hqdefault jpg

প্রমত্তা পদ্মার প্রবল ঢেউ, চারিদিকে সবুজের সমারোহ ও দৃষ্টিনন্দন নয়নাভিরাম আধুনিক স্থাপনার শহর, ঢাকা জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এবং আয়তনের বিচারে সবচেয়ে ছোট একটি প্রশাসনিক অঞ্চলের নাম দোহার ।

উত্তরে নবাবগঞ্জ, দক্ষিণে পদ্মানদী, পূর্বে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও পশ্চিমে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা অবস্থিত। ব্রিটিশ ভারত ও পূর্ববর্তী সময়ে এ অঞ্চলটি নীল চাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো। তবে অঞ্চলটি প্রশাসনিকভাবে প্রথম স্বীকৃতি অর্জন করেছিলো ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই। একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর দোহার থানা প্রতিষ্ঠার জন্য গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এবং পরের বছর ১৯১৮ সালের প্রথম দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দোহার থানা পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীয়করণের ফলে ১৯৮৩ সালে দোহারকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। অতঃপর ১২১.৪১ বর্গ কি.মি. আয়তন নিয়ে দোহার একটি পূর্ণাঙ্গ থানা অঞ্চল হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

 

 

পদ্মা নদীর কোল ঘেষে সবুজ ঘোমটা পড়া প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অলঙ্কার গায়ে নাতিদীর্ঘ যে উপজেলাটি অবিরতভাবে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে তার নামই দোহার। “দোহার” শব্দের আভিধানিক অর্থ গায়কের সহকারী বা গায়েনের সঙ্গে ধুয়া ধরে সুর করেন যিনি। দোহারের লোকসাধারণের সাহায্যকারী মনমানসিকতা, অতিথিপরায়নতা ও জীবনচর্চা এই আভিধানিক অর্থটিকেই বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। জানা যায়, এক সময় এ অঞ্চলের হিন্দু জমিদারগণ গীতি গানের ভক্ত ছিলেন। যারা এই গীতিগানে মূলগায়কের সহযোগী হিসেবে গান গাইতেন তাদেরকে স্থানীয়ভাবে দোহার বলা হতো। হিন্দু জমিদারগণ এই সহযোগী গায়েন বা দোহারগণকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। কালের বিবর্তণে সেই বসতি নগরটিই আজ দোহার নামে পরিচিতি বহন করছে।

বর্তমানে দোহার থানা নগরীটি ৯৩টি মৌজার সমন্বয়ে ১৩৯টি গ্রামে বিভক্ত একটি জনপদ। ২০০০ সালে দোহার উপজেলার জয়পাড়া, রাইপাড়া ও সুতারপাড়া ইউনিয়নের আংশিক অংশ মোট ২১.১২ বর্গ কি.মি. আয়তন নিয়ে দোহার পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নের একটি আদর্শিক প্রশাসনিক নগরী দোহার।

দোহারের উল্লেখযোগ্য নদী পদ্মা নদী। একদিকে পদ্মা যেমন দোহারের মানুষের পেশার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে; অপরদিকে তেমনি এই পদ্মার প্রলয়ংকরী রূপ অনেককে করেছে ঘর-বাড়ি হারা। দোহারের অনেক অধিবাসী পড়েছে অস্তিত্বের ঝুঁকিতে। তারপরও পদ্মা তাদের জীবনের অংশ, পদ্মা তাদের প্রাণের স্পর্শ। এখানে বসবাসরত নদী ভিত্তিক পেশাজীবিরা বলেন, ঘর-বাড়ি, ভিটা-মাটি কেড়ে নিলেও পদ্মাইতো আমগো খাওন দেয়, একদিন মাছ শিকার না করলে আমগো কপালে ভাত জুটবো না।

দোহার সীমানার উপর দিয়ে বহমান রয়েছে ইছামতি নদীর শাখা। একসময় এ শাখা নদীটি দোহারের যাতায়াত ব্যবস্থায় অনেক ভূমিকা রাখত। কিন্তু, কালের বিবর্তনে এ নদী অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। আবার ইলশেমারি নামক আরেকটি নদী দোহারের মানুষের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অসংখ্য জলাধারাও প্রবাহিত রয়েছে দোহার অঞ্চলে। তন্মধ্যে অন্যতম আড়িয়াল বিল।

অন্যদিকে দোহারের মৃত্তিকা কিছুটা ক্ষারযুক্ত এবং কিছুটা অম্লযুক্ত নিরপেক্ষ প্রকৃতির। ভূমিগুলো শুষ্ক মৌসুমে খুব অম্লীয় থাকে এবং ভেজা মৌসুমে নিরপেক্ষ থাকে যা সেচের মাধ্যমে আমন ও বোরো চাষের জন্য উপযোগী হয়। বর্ষা মৌসুমে এলাকাটি ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু হয়ে প্লাবিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁধ দিয়ে প্লাবন রোধ করা গেলেও এখনো কিছু কিছু অঞ্চল প্রায়ই পানিবদ্ধ থাকে। তবে মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ভূ-প্রকৃতি খুব শুস্ক হয়ে পড়ে।

দোহার উপজেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে কাঁঠাল, আম, জাম, জামরুল, নারিকেল, সুপারী, তেঁতুল, বড়ই, পেয়ারা, কৃষ্ণচূড়া ইত্যাদি বৃক্ষের সমাহার রয়েছে। তবে বিশেষ কোন বণাঞ্চল গড়ে ওঠেনি দোহার অঞ্চলে। তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করে দোহারে বনায়নের প্রতি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে।

প্রকৃতি, মাটি, আকাশ আর মানুষ নিয়েই দোহার। এ উপজেলায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে পারস্পারিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক শুরু থেকেই। প্রায় ৪০ হাজার পরিবারে বসবাস করছে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। উপজেলাটি সুন্দর পরিবেশ ও বসবাসযাগ্য বলেই হয়তো আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যার ঘনত্ব একটু বেশি। বিভিন্ন বয়স, পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ ও সক্ষমতার মানুষের বসবাস এ উপজেলাকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময়। একসময় কৃষি প্রধান হলেও এ অঞ্চলের অনেক অধিবাসী বহির্বিশ্বে অবস্থান করে এবং তাদের আয়কৃত অর্থের বড় একটি অংশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া জেলে, ব্যবসায়ী, চাকরীজীবীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। অর্থনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। দোহারে তাঁত বিশেষ করে লুঙ্গি শিল্প দেশে ও বিদেশে বিশেষ কদর পেয়েছে। দোহারে উল্লেখযোগ্য চারটি ধর্মের লোকেরই বসবাস রয়েছে যদিও ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পুরো উপজেলা জুড়ে পাচ শতাধীক মসজিদ ও ৬০টি মন্দির রয়েছে। তবে নেই কোন খ্রীস্টীয় উপাসণালয় গীর্জা। তবে ধর্মীয় বিশ্বাসের বাইরে এখানে কিছু লোক মাজার সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। যে ধর্ম বা যে বিশ্বাস বা যে নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্যই হোন না কেন, দোহারের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য আতিথেয়তাপূর্ণ।

পক্ষান্তরে রাজনীতির ময়দানে দোহার বরাবরই সরগরম। এখান থেকে উঠে এসেছে জাতীয় পর্যায়ের অনেক রাজনীতিবীদ ও কলাকুশলী। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের বহুমুখী রাজনীতি, সবক্ষেত্রেই এলাকার জনগণের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রয়েছে। অবিভক্ত বাংলার নেতৃত্বে যেমন এ অঞ্চলের সূর্য সন্তানদের অংশগ্রহণ নজর কাড়ে, তেমনি স্বাধীন বাংলার নেতৃত্বেও দোহারের সূর্য সন্তানেরা পিছিয়ে নেই। তন্মধ্যে বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, বিংশ শতাব্দীর একজন সাম্যবাদী ধারার কবি জনাব মহীউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী সালমান ফজলুর রহমান, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা অন্যতম। তাছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান খান কামালের পিতৃভুমিও এই দোহার উপজেলায়।

কথিত আছে দোহারেই বাংলাদেশের প্রথম নাটক মঞ্চন্থ হয়। দোহারে পারিবারিক পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় পর্যস্ত সংস্কৃতি চর্চার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকলেও শিক্ষাক্ষেত্রে দোহারে এখনো যেতে হবে অনেক দূর। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু মানুষের উত্থান এখান থেকে হলেও সরকারি হিসেব মতে, দোহারে সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ। এ উপজেলার মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২০টি, বিভিন্ন মাধ্যমের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬০টি, রয়েছে সর্বমোট ৫০টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রায় ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগীয় মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উলেখ্য, দোহার উপজেলার মোট মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০টি। যা উপজেলা আয়তনের বিচারে শিক্ষা বিস্তারের ঈর্ষাণ্বিত সংখ্যা।

দোহারে সাম্প্রতিককালে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধার ব্যপক পরিবর্তন ঘটেছে। এখানে একটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর পাশাপাশি প্রায় ৩০টি সরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র ও বেসরকারি পর্যায়ে ১০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যদিও গুণগত মানের দিক থেকে অনেক প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে এখনো। কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে এ মাধ্যমটির অসংগতিগুলো রোধ করা সময়ের দাবি।

ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী এ ছোট উপজেলাটির অধিবাসীগণ নিকটবর্তী শহরের সাথে সড়কপথেই যাতায়াত করে থাকেন। বিভিন্ন বেসরকারী পর্যায়ের বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। পূর্বে জলপথই প্রধান যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু গত প্রায় দুই দশক ধরে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

দোহারের অর্থনীতি মুলত কৃষি, তাঁত শিল্প এবং বিদেশী রেমিট্যান্স এই তিনটি প্রধান বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এখানকার জনবসতির অনেকে বিদেশ তথা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে কৃষিখাত থেকে আয় ৫২.৬৪ ভাগ, কলকারখানা থেকে আয় ১১.০৪% ভাগ এবং দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে চাকরী পেশা থেকে ৩৬.৩২ ভাগ আয়ের যোগান দেয়। স্থানীয় কল-কারখানার মধ্যে অন্যতম সুতার কল। তাছাড়া এ অঞ্চলে মোট ৭৮১ ধরনের কুটিরশিল্প এবং তিনটি মধ্যম মাত্রার ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে।

ঢাকার অদূরে অবস্থিত দোহারের পদ্মার পাড় দিয়ে হেঁটে গেলে যেকোন পর্যটকের ভ্রম হতেই পারে এই ভেবে যে, এটাই বুঝি সমুদ্র সৈকত। মিনি কক্সবাজার খ্যাত মৈনট এখন দোহারের গর্ব করার মতো দর্শনীয় স্থান; রয়েছে মিনি পতেঙ্গা খ্যাত বাহ্রা, কোঠাবাড়ি বিল, নারিশা পদ্মার পাড়, আরিয়াল বিল, মুকসুদপুরের ডাক বাংলো, দুবলী টু নবাবগঞ্জ রোড, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, বাবু বাড়ির পুকুর ও সাইনপুকুর বড়বাড়ি। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামের ভেতর দিয়ে সবুজ বনানী, হলুদ শরষে ক্ষেত, ধানী ক্ষেতের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা আইল। এসবের সবই নাগরিক মানুষকে আহ্বান জানায়।

তাছাড়াও ইতিহাসের পাতায় যুক্ত গান্ধী সড়কের অবস্থান এই দোহারে। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে গান্ধীর আদর্শে এখানে গড়ে তোলা হয় অভয় আশ্রম। ১৯৪০ সালে মালিকান্দা নামক গ্রামে গান্ধী সেবা সংঘের সর্বভারতীয় সম্মেলনে এখানে আগমন ঘটে মহাত্মা গান্ধীর। তিনি দুই দিন এখানে অবস্থান করেছিলেন। তার স্মৃতি রক্ষায় এখানকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয় ‘গান্ধী সড়ক’ নামে।

সর্বপরি ভালো-মন্দের চিত্রে চিত্রায়িত দোহার একদিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখে মাথা উঁচু করেছে; অপরদিকে বিভিন্ন সময় কৃত্রিম বৈষম্য তৈরি করে নিন্দিত হয়ে পিছিয়ে পড়েছে। যা প্রতি মুহুর্তে প্রকাশ পাচ্ছে দেশের অগনিত গণমাধ্যমসহ দোহারের আঞ্চলিকসব গণমাধ্যমে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।