maxresdefault 13 jpg

যমুনার অববাহিকায় গড়ে উঠা একটি দ্বীপ সাদৃশ্য অঞ্চল দৌলতপুর। এক সময়ের সবচেয়ে অবহেলিত জনপদটি কালের বিবর্তনে এখন একটি সম্মৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হতে চলেছে। এর উত্তরে টাঙ্গাইল জেলা সীমানা, দক্ষিণে ঘিওর, পূর্বে সাটুরিয়া ও পশ্চিমে পাবনার বেড়া উপজেলা অবস্থিত।

প্রাচীন এ ভূমি অঞ্চলে ঠিক কবে মানুষের বসতি স্থাপন হয়েছিলো ইতিহাসে তার কোন উল্লেখ পাওয়া না গেলেও ব্রিটিশ নথিপত্র অনুয়ায়ী এখানে প্রথম থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯১৯ সালে। পরিবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে দেশের অন্যান্য থানার ন্যায় দৌলতপুর থানাটিও একযোগে উপজেলার স্বীকৃতি লাভ করে।

 

 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দৌলতপুরের পূর্ব নাম ছিলো গোবর্ধনপুর। মুঘল শাসনামলে দৌলত শাহ নামে এক সুফি সাধক এই গোবর্ধনপুরে এসে তার খানকাহ প্রতিষ্ঠা করলে বহু মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ঐ সাধকের নামানুসারে গোবর্ধনপুরের নামকরণ হয় ‘দৌলতপুর’।

দৌলতপুর উপজেলার আয়তন ২৩৯.১৪ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের বিচারে এর অবস্থান জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা। আর জনসংখ্যার বিচারে এটি মানিকগঞ্জের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ জনপদ। এ উপজেলার মোট জন্যসংখ্যা চার লাখেরও অধিক। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে এ অঞ্চলে বাস করে ৪,২৭,৯১৩ জন মানুষ। ২১২টি গ্রামের সমন্বয়ে ১৬৯ মৌজায় বিভক্ত দৌলতপুর উপজেলার ইউনিয়ন সংখ্যা ৮টি।

দৌলতপুর উপজেলার জনপদটি পাখির চোখে আকাশ থেকে দেখতে ভীষণ সুন্দর। উপজেলার পশ্চিম সীমানাকে ছেদ করে বয়ে গেছে যমুনা নদী। আর মধ্যভাগ দিয়ে দ্বিখন্ডিত করেছে কালীগঙ্গা নদী। এ নদীটি দক্ষিণের ঘিওর উপজেলা দিক থেকে প্রবেশ করে একেবেকে দৌলতপুরের উত্তর পশ্চিমে যমুনার কোলে গিয়ে মিশেছে। খন্ড খন্ড কৃষি আবাদী জমি, কিছু পুকুর জলাশয়! এরপর ছোট ছোট ঘরবাড়ি! এভাবেই গড়ে উঠেছে পুরো দৌলতপুর অঞ্চল।

এখানকার মানুষের চালচলন ও জীবন জীবিকার উৎসতে তেমন কোন ভিন্নতা নেই। নেই রাজনৈতিক ভিন্নতাও। প্রায় শতভাগ মুসলীম সম্প্রদায়ের বসবাস স্থল, এ নগরের মানুষ অত্যন্ত সহজ সরল ও অতিথিপরায়ণ। সর্বদা অসাম্প্রদায়িক মনোভাবেই তাদের বেড়ে ওঠা ও জীবন-যাপন। তবে কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন কিছু রাজনৈতিক দাঙ্গার সংবাদও উঠে আসে কিছু স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে।

উপজেলাটি এখনো শতভাগ শিক্ষার আলোতে পৌঁছাতে পারেনি। তবে সে প্রচেষ্টায় দিনে দিনে নানান মাধ্যমের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উত্থান ঘটছে দৌলতপুরে। বর্তমানে এ উপজেলার শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশের উপরে। রয়েছে প্রায় ৫টি মহাবিদ্যালয়, ২০টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ৬টি আলিয়া মাদ্রাসাসহ সরকারি বেসরকারি মোট দেড় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

তবে পিছিয়ে আছে সড়ক যোগাযোগ খাত। এ অঞ্চলে নেই কোন মহাসড়ক। রয়েছে ১৪৭ কি.মি আঞ্চলিক সড়ক। এসব সড়কগুলোতে তুলনামুলক ছোট যানবাহন, যেমন, সিএনজি, মোটরচালিত ভ্যান, অটো ও মোটরবাইকের চলাচলই বেশি থাকে। তাছাড়া ঐতিহ্যের জমিদারি বাহন ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার খুব বেশি দেখা যাবে দৌলতপুরে। মালামাল পরিবহনে এই ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প চিন্তাই করবে না দৌলতপুরবাসী। তবে যেহেতু দেশের প্রধান নদীসমূহের অন্যতম যমুনা নদীর অবস্থান রয়েছে এই দৌলতপুর উপজেলায় সেহেতু সমগ্র দেশের সাথে উপজেলার নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। বহিরাঞ্চলে মালামাল পরিবহনে দৌলতপুরবাসী নদীপথকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, সড়ক পথের যোগাযোগকে আরও সহজ করতে দৌলতপুরের সড়ক যোগাযোগ খাতে আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যা উপজেলার উন্নয়নে অধিকতর ভূমিকা রাখবে।

দৌলতপুরের ভূ-প্রকৃতি একটু ব্যতিক্রম। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে এখানকান ফসলী মাঠ বা বসতবাড়ির স্থায়ীত্ব থাকে খুবই কম সময়। ভাঙ্গন কবলিত মানুষ কখনো নদীর এপাড়-কখনো নদীর ওপাড় এভাবেই তাদের বসতি গড়ে। বার বার পদ্মা-যমুনার তীব্র ভাংগন, প্রাকৃতিক দুযোর্গ ও বন্যা মোকাবেলা করেই বেঁচে আছে অঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। নদীর কাছাকাছি মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই নদীভিত্তিক কর্ম করে জীবনকাল অতিবাহিত করে। বর্ষায় সময় দু’কূল ছাপিয়ে থাকে জল আর জল। বর্ষার শেষে যমুনার জলে ভেসে আসা বেলে-দোআঁশ মাটিতে নতুন স্বপ্ন বুনে কৃষকরা। সদ্য জেগে ওঠা এক একটি বালুচর যেন এক একটি আশার মুখ। এ আশা লালন করে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ধান, শরিষা, বাদাম ও ভুট্টা চাষে উৎসাহী থাকে এখানকার কৃষক। তাছাড়া নানা সবজি চাষ করেও জীবিকা নির্বাহ করে উপজেলার কৃষক পরিবারগুলো।

বিভিন্ন সময়ের নানা দুর্যোগের কারণে দৌলতপুর উপজেলায় তেমন কোন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেনি। কয়েকটি মাঝারি শিল্পসহ কিছু ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের অবস্থান চোখে পরবে এ জনপদে। কেউ কেউ গবাদি পশু পালন, পোল্ট্রি খামার ও নার্সারী ব্যবসার মাধ্যমে বেশ লাভবান হচ্ছে বলে এলাকাবাসি উল্লেখ করেন।

এই অঞ্চলটির ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রাচীন সভ্যতার প্রমাণ মিললেও কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ বা বিশেষ প্রাচীণ স্থাপনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে উপজেলার ধামশ্বর ইউনিয়নে অবস্থিত রয়েছে ধামশ্বর মাজার শরীফ । এই মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিশাল মেলা বসে। অন্যদিকে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম স্থান দৌলতপুর অবকাশ কেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে গড়া অবকাশ কেন্দ্রটি উপজেলা চত্তরের পুকুর পাড়ে অবস্থিত।

এই উপজেলা চত্তরকে ঘিরেই এলাকার মানুষের সকল দাপ্তরিক কাজ পরিচালিত হয়। উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখতে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি উপজেলা হাসপাতালসহ অনেকগুলো উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দের অবস্থান রয়েছে দৌলতপুর উপজেলায়।

দুর্ঘটনা বা অগ্নিকান্ড রোধে নির্মিত হয়েছে একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও সিভিল ডিফেন্স।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।