“সোনালি আঁশে ভরপুর, ভালোবাসি ফরিদপুর” এই শ্লোগানে পদ্মা নদীর দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত দেশের প্রাচীন জেলাসমুহের অন্যতম একটি জেলার নাম ফরিদপুর। ঢাকা থেকে এ জেলা দুরত্ব মাত্র ১৩০ কি.মি। মূলত এটিই ঢাকা বিভাগের পশ্চিম সীমান্তের সর্বশেষ জেলা। ১৮১৫ সালে ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে এ জেলাটি গঠিত হয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ব্রিটিশদের আদলেই ফরিদপুর জেলা গঠন করা হয়। তৎকালে গোয়ালন্দ, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি মহকুমা নিয়ে ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা।

অনেক আউলিয়া-দরবেশ, রাজনীতিক ও পূণ্যাত্মার আবাসভূমি হিসেবে এ অঞ্চল অত্যন্ত সুপরিচিত। ইতিসের মানচিত্রে এ জেলার পূর্বনাম পাওয়া যায় ‘‘ফতেহাবাদ’’। পরবর্তীতে প্রখ্যাত সাধক এবং দরবেশ খাজা মাইনউদ্দিন চিশতী (রহ:) এর শিষ্য শাহ ফরিদ (রহ:) নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয় ফরিদপুর। তবে ১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরিদপুরের তৎকালীন নাম পাওয়া যায় জালালপুর। পরবর্তীতে ১৮০৭ খ্রিঃ ঢাকা জালালপুর হতে বিভক্ত হয়ে এটি ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে। এর প্রায় ৬০ বছর পর অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে ফরিদপুর পৌরসভার স্বীকৃতি লাভ করে।

 

 

১৯৪৭ এর পর পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশেকে যে ২৩ টি জেলায় ভাগ করা হয় তার মধ্যে একটি ছিল ফরিদপুর। পরবর্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৪ সালে জেলা পুনর্বিন্যাসের ফলে বৃহত্তর ফরিদপুরকে ভেঙে গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এই ৫টি জেলায় রুপান্তর করা হয়।

বর্তমান ফরিদপুর জেলার আয়তন ২০৭২.৭২ বর্গ কিলোমিটার। এ জেলার উত্তর সীমান্ত দিয়ে বয়ে গেছে দুইটি বড় নদীঃ পদ্মা ও মেঘনা। আর এই নদী দুটির শাখা নদী তথা ভুবনেশ্বর, আড়িয়াল খাঁ, নীলখীর খাল ইত্যাদিসহ বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে আছে জেলা জুড়ে। তেমনই একটি শাখা নদীর নাম কুমার। এই কুমার নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক এই ফরিদপুর শহর।

এ জেলার রয়েছে অনেক কীর্তিময় গৌরব-গাঁথা গল্প। ৭১ এ যারা রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছিলো আমাদের স্বাধীনতা, তাদের মধ্যে অন্যতম বীরশ্রেষ্ট খেতাবপ্রাপ্ত মুন্সি আবদুর রউফ স্মৃতি যাদুঘর ও পাঠাগার রয়েছে এই জেলাতেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এ স্থাপনাটি এখন দেশপ্রেমিকদের কাছে একটি বিশেষ স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর রেলষ্টশনের উত্তরে কুমার নদীর দক্ষিণে গোবিন্দপুর গ্রামে রয়েছে, ছন্দে ছন্দে কবিতা গেথে, বাংলার পরতে পরতে মাটির মানুষ নিয়ে কথা বলার কবি, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর বাড়ি ও জসীম উদ্দিন যাদুঘর। চারটি পুরাতন টিনের চালা ঘর, ঘরের অভ্যান্তরে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রগুলো এখন কেবলই মনে করিয়ে দেয়, কবির সরল ও সাধারন জীবন যাপনের কথা। বাড়ীর চত্ত্বরে প্রদর্শন করা রয়েছে কবির লেখা, বিভিন্ন ছন্দ, কবিতা ও গান। কবির সেই জনপ্রিয় কবিতাটি এখানে আসলেই ভীষনভাবে মনে পড়ে।

এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

বাড়ির উত্তর পার্শে এ কবিতার অংশখানি এখন লটকানো রয়েছে কবির সমাধিত স্থলে।

পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের মত কালজয়ী বহু গুনী ব্যাক্তির আপন শহর ফরিদপুর জেলা। ৯০ দশকের প্রখ্যাত প্রায় দশজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্মভুমি এ ফরিদপুরের মাটি। নায়ক, গায়ক, চিত্রশিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, সংগ্রামী পুরুষ, রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বসহ প্রায় শতাধিক কৃর্তিপুরুষের আপন শহর এই ফরিদপুর জেলা।

প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি তথা বাইশরশি জমিদার বাড়ি’ বা রাজেন্দ্র বাবুর বাড়ির অবস্থানও এই ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার বাইশরশি গ্রামে। প্রায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ১৪টি অট্টালিকার বিশাল এ প্রাসাদটি ফরিদপুর জেলার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এটিই এ জেলার অন্যতম প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়াও এ জেলা জুড়ে রয়েছে চিত্তাকর্ষক হিসেবে বিবেচিত প্রায় ২০টি বিশেষ স্থান। উল্লেখ্য, দেশের একমাত্র নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (আরআরআই) এর অবস্থান রয়েছে ফরিদপুর জেলার হাড়োকান্দি গ্রামে।

মোট ৯টি উপজেলায় বিভক্ত ফরিদপুর জেলার থানা সংখ্যা ৯টি। রয়েছে ৫টি পৌরসভা ও ৮১টি ইউনিয়ন। বৃহৎ এ জেলার গ্রামের সংখ্যা সর্বমোট ১৮৮৭টি। আর জনসংখ্যা মোট ১৯,৮৮,৬৯৭ জন।

বর্তমানে এ জনসংখ্যার মোট ৭৩ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আলো পেয়েছে। যদিও দিন দিন ফরিদপুর জেলাটি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ সম্মৃদ্ধির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৮৩টি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫০টি। এবং মহা বিদ্যালয়ের সংখ্যা মোট ৩১টি। তাছাড়া প্রায় দেড় শত বিভিন্ন মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ফরিদপুর জেলা জুড়ে।

অন্যদিকে জেলার স্বাস্থ্যখাতেরও যথাযথ উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়। নতুন নতুন গড়ে ওঠা নানাবিধ ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ফরিদপুর জেলায় সরকারিভাবে গড়ে উঠেছে মোট ৮৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। যা একটি জেলার জন্য অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

এ জেলা অর্থনৈতিক ভাবেই বেশ সম্মৃদ্ধ। এ জেলায় রয়েছে চিনিকল, পাইপ ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল মিল, জুট মিলসহ প্রায় সহস্রাধিক মাঝারি ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া পদ্মাসেতু চালু হওয়ার কারণে জেলার অর্থনীতি আরও গতিশীল হচ্ছে। তবে এ জেলায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন পাট, মসুর ও পেয়াজের দানা বাংলাদেশের শীর্ষস্থান অধিকার করছে। এছাড়া শীতের ঋতুতে খেজুর রস ও আসল খেজুর গুড় রপ্তানীতে ফরিদপুর জেলার মানুষের সুনাম রয়েছে দেশ জুড়ে। প্রকৃতির নানান রুপে সজ্জিত এ জেলার পল্লী নগর প্রান্তর। মৌসুমী ফসল ঘরে তোলার ধুম পড়ে এই পল্লী জনপদে। বিশেষ করে সোনালী আঁশ পাট কাটার মৌসুমে এখানখার জনপদ সোনালী আঁশ উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তা, খাল-বিলে তখন নারী-পুরুষ একযোগে পাটের আঁশ উত্তোলন করে দেশের প্রধান অর্থকরি ফসল ঘরে তোলে।

অন্যদিকে ক্রীড়াঙ্গনেও এ জেলা পিছিয়ে নেই। এ জেলার ক্রীড়া প্রেমী মানুষদের খেলা-দোলার জন্য জেলায় নয়টি উপজেলা জুড়ে রয়েছে মোট সাতটি স্টেডিয়াম। যোগাযোগ খাতেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে বৃহত্তম এ নগরের।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।