Trishal Sobuj Songket Thumbnail jpg

ত্রিশাল উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলার ১৩ টি উপজেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। ঐতিহাসিক যুগে খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে এটি আলাপসিংহ পরগনার অংশ ছিলো। মূলত ভ্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম অংশ আলাপসিংহ নামে পরিচিত ছিলো। ত্রিশালে প্রথম দিকে মুসলিমদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকলেও পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে গারোবংধর ও হিন্দু ধর্মালম্বীরা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাবেচা হতো বর্তমান ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমে সুতিয়া নদীর দক্ষিণ তীরে কুলাইতলা মন্দিরকে ঘিরে নওধার হাটে। তৎকালিন জমিদারগণ এ হাটকে নাম দিয়ে ছিলো রাধাগঞ্জ। পরে বর্তমান স্থলে ত্রিশাল বাজার বসলে রাধাগঞ্জ ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারায়। ১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ কোতয়ালী থানা সৃষ্টি হলে ত্রিশাল কোতয়ালী থানার অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন প্রত্যন্ত পশ্চাদপদ ও প্রায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা ছিলো এ ত্রিশাল। পরে ১৯০৯ সালের ৪ মে ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে ত্রিশাল একটি আলাদা থানার সৃষ্টি হয়। ত্রিশাল থানার নামকরণ করা হয়েছে ত্রিশাল মৌজার নামের উপর ভিত্তি করে। পরবর্তীতে ফুলবাড়ীয়া থানার ৩টি ইউনিয়ন অন্তর্ভূক্ত করে মোট ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে ত্রিশাল থানা গঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে থানাকে উপজেলায় উপজেলায় রুপান্তর করা হয়।

 

 

রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৯১ কি.মি. উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তের ২২৮.৭৩ বর্গ কি.মি. আয়তনের একটি জনপদ ত্রিশাল। মোট ১৫৯টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিশাল উপজেলা ১টি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এটি ময়মনসিংহ ৭ নির্বাচনী এলাকা। এ উপজেলাটির দপ্তরিক অবকাঠামোসমুহের অধিকাংশই ত্রিশাল পৌর এলাকাধীন গড়ে উঠেছে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী জনাব জিল্লুর রহমান ত্রিশাল ইউনিয়নের ১৫.৪৯ বর্গ কি.মি আয়তন সীমানাকে পৌরসভা ঘোষণা করেন। ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরত্বে উপজেলার মধ্য ভাগের পশ্চিম অংশে ত্রিশাল পৌরসভার অবস্থান। পৌর এলাকার উপর দিয়ে বয়ে গেছে সুতিয়া নদী। উপজেলার পূর্ব সীমান্ত ঘেসে নীরব শ্রোতে বয়ে চলা পুরাতন ভ্রহ্মপূত্র নদী থেকে উৎপন্ন এ নদীটি এক সময় ত্রিশালের জনজীবনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ব্যতীত নদীটি প্রায়ই পানি শুন্য থাকে। সুতিয়া ও পুরাতন ভ্রহ্মপূত্র ছাড়াও ত্রিশালের উপরদিয়ে বয়ে গেছে আরও ১০টি নদী। রামপুর ইউনিয়নে রয়েছে বিশাল আয়তনের চেচুয়া ও গোলার নামে দুটি বিল। যা উপজেলার কৃষি ও প্রকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। নয়নাভিরাম সতেজ প্রকৃতি আর সবুজ-শ্যামলতায় ভরপুর ত্রিশালের ইউনিয়নগুলো। পাখির কুহুতান আর নির্মল সমীরণের গুঞ্জন যেন এখানকার মানুষের সুস্থতার লুকোনো দাওয়াই।

ত্রিশাল উপজেলার মানুষ কৃষি, মৎস্য, শিল্প ইত্যাদি-তে নির্ভরশীল। জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। সমগ্র বাংলাদেশের মধ্য মৎস চাষের জন্য বিখ্যাত ত্রিশালে বৈলর ইউনিয়ন। বিশেষ করে পাঙ্গাস মাছের জন্য। তবে উপজেলার রায়মনি অঞ্চলে আকিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিভিন্ন টেক্সটাইল শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া পোল্ট্রি শিল্প ও কুটিরশিল্পজাত পন্য উৎপাদনে ত্রিশাল সমৃদ্ধ। প্রধান কৃষি ফসল ধান, পাট, গম, ডাল, আখ ও শাকসবজি।

এখানকার কৃষক, দিনমজুর, কামার-কুমোর, চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, ছাত্র, ভবঘুরে স্বাধীন চিত্তে জীবন নির্বাহ করে। যেন আদর্শিক জনপদের দৃষ্টান্ত এই ত্রিশাল। বর্তমানে ত্রিশাল একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। ত্রিশালের মোট জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখেরও অধিক। বিপুল এই জনসংখ্যার আইনি সেবায় রয়েছে ত্রিশাল থানার ৩০ জন অফিসারসহ মোট ৬৬জন পুলিশ সদস্য। বাংলাদেশের অন্যান্য থানার চেয়ে ত্রিশাল থানার অভ্যান্তরিন পরিবেশ একটু ভিন্ন। এ থানার সেবা নিতে যেন কোন সাধারণ মানুষ সংকোচ বোধ না করেন এবং সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন কোন অফিসার সেবা প্রার্থীকে অবহেলা না করেন সে জন্য থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন তার বসার স্থান নির্ধারণ করেছেন থানার মূল ভবনের বাহিরের গোল ঘরে। তিনি এ গোল ঘরে বসেই সেবা প্রার্থীদের সেবা দিচ্ছেন।

ত্রিশালের পরিচিতি ঘটে আবুল মুনসুর আহম্মদ, আবুল কালাম শামসদ্দিন, ইমানআলী সাহিত্যরত্ন সাহেবদের মত ক্ষণজন্মা ব্যক্তিদের আমল থেকে। আরও একধাপ পরিপূর্নতার দিকে অগ্রসর হয় ১৯৬৪ থেকে ৬৬ সালের ময়মনসিংহের স্বনামধন্য জেলা প্রশানক পি, এ নাজির সাহেবের ত্রিশালে প্রথম নজরুল জন্মোৎসব পালনের মধ্যদিয়ে। যারফলশ্রুতিতে, ত্রিশাল নামাপাড়া বটতলায় আজ হয়ে উঠেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ত্রিশালের রফিজ উল্ল্যা দারোগা ত্রিশালবাসীর অন্তরে জাগরুক হয়ে থাকবে অনন্তকাল। কেননা তিনিই তো কৈশোরে নজরুলকে এখানে এনেছিল। তিনি কৈশোর নজরুলকে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি করে দেন। যা বর্তমানে সরকারি নজরুল একাডেমী নামে প্রতিষ্ঠিত। গত দুই দশকে এ উপজেলার শিক্ষার মান যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। এক সময়ের নির্জন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ত্রিশালের প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলেও এখন বহুমাত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

ত্রিশাল নিঃসন্দেহে একটি প্রাচীন বসতভূমি। রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ উপজেলা মোক্ষপুর ইউনিয়নের সানকিভাঙ্গা গ্রামে রয়েছে রাজবাড়ির ইন্দিরা প্রাচীর ও পুলের নিদর্শন। কানিহারী ইউনিয়নের সেনবাড়ি গ্রামে রয়েছে মোঘল আমলের ঐতিহাসিক রাজবাড়ি। কিছুদিন আগে এটির নকশা ও কারুকার্যে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে রাজবাড়িটি দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে।

বৈলর ইউনিয়নে রয়েছে ১৫০ বছরের পুরোনো আরেকটি রাজবাড়ি। ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের দক্ষিণ অঞ্চল পরিচালিত হতো এই বৈলর জমিদার বাড়ি থেকে। বর্তমানে বাড়িটি জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।

তাছাড়াও রয়েছে মোঘল আমলে নির্মিত দরিরামপুর জামে মসজিদ। রয়েছে কবি নজরুল’র স্মৃতি বিজড়িত বট গাছ ও নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে ত্রিশালের দর্শনীয় স্থানগুলোতে বহিরাগত ও স্থানীয় অনেক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।