Sobuj Sonket Raigonj jpg

করতোয়া, ইছামতি ও বাঙ্গালী নদী ঘেরা ২৬৭.৮৩ বর্গ কিমি আয়তনের রায়গঞ্জ তখন ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ নগরী হয়ে উঠেছে। কিন্তু বৃহত্তর এই অঞ্চলে তখনত কোন থানা প্রতিষ্ঠা হয়নি।

মুলত তখন এটি পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত একটি জনপদ ছিলো। সেকাল থেকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাহিত্যের দিক থেকে যথেষ্ট বৈশিষ্টপূর্ণ ও সুপরিচিত ছিলো বলে ধারণা পাওয়া যায়। অবশেষে সময়ের প্রযোজনীয়তা বিবেচনা করে ১৯৩৭ সালে এই জনপদে রায়গঞ্জ থানা নামে একটি পুলিশ স্টেশন স্থাপন করা হয়।  পরবর্তীতে  স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালে রায়গঞ্জ থানা নগরীকে উপজেলা নগর হিসেবে ঘোষনা করা হয়।  পরবর্তীতে ২০০১ সালে এ নগরীর তিনটি ইউনিয়নকে কর্তন করে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ থানার সৃষ্টি হয়। নতুন সৃষ্ট থানা সীমানা ব্যাতিত রায়গঞ্জ থানা নগরীর বর্তমান হালচাল নিয়েই নির্মিত হয়েছে সবুজ সংকেতের আজকের প্রামাণ্যচিত্র।

রাজশাহী বিভাগের অন্যতম জেলা সিরাজগঞ্জ। এ জেলার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ২২ কি.মি. উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরন্তর পল্লী জনপদটির নাম রায়গঞ্জ উপজেলা। উপজেলার মোট আয়তন ২৬৭.৮৩ বর্গ কিমি। এবং বাস করে মোট ২,৮০,৪৪৫ জন মানুষ। উপজেলার মোট ইউনিয়ন সংখ্যা ৯টি, পৌরসভা ১টি, গ্রামের সংখ্যা ৩০৪টি এবং মৌজার সংখ্যা ১৯৩টি।  উপজেলা প্রতিষ্ঠাকাল  থেকে ২০০১ সাল অবধি রায়গঞ্জ উপজেলা মাত্র একটি থানা সীমানার আওতাভুক্ত থাকলেও পরে রায়গঞ্জের তিনটি ইউনিয়ন তথা ঘুড়কা, নলকা ও ধুবিল ইউনিয়ন এবং ও পার্শবর্তী উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে সলঙ্গা নামে নতুন আরেকটি থানার সৃষ্ট হয়। অর্থাৎ উপজেলার মোট ৬টি ইউনিয়ন তথা ধামাইনগর, সোনাখাড়া, পাঙ্গাসী, ব্রহ্মগাছা, চান্দাইকোনা এবং ধানগড়া ইউনিয়ন ৬টি রায়গঞ্জ থানা এলাকা এবং ধুবিল, নলকা ও ঘুরকা ইউনিয়ন তিনটি সলঙ্গা থানা থানা এলাকা হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রায়গঞ্জ থানা সীমানার বর্তমান আয়তন ১৭৭.৬৪ বর্গ কি.মি.।

বর্তমানে রায়গঞ্জ থানার আওতাধীন রয়েছে ৬টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা, ১৪০টি মৌজা এবং ২১৬টি গ্রাম। রায়গঞ্জ একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল। এখানকার মোট  ৫৬,৫৩৪ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই কৃষির সাথে জড়িত।

তাছাড়া বর্তমানে রায়গগঞ্জে ব্যাপক উদ্যোক্তার সমাহার ঘটেছে। চাকুরী না পেয়ে দীর্ঘদিন বেকারত্বের অভিশাপে না থেকে এ অঞ্চলের সচেতন তরুণরা কেউ মৎস চাষ, কেউ পল্ট্রি খামার, কেউবা গবাদি পশুর খামার করে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের উর্ধগতির এ সময়ে অনেকেই সেই ভাগ্যের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। তারা বলেন বর্তমানে আয় এবং ব্যয়ের সামঞ্জস্য  ধরে রাখতে না পারায় দিন দিন অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্যকে যে কয়টি জেলা বাঁচিয়ে রেখেছে তার মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ এর নাম সুপ্রশংসিত। এখানকার প্রায় প্রতিটি গ্রামে এ শিল্প ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁতিরা তাঁদের হস্তচালিত তাঁতে মান্ধাতা আমলের ডিজাইনে তাঁতবস্ত্র তৈরি করে আসছেন। তাঁতশিল্প এ উপজেলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকার পালন করে। পরিসংখ্যান মতে রায়গঞ্জের  প্রায় ২৫ হাজার মানুষ এই ঐতিহ্য মন্ডিত তাত শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছেন।

 

রায়গঞ্জ থানার ৬টি ইউনিয়নের  প্রতিটি প্রধান এলাকাতেই রয়েছে প্রসিদ্ধ একটি করে হাট বা বাজার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রায়গঞ্জ, নিমগাছী, ধানগড়া, চান্দাইকনা, পাঙ্গাশী বাজার ও ধামাইনগর হাট।সপ্তাহ জুড়ে এসব হাটেই স্থানীয় অর্থনীতির পরিমাপ ঘটে। তাছাড়া স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তথা বাজারের স্থায়ী দোকানদারগণ  এখানকার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের অর্থনৈতিক লেনদেন এর জন্য উপজেলার প্রধান শহরে গড়ে উঠেছে ৭টি ব্যাংক শাখা ও কিছু এনজিও প্রতিষ্টান।

 

রায়গঞ্জ থানার উপর দিয়ে বয়ে গেছে দুটি ছোট নদী যথা ফুলজোড় ও ইছামতি। এ দুটি নদী রায়গঞ্জ এর জনজীবনে এবং অর্থনীতিতে ব্যপক  ভুমিকা রাখে। সেই সাথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য়ে ভরিয়ে তোলে গোটা রায়গঞ্জকে।

এখানকার একেকটি গ্রামের সৌন্দর্য যেন নকশী কাথার সুতোয় গাথা একেকটি  সাজ গাথুনি। উপরে উন্মুক্ত আকাশ আর নীম্নভূমি শীতল মাটি! এর উপর দিয়ে খেলা করে পল্লীর শিশুরা। পথ-ঘাট বা খেলার মাঠে তাদের চড়ে বেড়ানো যেমনি সুন্দর তেমনি তাদের সুস্থ্য থাকতে আহার যোগায়।

রায়গঞ্জে কোন বিশেষ খেলার মাঠ বা স্টেডিয়াম নেই। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক কিছু খেলার মাঠ রয়েছে। এসব মাঠেই ক্রিড়াপ্রেমীরা দৈনন্দিন শরীরচর্চা করে থাকে। উল্লেখ্য, রায়গঞ্জ থানা অঞ্চল একটি শিক্ষা বান্ধব নগরী। শতকরা ৮৭ শতাংশ মানুষই এখন শিক্ষার আলোতে বেড়ে উঠছে।  পরিসংখ্যান মতে উপজেলার মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮১টি।  রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা  মোট ১০০টি, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাঃ  ২৪টি এবং কেজি স্কুল ২৭টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার  ৯৬.৩৫ শতাংশ। এই হার থেকে পরে মাধ্যমিক স্কুল অতিক্রম করতে করতে প্রায় ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। যা গত দুই দশক পূর্বে ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিলো। রায়গঞ্জ উপজেলায় রয়েছে মোট ৪৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৯টি মহাবিদ্যালয় এবং ৭২টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে প্রায় অর্থশত সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা মাধ্যমসহ একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

 

রায়গঞ্জ উপজেলার মানুষ অত্যান্ত মিশুক প্রকৃতির। তারা সহজ জীবন যাপন করতে পছন্দ করে। আগন্তুক কোন অতিথি পেলে তারা ভিষন খুসি হয় এবং নানা আপ্পায়ানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রায়গঞ্জ থানা সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের অন্তর্ভুক্ত একটি নির্বাচনী এলাকা।

এ অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিক  ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী। এর ফলে মাঝে মধ্যে স্থানীয়ভাবে কিছু হট্টোগোলের সৃস্টি হয়। অন্যদিকে রায়গঞ্জ হিন্দু-মুসলিম অদ্যাসিতু অঞ্চল হলেও অঞ্চলটি সম্পূর্ণ সামপ্রদায়িক দাঙ্গা মুক্ত। মুসলীমদের জন্য রয়েছে ৫৬৮টি মসজিদ ও হিন্দুদের জন্য রয়েছে ৫৪টি মন্দির। এছাড়াও রয়েছে একটি গীর্জা তথা খ্রীষ্টীয় তীর্থস্থান।

এককালে রায়গঞ্জ এলাকাটি তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদার রায় পরিবারের পুরোধা শ্রীমান হরিদাশ রায় ঠাকুরের অঞ্চল ছিলো। তার নাম থেকেই রায়গঞ্জ নামের উৎপত্তি। তৎকালে এ অঞ্চলে হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। ফলে অত্র বিভিন্ন গ্রাম ও মহল্লার নাম হিন্দু ও তাদের দেব দেবীর নামানুসারেই পরিচিত আছে।  ইতিহাসের সেই ধারক ও বাহক হয়ে এখনো ঠাই দাড়িয়ে আছে রায়গঞ্জ সান্যাল জমিদার বাড়ীর শিব দুর্গা মন্দির ও মকিমপুর জমিদার বাড়ীর মন্দির এবং আটঘরিয়া জমিদার বাড়ী।

তাছাড়াও রায়গঞ্জ উপজেলায় রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহাসিক তিনটি দিঘি। যা পাল সম্রাজ্যের দ্বিতীয় গোপাল নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

রায়গঞ্জে বেশ কয়েকটি মাজার বা দরবার শরীফ রয়েছে। তার মধ্যে ভোলা দেওয়ানের মাজারটির বেশ পরিচিতি পেয়েছে দেশের মাজার প্রেমীদের কাছে। উপজেলা সদর হতে মাত্র ১২কি. মি. দূরে সোনাখাড়া ইউনিয়ন পরিষদের দক্ষিন পাশে ভোলা দেওয়ান মাজারের অবস্থান।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।