maxresdefault 4
বাংলার প্রাচীন রাজধানী শহরের এক স্মৃতিময় নাম সুবর্ণগ্রাম। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অবারিত আকর্ষণ, অনুপম স্থাপত্যশৈলী ও প্রাচীন নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ আর পর্যটকদের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি জাগানো হৃদয় ছোঁয়া এক নৈসর্গিক পরিবেশের ঐতিহাসিক গায়ের নাম সোনারগাঁ উপজেলা।

ঐতিহাসিক সোনারগাঁ

ঐতিহাসিক সোনারগাঁ শুধু দেড়শ বছরের পুরানো স্মৃতি বিজড়িত ধ্বংসাবশেষ নগরীই নয়, এর সাথে জড়িত আছে একটি স্বাধীন জাতির আত্ন পরিচয়ের অনুভূতি। ইতিহাসের আবহমান ধারায় অনেক চড়াই- উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে এ অনভূতি আরো সুদৃঢ় হয়েছে। সোনারগাঁ আজ এমন একটি নামে পরিণত হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতি একযোগে প্রকাশ পাচ্ছে।

শুর, পাল, সেন ও দেব রাজাদের আমলে গোড়াপত্তন হলেও সোনারগাঁয়ের সমৃদ্ধ এবং গৌরব উজ্জ্বল যুগের শুরু হয় ১৩৩৮ খৃষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমল থেকে। সেসময় তার ঘোষণাতেই সোনারগাঁ স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়। পরে গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ্, শের শাহ, ঈশাখাঁ পর্যায়ক্রমে সোনারগাঁয় রাজত্ব করেন। সোনারগাঁ নামকরণের ইতিহাস রহস্যাবৃত। ড. আর.সি. মজুমদার ও স্যার যদুনাথ সরকার যে সুবর্ণ ভূমির কথা বলেছেন তা এ সোনারগাঁ ভূমিকেই বুঝায়। যার মাটি সুবর্ণ বা রক্ত বর্ণ ছিল। কালিকা পুরানে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র তীরের অনেক স্থানের ভূমি রক্তবর্ণ বলে উল্লেখ আছে। কথিত আছে যে, দেবা সুরের যুদ্ধকালে রক্তপাত হেতু মৃক্তিকা লোহিত বর্ণ ধারণ করেছিল। তাই এই অঞ্চলটি সুবর্ণ গ্রাম হিসেবে মানুষের মুখে মুখে সমাদ্রিত হতে থাকে।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সোনারগা মুলত একটি থানা হিসেবে বিবেচিত ছিল, কিন্তু ১৯৮৩ সালে এই থানাটিকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়।
এককালে ব্যবসায়, শিক্ষা-দীক্ষায়, কৃষি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও কারুকার্যে সোনারগা অঞ্চল ছিল বিশ্ব নন্দিত। সোনারগাঁয়ের মসলিন কাপড় ছিল সারা বিশ্বে সমাদৃত। কথিত যে, বাংলার প্রথম মসজিদ সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী গ্রামে নির্মিত হয়, যা ইতিহাসে মুসলিম উম্মার স্বাক্ষর বহন করছে। সোনারগাঁ হতে পাঞ্জাব পর্যন্ত পৃথিবীর দীর্ঘতম সড়ক, গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড শের শাহের আমলে নির্মিত হয়েছিল।
এখানে রয়েছে গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ্ এর মাজার, রয়েছে পাঁচ পীরের দরগাহ্ সহ অসংখ্য গুণীজনের স্মৃতি
এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী পানাম নগর, বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প যাদুঘর, বাংলার তাজমহল, বাংলার বড় বাবু জ্যোতি বসুর স্মৃতি বিজরিত পৈত্রিক নিবাস, লালপুরি শাহ্ এর দরবার শরিফ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, পানাম নগর ও বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প যাদুঘর বাংলাদেশ এর মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় ও ইতিহাস বহুল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেই সমাদৃত।
পানাম নগরী বাংলাদেশের চারশত বছরের ঐতিহ্যভিত্তিক একটি প্রাচীন নগরীর মডেল হিসেবে বিবেচিত। এর প্রাচীনত্ব আরো গভীর । ধারনা করা যেতে পারে ঐতিহাসিক ‘‘সড়কে-ই-আযম’’ গ্রান্ড ট্রাংঙ্ক রোডের সমাপ্তি এ পানাম নগরেই হয়েছিল। সে সুবাদে পানাম নগরী ‘‘সরকার-ই-সোনারগাঁওয়ের’’ পরগনার হেড কোয়ার্টার হিসেবেও বিবেচিত ছিল। পানামের প্রাচীনত্ব বহন করে চলেছে ট্রেজারার হাউস, সেতু, কোস্পানীর কুঠি এবং প্রাচীন বনেদি ইমারত সমূহ। পানাম নগরের বিভাশিত বর্নাঢ্য-ইমারত সমূহ স্বাক্ষ্য দেয় একসময় সোনারগাঁয়ের অভিজাত নাগরিকদের বসবাসের কেন্দ্র ছিল।
সোনারগাঁ উপজেলা ০১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এছাড়াও রয়েছে ৩৫১টি মৌজা এবং ৪৮৭টি গ্রাম। ১৭১.০২ বর্গ কিঃ মিঃ আয়তনের এই জনপদে বসবাস করে প্রায় চার লাখ মানুষ। যদিও বর্তমানে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও ব্যপক সংখ্যায় রুপ নিয়েছে।
ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দু’পাশ জুড়ে সবুজের সমারোহ আর বনানীর শ্যামলিমায় মনোরম স্থাপত্যশৈলী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদী বেষ্টিত এই উপজেলার বর্তমান পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদীটি প্রায় মৃত।
অন্যদিকে অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষার আলোতে প্রজ্জলিত করতে দিনে দিনে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি প্রায় দেড় শাতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০টি মাদ্রাসা ও ৫টি মহাবিদ্যালয়। যা এলাকার শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে গুরুত্তপুর্ন ভূমিকা পালন করছে।
এ অঞ্চলে বসবাসকৃত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুসলীম ধর্মালম্বী মানুষের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক অত্যান্ত সুদৃঢ়। কতিপয় কিছু তাতী, জেলে, কামার, কুমার ও বৃহৎ অংশ কৃষাণের এ জনপদের উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তাছাড়াও এ অঞ্চলের  ঐতিহ্যবাহি গ্যাঞ্জি, শুতি শাড়ি ও লুঙ্গি বিদেশে রপ্তানী হয়ে থাকে।
প্রায় দেড় শতাধিক শিল্প, কল-কারখানা সম্মৃদ্ধ এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে । একটি বিদ্দুত উৎপাদন কেন্দ্রসহ অনেকগুলো তাই বলা যায়, শিল্পান্নয়নে সোনারগাঁ উপজেলা খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
এখানে রয়েছে কিছু আঞ্চলিক পত্রিকা, তার মধ্যে অন্যতম ডেইলি সোনারগাঁ পত্রিকাটি।
এলাকার নিজস্ব কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্যকে আকড়ে ধরে উপজেলাটি এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। কিন্তু তারপরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ক্ষনে ক্ষণে যে অস্থিরতা বিরাজ করে সোনারগা উপজেলা জুড়ে তা সত্যিই ব্যথিত করে সকল উপজেলাবাসিকে।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।