Sobuj Songket Thumbnail Template do not delete 2 jpg

বাবলা , নল , ঢোল কলমি , সিমুল ও খেজুরের ঘন ষ্টেন্ডে ঢাকা বিশাল জলাভূমি । এখানে বাস করে সাত প্রজাতির ব্যাঙ এবং এক প্রজাতির টড উভচর প্রাণী। পরিসংখ্যান মতে মোট ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে এ জলাভুমিতে, যার মধ্যে দশটি কচ্ছপ ও কাছিম, নয়টি টিকটিকি এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এবং ১২টি গোত্রের মোট ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর সন্ধান রয়েছে এই বৃহত্তর জলাভূমিতে। এটি দেশের সর্ববৃহত চলনবিল। মো ২৩টি ছোট ছোট বিলের সমস্টির এই জলাভূমির একাংশ জুড়ে সীমানা দখল করেছে দেশের অন্যতম একটি উপজেলা যার নাম তাড়াশ।  তাড়াশ উপজেলা বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। যা ১৯৭১ এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল।

ব্রিটিশ শাসনকালে তাড়াশ অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনায় তৎকালীন প্রশাসন এখানে একটি থানা প্রতিষ্ঠা করেন।

যা ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের প্রশাসনিক পুনবিন্যাসের অংশ হিসেবে উপজেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

পজিটিভ থিংক এর আজকের পর্বটি তাড়াশের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বর্তমান  প্রেক্ষাপটে  জনজীবনের বাস্তব চিত্র নিয়ে সাজানো হয়েছে।

রায় উপাধিতে ভূষিত জমিদার, সম্ভ্রান্ত কায়স্থ ও নাগ বংশীয় দেবতার পুজারী এবং মোঘল-নবাবী আমলের মুসলীম ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ ভূমি মানচিত্র তাড়াশ। একদা তাড়াশের চলনবিল এলাকা ছিলো ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ভয়ংকর প্রাণীদের আবাস ভূমি। জমিদার বনমালী রায় বাহাদুর চলনবিলকে জঙ্গল ও বন্য জন্তুর কবলমুক্ত করার লক্ষ্যে ভারতের ছোট নাগপুরের সাঁওতাল পরগনা হতে অনেক সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসীকে এনে তাড়াশ থানা অঞ্চলে তাদের বাসস্থান করে দেন। তাদের  মধ্যে সিং, উরাঁও ও মাহাতো উল্লেখযোগ্য। পরিসংখ্যান মতে বর্তমানে তাড়াশ অঞ্চলের আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০। সরকারি তথ্যানুসারে উপজেলার মোট জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় দুই লক্ষ।

জেলা শহর সিরাজগঞ্জ থেকে তাড়াশ উপজেলার দুরুত্ব প্রায় ৪০ কি.মি.। উপজেলা শহর থেকে ৭ কি.মি. দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক। এ মহাসড়কের ১৬ কি. মি. পথ তাড়াশ থানা সীমানাধীন।

এটি জেলার সবচেয়ে সুন্দর পল্লী নগর। ভৌগলিক কারণেই এর সৌন্দর্য এতটা আকর্ষনীয়। কারন ২৯৭.২০ বর্গকিমি আয়তনের এক তৃতীয়াংশই দখল করে আছে দেশের তথা ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় জলাভুমি চলনবিল। এ জলাভূমি বিশিষ্ট জনপদ তথা তাড়াশ এর প্রাকৃতিক সৌর্যের পরিপূর্ণতা ফুটে ওঠে বর্ষাকালে। তখন চারিদিকে থৈ থৈ করে অথই পানি। তার মাঝে দেখা যায় গুচ্চগ্রাম বিশিষ্ট ঘরবাড়ি। বাড়ির আঙ্গিনা জুড়ে দেখা যায় নানা প্রকারের গাছ-গাছালি। সত্যি এক অন্যরকম অনুভুতি শিহরিত হয় বর্ষা মৌসুমের তাড়াশ নগর। তাড়াশ একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। এর একটি বৃহৎ অংশ চলনবিলের মধ্যে অবস্থিত থাকায় এখানে ধান এবং মাছের প্রাচুর্য রয়েছে। তছাড়া অঞ্চল জুড়ে অনেক কৃত্তিম পুকুর রয়েছে। ফলে মাছ এবং খাদ্যশষ্য এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস।

বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যায়। টেংরা, পুটি, রুই, কই, ষোল, বোয়ালসহ ছোট বড় প্রভৃতি জাতের মাছে ভরপুর হয়ে ওঠে তাড়াশ অঞ্চল। জেলেরা সারারাত বিলে মাছ ধরে এবং ভোর হওয়ার আগেই সেগুলো মহিষলুটি নামক বাজারে বিশাল মাছের আড়তে গিয়ে বিক্রি করে। আড়ৎ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা সীমানায় পৌছে যায় তাড়াশের দেশীয় জাতের সুস্বাদু মাছগুলো। যা দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পুরণে পর্যাপ্ত সহায়তা করে।

তাড়াশ ও অন্যান্য উপজেলাযধীন চলন বিল থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ দেশ-বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে। তাছাড়া আরও প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ আহরণ করা হয় এই চলন বিল থেকেই। কোন কারণে এই বিলে মাছের পরিমাণ কম দেখা দিলে এ পেশার সাথে জড়িত প্রায় ৫০,০০০ লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

চলন বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে মাটি অত্যন্ত উর্বর হয়ে উঠে। ফলে প্রচুর ফসল উৎপাদন তাড়াশের চলনবিল সীমানায়।

তাড়াশ উপজেলা চলনবিল অধ্যয্যুতি একটি এলাকা হলেও এই উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ০৩ টি নদী। যেগুলো গোমতী, আত্রাই ও ভদ্রাবতী নামে পরিচিত।

নদী, খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয় বিশিষ্ট তাড়াশ উপজেলার ৮৪.৭৫ শতাংশ আয়ের উৎস শুধুই কৃষি। আর অকৃষি শ্রমিক ১.৬২ শতাংশ। শিল্প ০.৬২ শতাংশ, ব্যবসা ৪.৯০শতাংশ, যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে ০.৯৯ শতাংশ, চাকরি ২.৭৪ শতাংশ এবং অন্যান্য আয় মাধ্যম মাত্র ৪.৭৪ শতাংশ।

সুতরাং তাড়াশের প্রাণ কৃষিকেই বলা হয়। যার সম্পূর্ন্ অবদান অক্লান্ত পরিশ্রমে শক্ত হাতের একেকজন কৃষক।

এখানকার প্রধান রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্য হলো ধান, চাল ও তরমুজ। বিস্তৃর্ণ ফসলের ক্ষেত তথা চলন বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সিরাজগঞ্জ-রাজশাহী মহাসড়ক। এ মহাসড়কের সৌন্দর্য তাড়াশকে আরও প্রশংসিত করে।

তাড়াশ অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের একটি অন্যতম স্মৃতি বিজরিত অঞ্চল। তৎকালিন তাড়াশ থানা অঞ্চলে ১১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে চরম লড়াই হয়। এ লড়াইয়ে মোট ১৩০ জন পাকিস্তানি ও রাজাকার বাহিনী নিহত হয়। এই তাড়াশের বুকের উপর দিয়ে সে বছর অত্যারিত বহু স্বরণার্থী ভারতে গমন করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জণে তাড়াশের ১১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ নয় মাস বীর দর্পে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো।

তাড়াশ উপজেলা মোট ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত।

গ্রামের সংখ্যা ২৫৪টি এবং মৌজার সংখ্যা ১৭৬টি। মোট জনসংখ্যা মোট ১,৯৭,২১৪ জন। এর মধ্যে মৎস্য চাষী ৭৪৫০ জন, ব্যবসায়ি প্রায় ৪০ হাজার এবং কৃষি পরিবারের সংখ্যা ৪০০৪৬টি।

তাড়াশ উপজেলার মোট হাট-বাজারের সংখ্যা ২৬টি এর মধ্যে বিশেষ হাট ০৫ টি। রয়েছে ৪৫০ টি মসজিদ, ৩৪টি মন্দির, ২টি গির্জা, ০৮টি ব্যাংক, ০১ টি ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, ০৮ টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ০১টি খাদ্য গুদাম, পাকা রাস্তা ১২৮.৮০ কি.মি., কাঁচা রাস্তা ৪৩১.৬৯ কি.মি., জলাশয়-খাসপুকুর ২৩৫ টি, আশ্রয়ন প্রকল্প ০৪ টি, আদর্শ গ্রাম- ০৩ টি, সাব-রেজিষ্টার অফিস ০১ টি, পশু হাসপাতাল ০১ টি, খেলার মাঠ ০১ টি।

রয়েছে দুইটি বিশেষ স্থান বা দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে একটি নওগাঁ শাহ শরীফ জিন্দানী (রাঃ) মাজার ও অপরটি বেহুলার কূপ।

এছাড়াও প্রাচীন নির্দেশনাদির মধ্যে রয়েছে ১৪৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নবগ্রাম ভাগনের মসজিদ, ১৫২৬ সালের শাহী মসজিদ, বারুহাসের গদাই সরকার মসজিদ, তাড়াশের সান্দুরিয়া জামে মসজিদ, ১৩২০ সালে নির্মিত বারুহাস মসজিদ, ১৮০২ সালের ইসলামপুর জামে মসজিদ এবং তাড়াশ শিব মন্দির। এসব প্রাচীন নিদর্শনগুলোর কারণে তাড়াশ দেশের কাছে হয়ে আছে ঐতিহাসিক ও গৌরবময়।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।