maxresdefault 11 jpg

১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ১১৪৪.৯৬ বর্গ কি.মি. আয়তন নিয়ে একটি সুসংগঠিত জেলার জন্ম হয় যার নাম মাদারীপুর। পঞ্চদশ শতাব্দীর সুফি সাধক কুতুব-ই-জাহান হযরত বদিউদ্দীন আহমেদ জিন্দা শাহ মাদার রহমাতুল্লাহ এর নাম অনুসারে মাদারীপুর জেলার নামকরণ করা হয়। তৎকালে এ অঞ্চলটি বর্তমান বরিশাল জেলার সাথে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু কাল পরিক্রমায় অঞ্চলের প্রশাসনিক গুরুত্ব বেড়ে গেলে ১৮৫৪ সালে মাদারীপুরকে মহকুমা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সময় মাদারীপুর থানা গঠনের মাধ্যমে প্রথমবারের মত অঞ্চলটি প্রশাসনিক স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮৭৫ সালে উক্ত মহকুমাকে বৃহত্তর বরিশাল জেলা হতে বিচ্ছিন্ন করে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এর দীর্ঘকাল তথা ১০৮ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্টিত হলে ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা থেকে পৃথক হয়ে মাদারীপুর অঞ্চলটি স্ব-গৌরবে একটি জেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

মুলত তখন থেকেই শুরু হয় মাদারীপুর জেলা পুলিশের কার্যক্রম। স্থাপন করা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়, মাদারীপুর। উল্লেখ্য, মাদারীপুর জেলা পুলিশের অধীনে রয়েছে ০৫ টি থানা তথা শিবচর, রাজৈর, কালকিনি, ডাসার থানা ও মাদারীপুর সদর মডেল থানা। রয়েছে ০৬টি তদন্ত কেন্দ্র তথা- ভদ্রাসন, আঙ্গুলকাটা, নীলক্ষী, দত্তপাড়া, শ্রীনদী ও খাসেরহাট তদন্ত কেন্দ্র। এছাড়াও রয়েছে ০৩টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ২টি পুলিশ ক্যাম্প। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে কালকিনি থানা থেকে পৃথক হয়ে ৭৬.৮ বর্গ কি.মি. আয়তন নিয়ে ডাসার নামে একটি আলাদাভাবে থানা গঠিত হয় এবং পরে ২০২১ সালের ২৬ জুলাই উক্ত থানাটি উপজেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। যা দেশের নবগঠিত উপজেলা সমুহের মধ্যে সর্বশেষ উপজেলা হিসেবে স্বীকৃত।

 

 

মাদারীপুর জেলার মোট আয়তন ১,১৪৪.৯৬ বর্গ কি.মি। রয়েছে ৫৯ টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা অঞ্চল। সর্বমোট ১০৬২টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত মাদারীপুরের মোট জনসংখ্যা ১২,১২,১৯৮ জন। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮৭.৮০ ভাগ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং ১২.১০ ভাগ জনগোষ্ঠী সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করে। তাছাড়াও প্রায় ১১০০ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছে মাদারীপুর জেলায়। যা মোট জনসংখ্যার .০৬ শতাংশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাধে কাধ মিলিয়ে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে সকলে মিলে একসাথে বসবাস করে এ জেলার মানুষ। তাদের এই মিলবন্ধন-ই মাদারীপুরের এক অনন্য পরিচিতি ধরে রেখেছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী মাদারীপুর জেলা জুড়ে মোট ৩৩৬৬টি মসজিদ এবং ৩৩০টি মন্দির, ৭টি গির্জা ও ৩টি মাজার রয়েছে।

মাদারীপুর জেলা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সৃষ্টি হলেও এ জেলা জুড়ে রয়েছে প্রায় ১৫টি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। যার মাধ্যমে মাদারীপুরের গৌরবাণ্বিত অতীত বিশ্বকে জানান দিচ্ছে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহুর্তে। এর মধ্যে অন্যতম, মাদারীপুর সদর উপজেলার ৩০০ বছরের পুরোনো আলগী কাজি বাড়ি মসজিদ।

সদর উপজেলার ঝাউদিতে অবস্থিত রয়েছে ঝাউদিগিরি নামে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন পুরাকীর্তির নিদর্শন। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে এ গিরি মগ আমলে নির্মিত ২০ ইঞ্চি ইট-সুরকির গাথুনীর উপর প্রতিষ্ঠিত ১০০ ফুটের অধিক উচ্চতাসম্পন্ন একটি স্থাপনা।
মিঠাপুর গ্রামে রয়েছে দেশের আরেকটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন মিঠাপুর জমিদার বাড়ি। এর সুনিপুণ নির্মাণশৈলী ও সূক্ষ্ম টেরাকোটার কারুকাজ এখানে আগত পর্যটকদের এক মুহুর্তেই মুগ্ধ করে তোলে।

জেলার রাজৈর উপজেলায় রয়েছে রাজা রাম মন্দির। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এ মন্দিরটি ২৩ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত দ্বিতল চারচালা ঘরের আদলে নির্মিত এক অন্যরকম প্রাচীণ স্থাপনা। রয়েছে মোট ৯টি কক্ষ।

এ উপজেলার বাজিতপুরে রয়েছে অগ্নিযুগের একজন বিশিষ্ট বিপ্লবী এবং বীর সাধক এর নামে প্রতিষ্ঠিত প্রণব মঠ।

এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্মৃদ্ধ মাদারীপুর জেলার জনপদ ভৌগলিক কারণে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই প্লাবিত হয়ে পড়ে। অঞ্চলের খাল বিলগুলো তখন থৈ থৈ পানিতে ভাসে। তবে বর্ষা মৌসুম শেষ হবার সাথে সাথে কৃষি অঞ্চলগুলো কৃষকের উম্মাদনার মধ্য দিয়ে জেগে ওঠে। ধান, পাট, সরিষা ও আঁখ এই চারটি প্রধান শস্য উৎপাদনের মাধ্যমেই মাদারীপুর অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মোট ৬১.৩৩ শতাংশ আয় নিরুপণ হয়।

উল্লেখ্য, মাদারীপুরের খেজুর গুড়, পাট ও পাটজাত দ্রব্য সারাদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।

এ জেলায় শিল্প ও কলকারখানা তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। যে কয়টি শিল্প ও কলকারখানা রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মাদারীপুর স্পীনিং মিলস, আলহাজ্জ আমিনউদ্দিন জুট মিলস, চরমুগরিয়া জুট মিলস, ও এ.আর. হাওলাদার জুট মিলস, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত এ মিলটি বর্তমানে পরিত্যাক্ত রয়েছে। এ ছাড়া এ জেলায় ৬০০০ মে. টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি কোল্ড স্টোরেজ সহ প্রায় শতাধিক ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

মাদারীপুর জেলার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নদী। পদ্মা , আড়িয়াল খাঁ, কুমার ও পালরদী এ চারটি জেলার প্রধান নদী। এছাড়া জেলা জুড়ে রয়েছে ১১টি প্রধান বিল। অন্যান্য ছোট খাল-বিলগুলো এখন সম্পূর্ণই মৃত ও বিলুপ্তপ্রায়।

জেলার ভূ-গঠনে পদ্মা , আড়িয়াল খাঁ, কুমার ও পালরদী নদীগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ভূ-ভাগ বেলে-দোআঁশ মাটি দ্বারা গঠিত। তবে চরাঞ্চল এলাকায় বেলে মাটির আধিক্য অত্যন্ত বেশি। পশ্চিম-উত্তর, পূর্ব-উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের ভূ-ভাগ পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, ময়নাকাটা এবং তার শাখা-প্রশাখার ব্যাপক ভাঙা-গড়ার কারণে এ জেলার জনপদ একাধিকবার পুনর্গঠিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। বস্তুত এ নদীগুলোর লালনে-পালনে গড়ে উঠা এ জেলা, প্রকৃতির বিচিত্র লীলায় লীলায়িত, ভাঙা-গড়ার অভিজ্ঞতায় বিকশিত এক বিস্ময়কর ঐতিহ্যের স্মারক।

রাজধানী ঢাকা থেকে মাদারীপুর জেলা সদর মাত্র ৮৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশের অন্যান্য জেলার সাথে সড়ক ও নৌপথে মাদারীপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের পর এ জেলার যোগাযোগ খাত আরও গতি পেয়েছে।

অন্যদিকে মাদারীপুর তুলনামুলক ভাবে পিছিয়ে আছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে। তিনটি সরকারি মহাবিদ্যালয়সহ মোট প্রায় সাড়ে নয়শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ জেলার শিক্ষার হার মাত্র ৪৮ শতাংশ।

আর স্বাস্থ্য খাতে রয়েছে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি জেনারেল হাসপাতাল ও বর্তমানে জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর চাহিদা থাকলেও রয়েছে মাত্র তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যদিও এ সংকট পূরণে কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ চলমান রয়েছে।

অন্যদিকে জেলার ভালো-মন্দের সকল খবরাখবর প্রকাশে আঞ্চলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক গণমাধ্যম। এসব গণমাধ্যমে নিয়মিতই প্রকাশ পাচ্ছে মাদারীপুর জেলার স্থানীয় রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জেলার নানান অসংগতি।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।