Fulbaria Sobuj Songket Thumbnail 02 jpg

ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ পশ্চিমের জনপদের নাম ফুলবাড়ীয়া। যার আয়তন ৩৯৯ বর্গ কিঃ মিঃ। ফুলবাড়ীয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকা মধুপুর ভাওয়ালের লালমাটি দ্বারা গঠিত ভূমি সম্প্রসারিত অংশ। ভূমিগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলে বাংলাদেশের যেসকল স্থান প্রাচীনতার দাবী করতে পারে তার মধ্যে ফুলবাড়ীয়া একটি। ঐতিহাসিক শাসনামলে পূর্বতন আলেক শাহী বা আলাপসিংহ পরগনার অংশ ছিলো ফুলবাড়িয়া। যা বর্তমাণে একটি সম্মৃদ্ধ উপজেলা মানচিত্রে প্রশাসনিক কাঠামো পরিচালিত হচ্ছে।

ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত অরণ্যে ঘেরা ছায়া শীতল জনপদ ফুল ফুলবাড়ীয়া উপজেলা।

 

খিরু, আখালিয়া ও বানার নদী বাহিত ফুলবাড়ীয়া উপজেলার পল্লী গ্রামগুলোতে প্রাকৃতিক নানা সৌন্দর্য বিদ্যমান। সরু মেঠোপথ ধরে কৃষানের হেটে চলা দেখতেও যেন ভালো লাগে। কত মায়ায় যে তারা মাঠে ফসল ফলায় তার লেখনি কথা অসীম। দেশের অন্যান্য জেলার মত ফুলবাড়ীয়াতেও ধান, পাঠ ও সরিষা চাষ হয়। তবে এ অঞ্চলে প্রচুর হলুদ উৎপাদিত হয়। যা এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাছাড়া মৌসুমি নানা শাক-শবজি চাষ হয়ে থাকে যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হয়। অন্যদিকে উপজেলার খাল-বিল ও পুকুরগুলোতে প্রচুর মাছ চাষ হয়। যা উপজেলার দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। অন্যান্য উপজেলার ন্যায় ফুলবাড়ীয়া উপজেলাতেও স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য বিদ্যমান। এ উপজেলায় বিভিন্ন রকমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কল-কারখানা রয়েছে। রয়েছে মোট 39টি হাট-বাজার। এখানকার মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যসমুহ এসকল হাট-বাজারের মাধ্যমেই লেনদেন হয়। তন্মধ্যে আছিম বাজার, কালাদহ বাজার, কেশরগঞ্জ বাজার, বাবুগঞ্জ বাজার ও কালীর বাজার ফুলবাড়িয়ার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র।

ফুলবাড়ীয়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৪,৪৮,৪৬৭ জন। তাদের পরিবারের সংখ্যা মোট ১,০১,১৮৯ টি। পরিসংখ্যানমতে মোট ৭২৬৩৪টি পরিবার কৃষি কাজের সাথে জরিত এবং বাকী ২৮৫৫৫টি পরিবার ব্যবসাসহ অন্যান্য পেশার সাথে জরিত রয়েছে।

এটি ময়মনসিংহ-৬ নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত। ১৪০টি গ্রাম ও ১০৪টি মৌজার সমন্বয়ে গঠিত ফুলবাড়ীয়ার ইউনিয়ন সংখ্যা ১৩টি। রয়েছে একটি পৌরসভা যা ২০০১ সালে ১৫.৮০ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউনিয়নগুলো হলো যথাক্রমে নাওগাও, পুটিজানা, কুশমাইল , বালিয়ান , দেওখোলা, ফুলবাড়ীয়া, বাক্তা , রাংগামাটিয়া , এনায়েতপুর , কালাদহ , রাধাকানাই ইউনিয়ন , আছিম পাটুলী ও ভবানীপুর ইউনিয়ন। উল্লেখ্য, রঘুনাথপুর ও বৈরাগী বাজার নামে আরও দুটি প্রস্তাবিত ইউনিয়ন রয়েছে।

ফুলবাড়ীয়ার আদি পরিচিতি থেকে জানা যায়, এর পূর্ব নাম ছিলো গোবিন্দগোঞ্জ। তখন এ অঞ্চলে এক ধরনের উদ্ভিদ দেখা যেত যা ফুলখড়ি নামে পরিচিত ছিলো। ফুলখড়ি মুলত গায়ের লোক লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করতো। সেই ফুলখড়ি থেকেই ফুলবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারনা পাওয়া যায়।

ইতিহাসবিদগণ মনে করেন এক সময় ফুলবাড়ীয়া বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী জনপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এই এলাকার ইক্ষু ও ইক্ষুজাত দ্রব্য চিনি ও গুড় দেশে বিদেশে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে যা এখনো লাল চিনি নাম ধারণ করে সভ্যতার সাক্ষী হয়ে ফুলবাড়ীয়া ও ত্রিশালের কিছু এলাকায় কৃষকের ঘরে ঘরে বেঁচে আছে।

ফুলবাড়িয়ার প্রশাসনিক ইতিহাসে দেখা যায় ১৮৬৪ সালেই ফুলবাড়ীয়ায় একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেসময় ফুলবাড়ীয়া থানার সীমানা নির্ধারণ করা যায়নি। পরবর্তীতে ১৮৬৭ সালে ফুলবাড়ীয়া থানার সীমানা নির্ধারণ হয় এবং ফুলবাড়ীয়া থানা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।

এরপরবর্তী শতকে ১৯৮৩ সালের ০২ জুলাই ফুলবাড়ীয়া উপজেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমানের ফুলবাড়ীয়া ময়মনসিংহ জেলার একটি সম্মৃদ্ধশালী উপজেলা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ঐতিহ্য অথবা সুনামে ফুলবাড়িয়ার এতটুকো কমতি নেই। এ উপজেলার মাটিতে কালে কালে জন্ম নিয়েছেন বহু গুণি মানুষ।

হাজার বছরের ঐতিহ্য হিসেবে ফুলবাড়ীয়ায় আজও দাড়িয়ে আছে হাজার বছরের প্রাচীন কারুকাজ সম্বৃদ্ধ পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। যা উপজেলার জোরবাড়ীয়া (পূর্ব) গ্রামে মরহুম আঃরশিদ খান সাহেবের বাড়ীতে অবস্থিত। ফুলবাড়ীয়া পুলিশ স্টেশন থেকে মসজিদটির দূরত্ব মাত্র ৩.৪ কিলোমিটার। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে দেশের এই প্রাচীন নিদর্শনটি দেখতে খান বাড়িতে আসেন শত শত দর্শনার্থী।

এছাড়া প্রকৃতির নির্যাস শোভা উপভোগ করতে জেলা-উপজেলার অনেক দর্শনার্থী ফুলবাড়ীয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বিশাল বনাঞ্চল, বড়বিল ,আনই রাজার দীঘি, নাওগাঁও ইউনিয়নের সন্তোষপুর রাবার বাগান ও বিস্তৃত বনভূমিতে আসেন। তারা বলেন, এসব পর‌্যটন স্থানগুলোর সম্মৃদ্ধি এনে সুপরিকল্পিতভাবে ফুলবাড়ীয়াকে গড়ে তোলা সম্ভব।

ফুলবাড়ীয়া উপজেলার বালিয়ান ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বাসনা ঈদগাহ মাঠ এবং বাক্তা ইউনিয়নের কৈয়ারচালা গ্রামে অবস্থিত ঈদগাহ মাঠটিও একটি উল্লেখযেগ্য স্থান। যা ময়মনসিংহ জেলা তথা দক্ষিণ অঞ্চলের বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠ এবং দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান।

ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র আলাদিনস্ পার্ক ফুলবাড়ীয়া উপজেলাতেই অবস্থিত যা ময়মনসিংহ জেলা থেকে প্রায় ৪৫ কিঃ মিঃ এবং ফুলবাড়ীয়া সদর থেকে প্রায় ২৫ কিঃ মিঃ দূরে এনায়েতপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ২৫ একর।

ফুলবাড়িয়া উপজেলার বালিয়ান ইউনিয়নের দশমাইল নামক স্থানে প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিনে আয়োজন করা হয় আড়াইশো বছরের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক একটি খেলা। যা হোম গুটি নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের জমি পরিমাপের বিরোধের মীমাংসা করতে আয়োজন করা হয়েছিল এই খেলার। তারপর থেকে এখন অব্দি প্রতিবছরের নির্দিষ্ট দিনে হাজার হাজার জনগণ একত্রে এই খেলা খেলে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমের মাধ্যমে খেলাটি পৃথিবীর একমাত্র এবং  ঐতিহাসিক স্থান দখল করে।  যা ফুলবাড়িয়া উপজেলাকে এক অনন্য মাত্রায় স্থান করে দিয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।