Fulpur Thana Sobuj Sonket

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান

আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ।

মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি

চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।

বন্দে আলী মিয়ার কবিতায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এদেশের গ্রামের হৃদয় ভোলানো রুপ। গ্রাম মানেই সবুজ-শ্যামল, শান্ত, ছায়াঘেরা, মনোরম এক জনপদ। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, টুইটুম্বুর খাল-বিলে নয়নাভিরাম শাপলা পদ্ম! আর পাখিদের কোলাহল। ষড়ঋতুর এদেশে ঋতুর পরিবর্তনের সাথে তারা পাল্টে যায় নতুন রুপে, নতুন বৈশিষ্ট্যে। যদিও ক্রমাগত নগরায়নের ফলে গ্রামের সৌন্দর্য এখন হুমকির মুখে। তবে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার প্রকৃতি এখনো সুন্দর। আজ থেকে মাত্র এক দশক আগে ময়মনসিংহ বিভাগের সবচেয়ে বড় উপজেলা হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে ছিলো এই ফুলপুর উপজেলা। তখন এর আয়তন ছিলো ৫৮০.২১ বর্গ কিলোমিটার। ২০টি ইউনিয়নের ৪০৯টি গ্রাম নিয়ে ফুলপুর ও তারাকান্দা নামে দুটি থানা সীমানায় এর প্রশাসনিক কাযক্রম পরিচালিত হতো। কিন্তু ২০১৩ সালে তারাকান্দাকে ১০টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে আলাদা উপজেলা হিসেব ঘোষনা করা হয়। ফলে ফুলপুরের মানচিত্রটি ছোট হয়ে ২১৬টি গ্রাম ও ২০৭টি মৌজার সমন্বয়ে ৩১৯.০১ বর্গ কি.মি. আয়তনে একটি নতুন উপজেলা মানচিত্র গঠন করে।

 

 

বর্তমানে ফুলপুর উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ফুলপুর থানার আওতাধীন।

ময়মনসিংহ রেঞ্জের সম্মানিত অভিভাবক, সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল আইজিপি জনাব দেবদাস ভট্টাচার্য্য বিপিএম, এর নেতৃত্বে জেলার মান্যবর পুলিশ সুপার জনাব মাছুম আহাম্মদ ভূঞা, পিপিএম এর নির্দেশে ফুলপুর থানার অফিসার ইনচার্জ জনাব সুমন চন্দ্র রায় ফুলপুরের আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১৪২ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের জনপদ ফুলপুর। জেলা শহর থেকে ফুলপুরের দুরত্ব মাত্র ৩০ কি.মি.। এটি একটি প্রাচীণ প্রশাসনিক অঞ্চল।

১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহে প্রথম যে ১২টি থানা স্থাপিত হয়েছিলো তন্মধ্যে ফুলপুর অন্যতম।

ইংরেজ কোম্পানী আমলের প্রথম দিক থেকে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল গারো, হাজং, হদী রাজবংশী ও মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহ ক্ষেত্র হিসাবে অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ ছিলো। পাহাড়ী উপজাতি গোষ্ঠীর বিদ্রোহ তৎপরতা, লুটপাট ইত্যাদি দমনের জন্য গারো পাহাড়ের পাদদেশের ঘোষগাঁও নামক গ্রামে ইংরাজ শাসকেরা একটি থানা স্থাপন করে। কিন্তু সেখান থেকে প্রশাসনিক যোগাযোগ রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন ছিলো। এ ঘোষগাঁও থানার পুলিশী কার্যক্রম ফুলপুর থেকে চালানো  হতো।

ফুলপুরের প্রাচীন নাম ছনকান্দা। ইংরেজ সাহেবদের উচ্চারণে তা হয়ে উঠেছিলো চান্দকোগুা।  জরিপ ও পরিসংখ্যান সংক্রান্ত প্রাচীন কাগজ পত্রে ফুলপুর ইউনিয়নে মাগনফুলপুর নামে ২১ একর জমি বিশিষ্ট একটি গ্রামের নাম পাওয়া যায়। মূলত কাজিয়াকান্দা, আমুয়াকান্দা অংশ বিশেষ এবং মাগন ফুলপুরের সমগ্র জমি নিয়ে ফুলপুর থানা সদর এলাকা গঠিত। সে কারণেই থানাটি ফুলপুর নামে পরিচিত পায়। অবশ্য ফুলপুরের উত্তরাংশের বাজারটি এখনও ছনকান্দা বাজার নামেই পরিচিত । যা ঐতিহাসিক কালে উত্তরাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিলো।

উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চল মুসলিম আদিপত্যের আগে ছনকান্দা এলাকাসহ পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রাচীন সুসঙ্গ রাজ্যের ছয়টি জোয়ারের অন্যতম ছিলো। বলা হয় অতি প্রাচীন কাল থেকেই ছনকান্দা জনবসতি ও বাণিজ্য সর্বত্র প্রসিদ্ধ ছিলো। প্রাচীনকালের সম্মৃদ্ধ এ জনপদটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্মৃতিভূমি। উপজেলার ছন্দরা ইউনিয়নের রামসোনা গ্রামে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যকার সম্মুখ লড়াইয়ে ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদদের স্মরণে কংস নদীর তীরে নির্মিত হয়েছে একটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভি এবং ভাইটকান্দি ইউনিয়নে রয়েছে একটি বধ্যভূমি।

 

সময় পরিবর্তিত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ছনকান্দা তথা ফুলপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে ততটা প্রসিদ্দ নয়। তথাপি উপজেলা জুড়ে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি হাট-বাজার রয়েছে। অন্যদিকে ফুলপুরের জনবসতি এখন ৮০ হাজারেরও বেশি পরিবার বিশিষ্ট প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার মানুষের একটি জনপদে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ্য ৪৪ হাজার মানুষই সরাসরি কৃষি কাজের সাথে জরিত। বর্তমানে উপজেলার মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৬৩১৪৮ হেক্টর। ধান, গম, পিঁয়াজ, রসুন, ডাল, আলু ও বিভিন্ন শাকসবজি ফুলপুরের প্রধান অর্থকরি ফসল।

এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিদেশ গিয়ে শ্রম বিক্রিরও বেশ প্রবণতা রয়েছে। যার ফলে ফুলপুর উপজেলায় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। মধ্যম এবং ছোট ছোট কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে বিদ্যমান আছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রসর না হলেও গত দুই দশকে অনেক এগিয়েছে ফুলপুর উপজেলার শিক্ষার মান। মাত্র ৩৩.১০ শতাংশ শিক্ষার হার এখন ৭০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। উল্লেখ্য যে, ফুলপুর উপজেলায় বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোর নির্মাণ সাল আঠারো শতাব্দির শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে।

ফুলপুর উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে বয়ে মোট ৫টি নদী। তার মধ্যে অন্যতম ভোগাই ও কংশ নদী। অন্য তিনটি নদী বর্তমানে যেীবনহীন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একসময় এই নদীগুলোই এ অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম পথ ছিলো। কালের বিবর্তে এখন প্রধান্য পেয়েছে সড়ক পথ। সে দিক থেকে ফুলপুর শহর খুবই উন্নত। ফুলপুর পৌর এলাকার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করেছে হালুয়াঘাট-ফুলপুর সংযোগ সড়ক এবং শেরপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। ফুলপুর পৌর এলাকার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত সড়কটি রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও অন্যান্য সংযোগ সড়কের মাধ্যমে ফুলপুর উপজেলা দেশের সকল জেলা ও উপজেলার সাথে সংযুক্ত হয়েছে।

ঊল্লেখ্য যে, একটি উপজেলা মানচিত্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দুর্যোগ মোকাবেলা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল কিছুই গড়ে উঠেছে বর্তমান ফুলপুরে। সময়ের সাথে সাথে এ উপজেলাকে আরও এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সচ্ছ ও দুর্ণীতিমুক্ত সকল দাপ্তরিক কার্যক্রম।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।