Solonga Thana jpg

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা; যা ‘রক্তাক্ত সলঙ্গা’ বা ‘সলঙ্গা বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ১৯২২ সালে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশের নেতৃত্বে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের গুলিতে সরকারি হিসাবেই সেসময় সাড়ে চার হাজার মানুষ নিহত হন। সেই ভয়ংকর স্মৃতি মন্ডিত স্থানটিই কালের পরিক্রমায় এখন একটি থানা মানচিত্রের নগরী। স্থানীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০১ সালে সলঙ্গাকে উল্লাপাড়া থানা থেকে দ্বিখন্ডিত করে একটি আলাদা থানায় রূপান্তর করা হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার ঘুড়কা, নলকা, ধুবিল ইউনিয়ন এবং উল্লাপাড়ার সলঙ্গা, হাটিকুমরুল ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয় এই সলঙ্গা থানা। বর্তমানে এটি উপজেলা প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে। কেন এই দাবি? কোন কমতি থেকে তারা অঞ্চলের তিন লক্ষাধিক মানুষ সলঙ্গাকে একটি আলাদা উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং এ থানা নগরে কি আছে কি নেই এর সকল উত্তর নিয়েই পজিটিভ থিংক আয়োজিত আজকের সবুজ সংকেত।

বাতাসে যখন ফসল দোল খায় সে দৃশ্যে যে কারো মন আনন্দে দুলতে থাকে। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রমে ফসল ফলায়। আর সেই ফসলের দ্বারা আমাদের জীবন বাঁচে। কৃষক হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাধক। সবচেয়ে খাঁটি নেতাও। আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে গ্রাম আজ বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তার স্থান দখল করছে ইট, কাঠ আর পাথরের বড় বড় অট্টালিকা। কিন্তু সলঙ্গার ১৫২.৭৬ বর্গ কি.মি. এলাকাটি এখনো জিইয়ে রেখেছে প্রকৃতির সেই রুপ, স্নীগ্ধ বাতাস ও টিন কাঠের নির্মিত বসতি ঘর। যদিও এসব গরিবের ঘরের বিশেষত্ব। আর এখানকার সামর্থবানগণ সেই ইট পাথরের অট্টালিকাতেই বসবাস করছে। তবে এর কারণে সলঙ্গার শাষত পল্লী রূপ একটু টলায়নি। এখানকার গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবনযাপন ও তাদের অনাবিল মুখের হাসি আপনাকে মুগ্ধ করবে। তাইতো শহুরে পর্যটকদের একমাত্র আকর্ষন গ্রাম এবং গ্রামীন জনপদ।

গ্রামের মানুষগুলো সাধারণত কৃষি কাজের সাথে জড়িত। সলঙ্গা তার ব্যতিক্রম নয়। সলঙ্গার উর্বর জমিতে উৎপাদিত হয় ধান, পাটসহ নানা প্রকার শষ্যপণ্য। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ যদিও কৃষি কাজে জড়িত, তথাপি ব্যবসায়িও বটে। বৃহত্তম কোন শিল্প এখানে গড়ে না উঠলেও অনেকে মৎস চাষ এবং মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এক সময় সলঙ্গার কৃষকেরা শুধুমাত্র কৃষি কাজ তথা রবি শষ্য উৎপাদন করেই জীবন নির্বাহ করতো। কিন্তু বর্তমানে বিবিধ খামার যেমন গবাদি পশু পালন, হাস-মুরগী পালন, ফল ও বৃক্ষ বাগান, এবং নানা সবজি চাষ করে জীবন নির্বাহ করে।

সলঙ্গা থানার ছয়টি ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখ। থানাটি ভৌগলকিভাবেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই থানার দুই দিক দিয়ে মহাসড়ক চলে গেছে; যেগুলো দিয়ে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলা এবং খুলনা বিভাগের চারটি জেলার মানুষ যাতায়াত করে। সলঙ্গা থানা সিরাজঞ্জ জেলার ঠিক মাঝ বিন্দুতে অবস্থিত। এর দক্ষিণে উল্লাপাড়া থানা সীমানা ও উত্তরে রায়গঞ্জ থানা সীমানা। এই দুটি থানাই স্ব-স্ব উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সলঙ্গা থানার ঘুড়কা, নলকা, ধুবিল ইউনিয়নের ৮৮টি গ্রামের মানুষ ২০ কি.মি. দুরুত্বে রায়গঞ্জ উপজেলায় গিয়ে তাদের প্রশাসনিক নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে থাকে। একইভাবে সলঙ্গা, হাটিকুমরুল ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৮৭টি গ্রামের মানুষ উল্লাপাড়া উপজেলায় গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নানা জটিলতার কাজগুলো সম্পাদন করতে হয়। এতে প্রতিনিয়ত জনগণকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার সিরাজগঞ্জের ‘রক্তাক্ত সলঙ্গা বা ‘সলঙ্গা বিদ্রোহ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক এ ভূখন্ডটি থানা গঠনের ২০ বছর পার করলেও এখনো উপজেলার হিসেবে মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। এ কারণে এলাকাবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের সুবিদার কথা চিন্তা করে সলঙ্গাকে আলাদা উপজেলা হিসেবে ঘোষনা করার দাবি পেশ করেন। যা ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ ৪ আসনের সংসদ সদস্য কর্তৃক কয়েকবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উত্থাপিত হয়েছে।

সলঙ্গা থানা অঞ্চল গ্রাম বাংলার সত্যি এক অনবদ্য সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এর সবুজ বন আর শস্যক্ষেত্র আপনাকে মুগ্ধ করবে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সতেজ বাতাস, পানি, ফুলফল আপনাকে অবাক করবে। বিভিন্ন মৌসুমে সলঙ্গার ১৭৫টি গ্রাম তার রং বদলায়। বর্ষায় থৈথৈ পানি আর শুকনো মৌসুমে সবুজ ফসলি মাঠ সলঙ্গার অন্যতম রূপবৈচিত্র।

তাইতো শহরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই মাঝে মাঝে সলঙ্গা ছুটে আসে। সলঙ্গা থানা অঞ্চলের হাটগুলো বড়ই সুন্দর। এসব হাটে পন্য কেনা-বেচার মধ্য দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতি চাকা সচল থাকে।

সলঙ্গা একটি ছোট্ট থানা এলাকা হলেও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত নিদর্শন। যার নাম নবরত্ন মন্দির। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত নবরত্ন মন্দিরসমূহের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় স্থাপনা। হাটিকুমরুল গ্রামে অবস্থিত তিনতলা বিশিষ্ট এ মন্দিরটি ৭টি বারান্দা ও ৫টি দরজার সমন্বয়ে গঠিত। নবরত্ন মন্দিরের পাশাপাশি এখানে আরও তিনটি মন্দির রয়েছে।

সলঙ্গার আঙ্গারু বাজারে রয়েছে আরেকটি বিশেষ স্থান আঙ্গারু পাচ পীরের মাজার। এ মাজারে প্রত্যেক বছর ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দিন ব্যাপি ওরজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

সলঙ্গা থানা অঞ্চল প্রধানত মুসলিম প্রধান অঞ্চল। স্বল্প সংখ্যাক হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও সামাজিক ভাবে তার মুসলীম সম্প্রদায়ের সাথে মিলে মিশে চলাচল করে।

নেই কোন দাঙ্গা, নেই কোন সাম্প্রদায়িক কলহ, তবে সলঙ্গার কিছু এলাকার মানুষ জমি সংক্রান্ত বিষয়ে পারিবারিক ও গোষ্টিগত কোন্দলে জরিত রয়েছে। যা নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভুমিকা রাখছে সলঙ্গা থানায় কর্মরত প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্য।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।