Pagla Thana Gafargaon

ঘন অরণ্যে ঢাকা, একটি জনপদ। নাম তার পাগলা। নদী, বিল, হাওর-বাওর, কৃষানের মাঠ, আর সবুজের ছায়ায় বিছনো ছোট ছোট বসতবাড়ি যেন শিল্পির কল্পনায় আকা পরিকল্পিত একটি পল্লী মানচিত্র। যার আয়তন ২০৫.২২ বর্গ কি.মি। কিন্তু প্রশাসনিক পাগলা মানচিত্রের জন্ম হয়েছে মাত্র ১ দশক আগে। এইতো সেদিনের কথা! দেখতে দেখতে যেন পেড়িয়ে গেল ১১টি বছর। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার আওতাভুক্ত গফরগাও উপজেলার গফরগাঁও সরকারি কলেজ মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে পাগলাকে একটি আলাদা থানা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। তার সেই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ মূলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাগলা থানা অনুমোদনের গেজেট প্রকাশ করে। চারিদিকে উচ্ছাস-উদ্দিপনা আর বহুদিনের স্বপ্ন ‍পুরনের আনন্দে পাগলাবাসী সেদিন অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলো। কারণ, একটি থানা সৃষ্টি মানেই নিরাপত্তার চাদর আরও প্রশস্থ হওয়া। পাগলা থানা সৃষ্টি হওয়ার পর এ থানায় অফিসার ইনচার্জ হিসেবে প্রথম দায়িত্ব পালন করেছিলেন মোঃ মকবুল হোসেন মোল্লা। এরপর গত একদশকে পর্যায়ক্রমে আরও ৭জন অফিসার ইনচার্জ পাগলা থানার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বর্তমানে এ থানায় ৮ম বারের  অভিভাবক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন অফিসার ইনচার্জ রাজু আহাম্মদ। তিনি ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক দেবদাস ভট্টাচার্যের নিয়ন্ত্রনাধীন ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞার নির্দেশে থানা এলাকার আইন শৃংখলা রক্ষা ও জানমালে সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছেন।

 

 

ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ৬২ কি.মি. দক্ষিণে পুরাতন ভ্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেষা নৈসর্গিক পরিবেশের একটি পল্লী ভুবন পাগলা। এটি গফরগাও উপজেলাধীন দক্ষিণ সীমানার নবগঠিত পাগলা থানাধীন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত একটি জনপদ। ২০১২ সালের ২৩ মে গফরগাঁও উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে পাগলা থানার যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে একটি ভাড়া বাড়িতে পাগলা থানার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে স্থানীয়দের দেয়া ৩ একর ১ শতাংশ জমিতে চারতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক থানা ভবন নির্মাণ করা হয়। নবসৃষ্ট পাগলা থানার ইউনিয়নগুলো হলো মশাখালী, পাঁচবাগ, উস্থি, লংগাইর, পাইথল, দত্তেরবাজার, নিগুয়ারী এবং টাংগাবর ইউনিয়ন। এ আটটি ইউনিয়ন মিলে পাগলা থানা অঞ্চলে আনুমানিক ৫৫ থেকে ৬০ হাজার পরিবার বসবাস করে। তাদের মোট সংখ্যা ২ লাখ ১৯ হাজার। এই বৃহত জনবসতির ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষই কৃষক। তারা স্থানীয় কৃষি মাঠে ধান, পাট, গম, ডাল ইত্যাদি খাদ্য শস্য উৎপাদন করে। সীমানার প্রায় তিন দিক নদী দ্বারা বেষ্টিত। পূর্বসীমানা ঘেষে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে কালীবানার ও পশ্চিমে সুতিয়া নদী। আর উত্তর দিকে গফরগাঁও থানার স্থলভাগ।

অভ্যান্তরে প্রবাহমান দইনা, কাওরাইদ, বংশী ও শীলানদী। রয়েছে অসংখ্য খাল ও বিলের জলাশয়। এসব নদী খাল-বিলে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যায়। পাগলা অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষিত দিকটি হলো এর শাশ্বত রূপে সজ্জিত পল্লী জীবন। কিশোর কিশোরীদের গায়ের মাঠে হেটে চলা, মেঘলা আকাশে নিশ্চুপ বিকালে সকল বয়সী মানুষের পথে প্রান্তরে ঘুরাঘুরি, অথবা সন্ধা গগনে গায়ের কোলের টং দোকানে মুরব্বীদের বিচ্ছিন্ন চা পান পাগলা জনপদে আলাদা বৈশিষ্ট প্রমাণ করে।

পাগলার মানুষ খুবই অপ্যায়ন প্রিয় এবং একে অপরের প্রতি সহনশীল। তবে ঐতিহাসিক কালে এ পাগলা জনপদের বৈশিষ্ট ছিলো সম্পূর্ণ উল্টো সভাবের। মানুষের মধ্যে ছিলো ঘোর আতঙ্ক। যেকোন সময় হতে পারে ডাকাত দলের আক্রমণ। সময় পরিবর্তিত হয়েছে। এখন আর সেই আতঙ্ক নেই পাগলা থানা বাসীর। পাগলা থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এটি গফরগাও থানাধীন একটি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র ছিলো। স্থানীয় নিরাপত্তা বৃদ্ধিকল্পে ১৯৯৫ সালে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সময়ের প্রয়োজনীয়তায়  পাগলা তদন্তকেন্দ্র থেকে একটি পূর্ণ থানায় রূপ পেয়েছে।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রাচীন এই নগরীতে ইতোমধ্যে রেকর্ড পরিমাণ উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বদলে গেছে পুরো নগরী। তবে এই থানার প্রত্যন্ত এলাকা তথা সর্বদক্ষিণের টাঙ্গাবর ও নিগুয়ারি ইউনিয়ন থেকে উপজেলা সদর ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরবর্তী হওয়ায় গুরুতর অসুস্থ রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সঠিক সময়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া ‘ উপজেলা পরিষদ দূরবর্তী হওয়ায় সরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম যেমন-ভূমি সেবা, উপজেলা সমাজসেবা অফিসের বিভিন্ন সেবা, সরকারি বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, উপজেলা নির্বাচন অফিসে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা, উপজেলা শিক্ষা, কৃষি ও মৎস্য চাষ পরামর্শ সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা নেওয়ার জন্য দূরবর্তী গফরগাঁও উপজেলা যেতে এ জনপদের মানুষের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই এলাকাবাসীর জোর দাবি সংসদীয় আসন এবং সীমানা অখণ্ড রেখে ময়মনসিংহের পাগলা থানাকে পৃথক উপজেলা করা হোক। স্থানীয়রা মনে করে- বর্তমান সরকার একটি গণমুখী সরকার। এই সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নের ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছে। যা পাগলা থানার ৮টি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের আশাবাদী করে তুলেছে।

 

পাগলা থানা অঞ্চলের উপর দিয়ে চলমান রয়েছে মাওনা-গফরগাঁও মহাসড়ক এবং ঢাকার সাথে সরাসরি রেল সংযোগ ও একটি রেলস্টেশন। পাগলা থানাধীন রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বৃহৎ কয়েকটি বাজার, অসংখ্য দোকানপাট, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শাখা এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান।

এ অঞ্চলের মানুষের রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্বের অনেক গৌরবময় ইতিহাস। পাগলা থানার টাংগাব ইউনিয়নের বারইহাটি বাজার সংলগ্ন ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষ্যি বহন করছে পাকবাহিনী টর্সারসেল। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালিন হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের বন্ধি ও গণহত্যা চালানো হত এই টর্সারসেলে। নিজের দেশকে রক্ষা করতে এ মাটির অসংখ্য সন্তান এখানে অকাতরে জীবন দিয়েছেন। হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে বীর দর্পে যুদ্ধ করে পাগলাকে শুত্রুমুক্ত করেছেন আরও অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙ্গালী।

এই পাগলা থানা অঞ্চলে জন্ম নেওয়া আলোকিত মানুষ হিসেবে যাদের নাম সর্বাধিক প্রথম সাড়িতে তারা হলেন, স্বাধীনতার পক্ষের লড়াকু সৈনিক এবং ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে গফরগাঁও-ভালুকা আসনের এমএলএ মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ:), দক্ষিণ গফরগাঁওয়ের প্রবাদ পুরুষ শাহ বদরুল হক গেদু মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ভাষা সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

পূর্বেই উল্লেখিত যে, পাগলা থানা অঞ্চলটি সম্পূর্ণই পল্লী জনপদ। আটটি ইউনিয়ন এলাকায় স্থানীয় বাজার বৈ কোন এলাকাই শহর অঞ্চল নয়। তবে দত্তের বাজার ইউনিয়নটি একটু ভিন্নতা পেয়েছে। এ ইউনিয়নেই থানা ভবনটি অবস্থিত। থানা ভবনটি আঞ্চলিক প্রধান সড়কের কোলে নির্মিত হওয়ায় দত্তের বাজার এলাকাটি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।