maxresdefault 14 jpg

বিশাল পৃথিবীর বুকে ৯৫৪.৯৬ বর্গ কি.মি. আয়তনের ছোট একটি ভূ-খণ্ড। নাম মুন্সীগঞ্জ। এটি বাংলাদেশ মানচিত্রের মধ্যবিন্দু ঢাকা জেলা সীমানার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত প্রাচীনকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। কোথাও সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত, কোথাও ফসলে ভরা কৃষাণীর মাঠ আবার কোথাও থৈ থৈ শব্দে বহমান নদী প্রান্তর। তারই মাঝে কোথাও কোথাও শতাব্দির পর শতাব্দি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। মুন্সীগঞ্জের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের আশির দশক পর্যন্ত মুন্সীগঞ্জের খ্যাতি ছিলো বিশ্বজুড়ে। বলা হয় প্রায় সমগ্র বঙ্গের উপর প্রাধান্য ছিলো তৎকালীন বর্মন ও সেন রাজবংশের শাসনামলে। সেসময় মুন্সীগঞ্জ তাদের রাজধানী রূপে বলবৎ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থানান্তর হলে মুন্সীগঞ্জ কেবল স্মৃতির পাতায় একটি পরগোনা হিসেবেই জেগে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে ঢাকা কালেক্টরেটের আওতায় মুন্সীগঞ্জ মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পরে ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মুন্সীগঞ্জকে ঢাকা জেলা থেকে পৃথক করে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

টিন কাঠের কারুকার্যে খচিত একতলা দোতলা বা তিন তলা বিশিষ্ট নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ঘর-বাড়ির শহর মুন্সীগঞ্জ।

 

বিক্রমপুর নামে খ্যাত এ জেলার আদিনাম ছিলো ইদ্রাকপুর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় মুন্সী এনায়েত আলীর মুন্সীর সাথে গঞ্জ যুক্ত করে এলাকার নামকরণ হয় মুন্সীগঞ্জ। যদিও অনেকের অভিমত হলো, মোঘল শাসনামলে এলাকার ফৌজদারী আদালতের প্রধান হায়দার আলী মুন্সীর নামানুসারে মুন্সীগঞ্জ নামের উৎপত্তি হয়েছে।

কিন্তু এ অঞ্চলটি কেন বিক্রমপুর নামে বিশ্ব পরিচিতি দখল করে আছে তার কাঙ্খিত জবাব পাওয়া যায় মুন্সীগঞ্জ এর আদি কিছু বই থেকে। ১৭৮১ সালের একটি মানচিত্রে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত কালীগঙ্গা নদীর দুই পাশকে উত্তর বিক্রমপুর ও দক্ষিণ বিক্রমপুর নামে আলাদাভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। জানা যায় বিক্রমপুর নামটির উৎপত্তি রাজা বিক্রমাদিত্য থেকে। বিক্রমাদিত্য হিন্দু পুরাণের একজন রাজা ছিলেন। তবে বেশ কয়েকজন শাসক যেমনঃ চন্দ্রগুপ্ত, ধর্মপাল, সম্রাট হেমু প্রমুখ বিক্রমাদিত্য পদবীটি গ্রহণ করেছিলেন। তাই এটি পরিষ্কার নয় যে, ঠিক কার নামে বিক্রমপুরের নামকরণ করা হয়েছিল। বিক্রমপুর নামের ‘‘বিক্রম’’ অর্থ সাহস বা বীরত্ব এবং ‘‘পুর’’ অর্থ নগর বা এলাকা। মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি বিস্তৃত অংশের মানুষজন নিজেদের ঐতিহাসিক বিক্রমপুরের অধিবাসী বলে দাবি করেন। তাদের এই দাবির মৌখিক স্বীকৃতিতেই মুন্সীগঞ্জ জেলা বিক্রমপুর নামে পরিচিতি বহন করছে শত শত বছর ধরে।

বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলা রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধে রয়েছে এর গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ছাত্রজনতা সরকারি অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট করে এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৯ মে পাকবাহিনী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অভিযান চালিয়ে চার শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ৩১ মার্চ পাকবাহিনী নারায়ণগঞ্জে আক্রমণ চালালে মুন্সীগঞ্জের তরুণরা নারায়ণগঞ্জবাসীদের সঙ্গে মিলিতভাবে আক্রমণ প্রতিহত করে। ১১ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা শ্রীনগর থানা, ১৪ আগস্ট লৌহজং থানা নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে টংগিবাড়ী থানা আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। গোয়ালিমান্দ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা ৬ জন রাজাকারসহ সম্মুখ লড়াইয়ে প্রায় ৩৫ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। ২৭ রমজান শবে কদর রাতে ১১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের ওপর সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়ে মুন্সীগঞ্জ শহর দখল করে নেয়। পরে ৪ নভেম্বর টংগিবাড়ী থানা দখল করে এবং ১১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে।

বর্তমানে ঢাকা বিভাগের একটি অন্যতম প্রশাসনিক অঞ্চল মুন্সীগঞ্জ। মোট ৬৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর থানা এলাকায় রয়েছে ২ টি পৌরসভা। জেলার প্রতিটি ইউনিয়ন এবং পৌরসভা জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের একেকটি বিট অফিস। এসব বিট এলাকাগুলোতে ঘটমান সামাজিক অপরাধগুলো তৃণমুল থেকে সমাধানকল্পে থানা পুলিশ সদস্যগণ সর্বদা কাজ করে চলেছেন। ফলে অঞ্চলের আইন শৃংখলার মান দিনে দিনে উচ্চ মানদন্ডে ভূষিত হচ্ছে।

এ জেলার মোট জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ১৫ লক্ষ। এদের সিংহভাগই সাধারণত ব্যবসা পেশার সাথে জড়িত। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ জেলার মানুষের মাঝে প্রবাস জীবন কাটানোর প্রবণতা বেশ লক্ষনীয়। পরিসংখ্যান মতে ৩৪.৬৪ শতাংশ কৃষক, ২.১৭% শতাংশ শ্রমিক, ৪.৬৯% শতাংশ শিল্প, ২৩.১৭% শতাংশ ব্যবসা ৩.৭৫% শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ, ২.২৭% শতাংশ নির্মাণ, ১.১৯% শতাংশ ধর্মীয় সেবা, ১২.৮৭% শতাংশ চাকরি, ৫.৯৫% শতাংশ রেন্ট অ্যান্ড রেমিটেন্স এবং ৯.৩% শতাংশ অন্যান্য মাধ্যম থেকে আয়ের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ শুরু থেকে একটি সম্মৃদ্ধ জনপদ হলেও গত দুই দশকে এ জেলার উন্নয়ন হয়েছে আকাশচুম্বি। জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম, অর্থনীতি ও যোগাযোগ খাতে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা সত্যিই ঈর্ষাণ্বিত করে দেশের অন্যান্য জেলার মানুষকে।
এ জেলার উপর দিয়েই চলে গেছে বহুল প্রশংসিত দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও প্রশস্ততা বিশিষ্ট মহাসড়ক ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এ মহাসড়কটি দিয়েই সংযুক্ত রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কালজয়ী সফলতা স্বপ্নের পদ্মা সেতু। তাই বলা যায় দেশের দ্রুতগতি সম্পন্ন উন্নশীল জেলাগুলোর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ একটি অন্যতম জেলা।

এ জেলার বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৫টি সিমেন্ট কারখানা, ৩টি লবণ কারখানা, ৩টি কাগজ কারখানা, ৬টি জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ টিস্যু, আটা, ম্যাচ ও ৬৭টি হিমাগার শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাছাড়াও দিন দিন নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। তন্মধ্যে বিসিক কেমিক্যাল শিল্পপার্ক, বিসিক বৃহত্তম প্লাস্টিক শিল্পনগরী, বিসিক মুদ্রণ শিল্পনগরী, বিসিক বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন শিল্পপার্ক ও হালকা প্রকৌশল শিল্পনগরীর কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও ইতোমধ্যে বিসিক এপিআই শিল্পপার্ক বাস্তবায়িত হয়েছে। সবগুলো কাজ শেষ হলে মুন্সীগঞ্জ জেলা হবে দেশের মাল্টিসেক্টরাল শিল্পহাব।

অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জ জেলা কৃষি চাষেও বেশ সম্মৃদ্ধ। অঞ্চলের প্রতিটি আবাদযোগ্য মাঠ মৌসুমী ফসল ও সবজিতে পূর্ণ থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে আলু চাষের জন্য খুবই প্রসিদ্ধ মুন্সীগঞ্জ জেলা।

এ জেলার মানুষের শিক্ষার হার প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রায় ২০টি কলেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমের হাজার অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে এ জেলায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। রয়েছে ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯১ সালে জাতীয় পর্যায়ে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নির্বাচিত হয়েছিলো। শিক্ষার ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ জেলার এ গৌরব উদ্দিপণা সৃষ্টি করে অঞ্চলের প্রতিটি শিক্ষালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে।

মুন্সীগঞ্জ জেলা বহু কৃর্তি পুরুষের জন্মভূমি। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা যার হাত ধরে সেই বাঙালি নক্ষত্র জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম এই জেলাতেই। এছাড়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সাতারু কৃর্তিপুরুষ ব্রজেন দাস, কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনসহ অসংখ্য গুণী মানুষের জন্মভূমি এই মুন্সীগঞ্জ জেলা।

মুন্সীগঞ্জ জেলা নানা ঐতিহাসিক স্থানের জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় রয়েছে প্রায় ২০টির মত পুরাকৃর্তি নিদর্শন ও পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব ধর্মীয় মাজার ও দরগা। রয়েছে রাজা শ্রীনাথের বাড়ি, ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি, ইদ্রাকপুর দূর্গা, সোনারং জোড়া মঠ, রামপালের বাবা আদম মসজিদ, হাসারার দরগা, শ্যামসিদ্ধির মঠ, শুলপুরের গির্জা, শ্যামসিদ্ধির মঠ, বিক্রমপুর বিহার ও নাটেশ্বর দেউলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

মুন্সীগঞ্জ জেলার এ সকল ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দৈনন্দিন প্রকাশ পাচ্ছে জেলার আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায়। তন্মধ্যে দৈনিক সভ্যতার আলো, দৈনিক আমার বিক্রমপুর, দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজ, দৈনিক মুন্সীগঞ্জের খবর, দৈনিক রজতরেখা, সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ সংবাদ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সব মিলিয়ে বলা যায়, মুন্সীগঞ্জ জেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও যোগাযোগ খাতে উন্নত একটি ব্যস্ততম নগরী।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।