। তাই এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণে যত কথাই বলা হোক তা সচক্ষে না দেখলে পূর্ণতা পাবে না। সূর্যপুর, পানিহাতা আর কড়ইতলী জায়গাগুলো থেকেই মেঘালয়ের সব পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের জায়গাটি কড়ইতলী। এখানকার বিজিপি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে শেরপুরের দিকে। আর অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউড়া উপজেলায়। এই দীর্ঘ রাস্তার একপাশের মেঘালয় সীমান্তে ছায়ার মতো ঘিরে আছে শুধুই পাহাড়। পাহাড় থেকে সীমানা অতিক্রম করে মাঝেমধ্যে দলভেদে নেমে আসে হাতি কিংবা মায়াবী হরিণ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হালুয়াঘাট একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল। কিন্তু পাহার সন্নীকটের কৃষকেরা সর্বক্ষণই একটু আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়। কারণ বণ্যহাতীগুলো দলবেধে খাবারের জন্য ছুটে আসে কৃষকের ফসল ভরা মাঠে। নষ্ট করে দেয় সব ফসল। অনেক সময় ফসল বাচাতে কৃষকেরা বন্য হাতীর পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ারও ঘটনা ঘটে।

হালুয়াঘাট উপজেলায় রয়েছে উপভোগ করার মত অনেক নান্দনিক ও ঐতিহাসিক স্থান। এর মধ্যে বূবনকুড়া ইউনিয়নের রঙ্গমপাড়া গ্রামের হাতির বিচরনকৃত পাহাড় অন্যতম। এছাড়াও এ উপজেলায় রয়েছে সাধু আন্দ্রিয়ের মিশন, শ্রী শ্রী কামাক্ষা মন্দির, ধারা মিয়া বাড়ী, গাবরাখালি গারো পাহাড়, আতুয়াজঙ্গল জাম বিল জল ব্রিজসহ নদী ও খাল-বিলের সৌন্দর্য়ে ঘেরা অনেক দর্শনীয় স্থান।

উপজেলার পরতে পরতে মিশে আছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কথা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ উপজেলার মাটিতে ৩ নভেম্বর ঐতিহাসিক তেলিখালী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও ২৩ জুলাই নাগলা ব্রিজ ধ্বংস, ২৮ জুলাই বিজয়পুর যুদ্ধ, ৫ আগস্ট আইলাতলী ব্রিজ ধ্বংস, ৬ আগস্ট বান্দরঘাটা যুদ্ধ, ৬ সেপ্টেম্বর কড়ইতলী যুদ্ধ এবং ৮ ডিসেম্বর ধারা যুদ্ধের মাধ্যমে হালুয়াঘাটকে শত্রুমুক্ত করা হয়। তবে হালুয়াঘাট মুলত ৭ ডিসেম্বরেই শত্রু হয়েছিলো। সেই ঐতিহাসিক রনাঙ্গণে জীবন দিয়েছিলো অসখ্য মুক্তিকামী বাঙ্গালী। যাদের অবদান কখনোই ভূলবে না হালুয়াঘাটের সন্তানেরা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য কুদ্রত উল্লাহ মন্ডল, রাজনীতিবিদ, সাবেক সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, আইনজীবী, সাবেকমন্ত্রী ও সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ এ মাটিরই সন্তান।

শিক্ষা-শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতির পাদপীঠ হালুয়াঘাট প্রাচীন ঐতিহ্য উপজেলা হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত। এ এলাকার বিড়ই ধান, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎ ও কারু শিল্প, মিস্টি, ঘোষের দোকানের রসমালাই, ইত্যাদি স্ব-স্ব স্বকীয়তা আজও বজায় রেখেছে। কালের বিবর্তনের ধারায় এসেছে অনেক কিছু, অনেক কিছু গেছে হারিয়ে হারায়নি এখানকার মানুষের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তা ও সামাজিক সম্পৃতি। মুসলীম, হিন্দু অদ্যুসিত হালুয়াঘাটে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বর্মণ, ক্ষত্রিয়, হদি, কুরমি, মাল প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ।

এখানকার জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ ভারত হতে আমদানীকৃত কয়লার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। হালুয়াঘাট উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক পাশে গোবরাকুড়া এবং ছয় কিলোমিটার দূরে আরেক পাশে কড়ইতলী স্থলবন্দর অবস্থিত। যা গত ১৭ মে উদ্বোধন করা হয়েছে। এখান থেকে মেঘালয়ের পাহাড়ের দূরত্ব মাত্র কয়েকশ’ গজ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়েরই বুকে নির্মিত হয়েছে স্থলবন্দর দুটি। হালুয়াঘাটের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বন্দর দুটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।