Gafargaon Thana

ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে মাত্র ৩৯ কি.মি. দূরত্বের একটি প্রাচীন প্রশাসনিক অঞ্চল গফরগাঁও, যা ময়মনসিংহ জেলাধীন একটি ঐতিহাসিক জনপদ।

অঞ্চলটি ১৮১৩ সালে  গফরগাঁও থানা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এর দীর্ঘকাল পর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে গফরগাঁও ১৫টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে ১৯৮৩ সালে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

ঐতিহাসিককালে গফরগাঁওয়ের ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টি ইউনিয়ন ভাওয়াল পরগনাধীন এবং পূর্বাংশ চর আলগী ইউনিয়ন আঠারবাড়ি জমিদার প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জানা যায়, গাফফার খান নামক জনৈক সেনানায়কের নাম থেকে ‘গফরগাঁও’ নামের উৎপত্তি। ধারণা করা হয় মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহ ও বাংলার বারো ভুঁইয়াদের নেতা ঈসা খানের সম্মুখ যুদ্ধটি গফরগাঁওয়ের বাশিয়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ যুদ্ধের একটি বড় ভুমিকায় ছিলো সেই সেনানায়ক গাফফার খান। তাছাড়া ১৭৬৬ সালের ঐতিহাসিক ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সাক্ষ্যি গফরগাঁওয়ের দুবাষিয়া ও চরআলগি গ্রাম।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকবাহিনীর দুটি জঙ্গি বিমান গফরগাঁও শহরের উপর মেশিনগান দিয়ে গুলি করে। এতে গফরগাঁওয়ের ১৭ জন নিরীহ লোক প্রাণ হারায়  এবং শতাধিক লোক আহত হয়। সেই ঘটনা ও এ অঞ্চলের শহীদদের স্মরণে এখানে একটি ভাষ্কর্য নির্মিত হয়েছে।

সেসব ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মৃতির আয়নায় রেখে বর্তমান গফরগাঁও উপজেলা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় উন্নয়ন ও সম্মৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও অসংখ্য মৌলিক সেবা দপ্তর। তবে বর্তমান গফরগাঁও দুটি প্রশাসনিক এলাকায় বিভক্ত। ১টি গফরগাঁও থানা! যা প্রাচীন ঐতিহাসিক কাল থেকেই বিদ্যমান ও আরেকটি পাগলা থানা যা গত দশকের শুরুতে আইন শৃংখলার মান বৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে

নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।

 

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন অমর কাব্যগ্রন্থ নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের বাস্তব চরিত্র “রূপা”কে নিয়ে করুন ব্যদনায় ভরা এ ছন্দ আজও সুর তোলে গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামে। পল্লী কবির অমর সৃষ্ট নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের মাঝে আজও স্মৃতি হয়ে আছে গফরগাঁওয়ের হাজার উপজীব্য। সেখানে উঠে আসে কৃষি প্রধান গফরগাঁওয়ের একটি নির্মম ঘটনা।

মুলতঃ ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজ সঙ্গীত সংগ্রহ করতে জসীমউদ্দীন গফরগাঁওয়ে এসেছিলেন৷ সেখানে এসেই কবি তার সাহিত্যচর্চার অন্যতম সঙ্গী খ্যাতনামা সাহিত্যিক মৌলভী শেখ আবদুল জব্বারের বনগাঁও গ্রামের বাড়িতে ওঠেন৷ এখানে অবস্থানকালে বনগাঁও গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে একদিন বড় ধরনের এক দাঙ্গা হয়৷ সেই দাঙ্গায় গফরগাঁওয়ের লাঠিয়াল দলের নেতৃত্ব দেন শিলাসী গ্রামের কৃষ্ণবর্ণের হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের যুবক রূপা৷ পল্লীকবি সেই দাঙ্গা দেখেন; দেখেন গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের এক নারকীয় দৃশ্য৷ লাঠিয়াল দলের নেতৃত্বদানকারী রূপার ছিলো তেজোদীপ্ত এক ভয়ঙ্কর বীরত্ব৷ ওই দাঙ্গাই কবির মনে রেখাপাত করে৷ নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে সেই দাঙ্গার ঘটনা৷ সেসময় এই রূপাকে মানুষ ‘রূপা গুণ্ডা’ বলেই জানতেন৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একবার তিনি ইউপি ‘সদস্য’ নির্বাচিত হন৷ অবিভক্ত ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি সরাসরি দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, আর তখন গফরগাঁও বাজারে ১১ জন মারা গেলে তাকে এ ঘটনায় দুই দফায় ১৫ মাস কারাভোগ করতে হয়। গফরগাঁও বাজারের কাইয়ুম মার্কেটে একটি স্টলে আড্ডা দিতেন জসীমউদ্দীন, সেখানে বসেই রূপাই সম্পর্কে খোঁজখবর নেন তিনি৷ সেই স্টলেই কবির সঙ্গে রূপার পরিচয় হয় এবং রূপা তার নিজের সম্পর্কে জানান জসীমউদ্দীনকে, যা উপজীব্য করে কবি পরে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

গত দুই দশক আগের গফরগাঁও থানা থেকে বর্তমান গফরগাঁও থানার আইন শৃঙখলার মানে  বৃহত্তর পরিবর্তন এসেছে। পূর্বের বর্বর অপরাধের কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছে বর্তমান গফরগাঁও। দুর্ধর্ষ ডাকাতি, চুরি, চিন্তাই এখন কল্পনাতেই শোভা পায়। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে অন্যতম ভূমিকায় আছে গফরগাঁও থানা পুলিশ যা অফিসার ইনচার্জ ইনচার্জ ফারুখ আহমেদের নেতৃত্বে আরও সফলতা পেয়েছে।

গফর উপজেলার মোট আয়তন ৪০১.১৬ বর্গ কি.মি.। তবে ২০১২ সালে পাগলা থানা সৃষ্টি হওয়ার পর গফরগাঁও থানার আয়তন দাড়ায় ১৯৫.৯৪ বর্গ কি.মি.। এ থানা মানচিত্রে বাসকরে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। অত্যান্ত ঘনবসতিপূর্ণ এ থানা অঞ্চলটি বর্তমানে ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। সেগুলো হলো রসুলপুর, বারবাড়িয়া, চর আলগী, সালটিয়া, যশরা, রাওনা ও গফরগাঁও ইউনিয়ন এবং গফরগাঁও পৌরসভা। সম্পূর্ণ উপজেলার একমাত্র শহর এই পৌরসভা। এর আয়তন মাত্র ৫.৩৩ বর্গ কি.মি.। ছোট্ট এই শহরের বাস করে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ। যারা বিবিধ চাকুরী ও ব্যবসা পেশার সাথে জড়িত রয়েছে।

গফরগাঁও মূলত কৃষি প্রধান অঞ্চল। ধান, পাট, আলু, বাদাম, সরিষা, আখ ইত্যাদি এ অঞ্চলের অন্যতম কৃষি ফসল। গফরগাঁওয়ে এক ধরনের গোলাকৃতির বেগুন উৎপন্ন হয় যা দেশব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেছে। এ অঞ্চলে ভাড়ি কোন শিল্প কারখানা নেই। তবে অঞ্চলজুড়ে অনেক কুটির শিল্প রয়েছে। যা এ থানা অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রাখছে।

গফরগাঁও থানা ৭টি নদী ও অসখ্য খাল-বিল অধ্যুষিত অঞ্চল। থানার পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ভ্রহ্মপুত্র নদী। গফরগাঁও থানার ৩নং ইউনিয়ন চড় আগলী ব্রহ্মপূত্র নদীর চড় অধ্যুষিত এলাকা। এই চড় এলাকার বৈশিষ্ট থানার অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে একটু আলাদা। এখানকার মানুষ তুলনামুলক গরিব ও অধিকাংশ ভূমিহীন। এখানকার মানুষের মধ্যে মধ্যে জমি সংক্রান্ত দন্দ বিদ্যমান। তবে ইউনিয়নটি পল্লী সৌন্দর্যের প্রতিক। পরন্ত বিকেলে নদীর পাড়ের দৃশ্য ও বালুময় মাঠগুলো শহরবাসিকে খুবই আকৃষ্ট করে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং বিশেষ দিনগুলোতে প্রকৃতি প্রেমিরা এ অঞ্চলে ভির করে।

তাছাড়া ময়মনসিংহের পর্যটন  আকর্ষণের মধ্যে  অন্যতম পর্যটন নিদর্শন হিসাবে  স্থান করে নিয়েছে গফরগাঁও থানার কাচুয়া গ্রামের ভাষা সৈনিক শহীদ জব্বারের বাড়ির পাশে অবস্থিত আব্দুল জব্বার জাদুঘর। ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদের স্মরণে এটি ২০০৭ সালে নির্মাণ করা হয়। আবদুল জব্বার এর  যাদুঘরটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ  আসে ও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে দেশের বীর সন্তান শহীদ আবদুল জব্বারকে।

তাছাড়া খ্যাত সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা কিরণ চন্দ্র দে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালযয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা: এম এ হাদি, উপমহাদেশের খ্যাতনামা ধর্মীয় আলেম, হযরত মাওলানা মো. শামসুল হুদা পাঁচবাগী (র) এবং শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, ন্যায়বিচারক ও অতিথি পরায়ণ ব্যাক্তি তৎকালীন বাগবেড় গ্রামের কৃতি সন্তান মদন মন্ডলসহ অসংখ্য গুনি ব্যাক্তির জন্মভুমি এই গফরগাঁও থানা অঞ্চল।

 

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে ময়মনসিংহের যে জনপদটি রেল পথের উপর নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পা রেখে ছিলো তার মধ্যে গফরগাঁও একটি। বর্তমানে ৭টি অন্তঃনগরসহ মোট ১২টি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে গফরগাঁও উপজেলার উপর দিয়ে। এবং সবকটি ট্রেনই এখানে যাত্রা বিরতি করে। অন্যদিকে উন্নয়নের নিশানে এগিয়ে চলা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে গফরগাঁও উপজেলা এখন সড়ক যোগাযোগেও উন্নত হয়েছে। এখন ঢাকাসহ সারা দেশের সাথেই গফরগাঁও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবিচ্ছিন্ন রয়েছে।

 

 

 

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।