Muktagacha Thana

ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত মাত্র ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি উপজেলা যার নাম মুক্তাগাছা। প্রশাসনিক মুক্তাগাছার জন্ম ১৯৬১ সালে। কিন্তু এর শহর উন্নয়নের সুচনাকাল ১৮৭৫ সাল, যখন মুক্তাগাছায় পৌরসভার সৃষ্টি হয়েছিলো। তার পূর্বকালে মুক্তাগাছার নাম ছিলো বিনোদবাড়ি। সেকালে এ এলাকায় নিতান্তই কয়েকজন দরিদ্র লোক বসবাস করতো। চারিদিকে ছিলো ঘন অরণ্য আর বড় বড় জলাভূমি। যা আলাসিংহ পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

 

 

ঐ সময় জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্যের চার ছেলে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদী আয়মানের তীরবর্তী স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে এলাকার অধিবাসীগণের সাথে সাক্ষাত এবং অধিবাসীদের সামর্থ্য অনুযায়ী দেওয়া নজরানা গ্রহণ করেন। নৌকা ভেড়ানো সেই স্থানটি রাজঘাট নামে পরিচিত।

বিনোদবাড়ীর বাসিন্দাগণ ছিল প্রান্তিক চাষী ও জেলে। জমিদারদের যারা নজরানা দিয়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে মুক্তারাম কর্মকার নামক এক ব্যক্তি তার নিজের হাতের একটি পিতলের গাছা জমিদারদের নজরানা হিসেবে প্রদান করেছিলেন। জমিদারগণ মুক্তা রামের নামের প্রথম অংশের সাথে গাছা শব্দটি যোগ করে বিনোদবাড়ীর পরিবর্তে এলাকার নামকরণ করেন মুক্তাগাছা। যা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৩ সালে একটি উপজেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত,  কিংবা বসন্ত!  গ্রাম সবসময়ই সুন্দর। তবে গ্রামের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষায়। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে গ্রামগুলো যেন ভেসে থাকে। সে এক অপরুপ দৃশ্য। রিমঝিম বৃষ্টি আর মেঘ বাদলের লুকোচুরিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। ডালে ডালে ফোটে দৃষ্টিনন্দন কদম। বৃষ্টি ও বন্যায় ঝকঝকে হয়ে ওঠে প্রকৃতি। সেই সাথে মেঠো পথে একটু ভোগান্তিও পোহাতে হয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের দারুণ এ নিয়মে কৃষকদের লাভ-ক্ষতি জড়িয়ে থাকে। কখনো মাঠেই ফসল নষ্ট, কখনো ফসল কেটে ঘরে তোলা দায় হয়ে পড়ে।

আবার হেমন্তকালে, নির্মল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পাকা ধানের উপর সূর্যের কিরণে চারপাশে বিচরণ করে সোনালী আভা। কালের বিবর্তনে দিগন্তজোড়া মাঠ হারিয়ে গেলেও গ্রামের পথে প্রান্তরে হেমন্তের সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি আজও। নদী-নালা, খাল-বিলের হাঁটুপানিতে দেখা যায় মাছ ধরার উৎসব। মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী রুপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের।  এমনই ২৮৩টি গ্রামের বাহারে সাজানো একটি উপজেলা মুক্তাগাছা। এ মুক্তাগাছা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ পছন্দের একটি উপজেলা।

ফুলবাড়িয়া মোট ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত প্রশাসনিক অঞ্চল। পৌরসভাটি মুক্তাগাছা নামে প্রতিষ্ঠিত এবং এটিই উপজেলার শহর এলাকা হিসেবে প্রসারিত হচ্ছে। স্কুল/কলেজ, সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ব্যাংক-বীমা, মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় ভাড়ী পন্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান তথা বিভিন্ন বাহরী পণ্যের শো-রুম এবং উপজেলা ভিত্তিক দপ্তরিক অফিস সমুহ পৌরসীমানার উপরেই গড়ে উঠেছে। আর অন্যদিকে ইউনিয়নগুলোতে কালের বিবর্তনে দিগন্তজোড়া মাঠ হারিয়ে গেলেও গ্রামের পথে প্রান্তরে হেমন্ত বা বর্ষার  সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি আজও। নদী-নালা, খাল-বিলের কোমর পানিতে কৃষকে সোনালী আশের ঢেউ আজও সৃষ্টি করছে হৃদয় ভোলানো আবহের। মুক্তাগাছা ইউনিয়নের নামগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগে।  যেমন দুল্লা, বড়গ্রাম, তারাটি, কুমারগাতা, বাঁশাটি , মানকোন, ঘোগা, দাওগাঁও, কাশিমপুর ও খেরুয়াজানী ইউনিয়ন। এর মধ্যে দুল্লা ইউনিয়নের ছালড়া গ্রামটি একটু ভিন্ন।

সুন্দরবনের মত বেতগাছ ও বাশবনের ভিতরে জোয়াড়ের মত পানি জমে থাকে! তার সাথে রয়েছে শালবন, বিশাল কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন দিঘির সমন্বয়ে পুরো গ্রামটা চমৎকার একটা জায়গায় পরিনত হয়েছে। ছালড়া গ্রামটা আবহমান বাংলাদেশের চিত্রকে তুলে ধরে। গ্রামে ঢোকার পথে বিলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা, গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ততা, শালবনের কাঠকুড়ানীদের কাঠ কুড়ানো, কৃষকের হাকডাক, বিলে জেলেদের মাছ ধরা, বিশাল বিশাল কয়েকটা দিঘি, বাশঁ ও বেতে বন,  সুন্দর একটা মসজিদ  এবং ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের দৃশ্য যে কাউকে মন ভূলিয়ে দেয়।

মুক্তাগাছা একটি কৃষি প্রধান জনপদ। তবে ঐতিহ্যগতভাবে মুক্তাগাছা দেশের কাছে এক বিশেষ পরিচিতি দখল করেছে। আর তা হলো মুক্তাগাছার মন্ডা মিঠাই। বাঙ্গালী এই মিষ্টান্ত শুধু দেশেই নয় বরং দেশের বাইরেও প্রসিদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ ব্যাক্তিদেরকে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়েছিলো এই মণ্ডা দিয়ে। তাছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী, দ্বিতীয় এলিজাবেথ কেও আপ্যায়ন করা হয়েছে মণ্ডা দিয়ে।

মুক্তাগাছা উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। এরমধ্যে অন্যতম মুক্তাগাছার রাজবাড়ি। যার পরতে পরতে ইতিহাস খেলা করছে শত শত বছর ধরে। মুক্তাগাছার জমিদারির মোট অংশ ছিলো ১৬টি। রাজবাড়ির প্রবেশমুখে রয়েছে বিশাল ফটক। প্রায় ১০০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই রাজবাড়িটি প্রাচীন স্থাপনাশৈলীর অনন্য নিদর্শন।

মুক্তাগাছার আরও একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবির ঘর। শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দাওগাঁও ইউনিয়নের খাজুলিয়া দক্ষিণ পাড়ায় প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ বিবির ঘরটি অবস্থিত। ধারণা করা হয়, ১৭শ দশকের শেষ দিকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ফকির-সন্যাসীরা এই ঘরটি নির্মাণ করেন। প্রায় দশ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে পাঁচ ফুট প্রস্থ এবং আট ফুট উচুর দৃষ্টি নন্দন ছোট্ট দোচালা বা এক বাংলা ইমারত এটি। এছাড়াও উপজেলার হরিপুর দেওলী গ্রামে রয়েছে ভুঁইয়া বাড়ী জামে মসজিদ। এটি শত শত বছরের প্রাচীন স্থাপনা হিসেবে ধারণা পাওয়া যায়। মসজিদটির ধারনক্ষমতা মাত্র ৩১জন। মোট ৫৮ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ৩০ ফুট দের্ঘ্য ও প্রস্থ্য বিশিষ্ট এ মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরিএর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। মুসলীম ঐতিহ্যের নিদর্শন সমুহের পাশাপাশি মুক্তাগাছায় একটি প্রাচীন মন্দীরও রয়েছে। যেখানে সনাতন ধর্মালম্বীগণ নিয়মিত পুজা অর্চনা করছেন। এটি প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন একটি শিব মন্দির। পাশাপাশি তিনটি শিব মূর্তি থাকার কারণে মন্দিরটিকে তিন শিব মন্দির নামে নামকরণ করা হয়েছে। এর কিছু দুর সামনে আরেকটি জোড় মন্দির অবস্থিত যা ১৮২০ সালে মহারানী বিমলা দেবী নির্মান করেছিলেন। একই মাপের শিব ও কালী নামে মন্দির দুটির উচ্চতা প্রায় একশত ফুট।  শিব মন্দিরের ভিতরে রয়েছে বাবা বিশ্বনাথের মূর্তি ও কালী মন্দিরে রয়েছে মা কালীর মূর্তি।

সর্বপরি বলা যায় ঐতিহাসিক কাল থেকেই মুক্তাগাছায় হিন্দু ও মুসলীম সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক-বাহীনির অত্যাচারে অনেক হিন্দু এ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়।  বর্তমানে এটি একটি মুসলীম প্রধান অঞ্চল। এখান মাটি ও বাতাসের সাথে স্মৃতি হয়ে আছে অসংখ্যা বীর পুরুষ ও বিশিষ্ঠ ব্যাক্তিজনদের নাম।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।