ishwardi-Thana

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে

রাত দুপুরে অই।

ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে

ট্রেনের বাড়ি কই?

কেমন হয়! কেউ যদি বলে ট্রেনের বাড়ি ঈশ্বরদীতে?

হ্যা, সত্যি কারেই ঈশ্বরদীকে রেলের শহর বলা হয়। এটি রাজশাহী বিভাগীয় অঞ্চলের পাবনা জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ভুষিত একটি প্রথম শ্রেণিভুক্ত উপজেলা।

ঈশ্বরদী উপজেলা আয়তনে খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু এর পরিচিতি অনেক বড়। ঈশ্বরদী নামটি এখন বিশ্ব মানচিত্রের একটি পরিচিত নাম। এর আয়তন ২৪৬.৯০ বর্গ কি.মি.।

 

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঈশ্বরদীর নাম খুব বেশি আসে নি। তবে এলাকাটি তৎকালিন বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠির নজরেই ছিলো। সেকালে এ অঞ্চলের নাম কি নামে প্রশংসিত ছিলো তার কোন বিশেষ তথ্যসূত্র পাওয়া মুসকিল। অন্যদিকে ঈশ্বরদী নামকরণ সম্পর্কেও তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে অধিকাংশের মতে ঈশা খাঁর আমলে এ উপজেলার টেংরী গ্রামে একটি ডেহী বা কাঁচারী ছিল। এখানে ঈশা খাঁর রাজস্ব কর্মচারীরা বসবাস করতেন এবং রাজস্ব আদায় করতেন। সেই সুবাদে ঈশা খাঁও অনেকবার  এখানে এসেছেন। সময়ের ব্যবধানে ঈশাখাঁর “ঈশা” এবং তার ডেহি ঘরের সমন্বয়ে গঠিত শব্দের সংমিশ্রণে ঈশ্বরদী নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারনা পাওয়া যায়।

পরবর্তী কালে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে ১৯৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঈশ্বরদীতে একটি পুলিশ স্টেশন তথা ঈশ্বরদী থানার জন্ম হয়। পরের দশকে তথা ১৯৬০ সালে ঈশ্বরদী থানাটি উন্নয়ন সার্কেল হিসেবে রূপ লাভ করে। এরপর ১৯৮৩ সালে এ থানাটি উপজেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

 

রাজশাহী বিভাগের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা পাবনা। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ঈশ্বরদীকে পাবনার প্রাণকেন্দ্র বলা হয়।

ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর নামক স্থানে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পরিকল্পিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে।

আশা করা হচ্ছে, চলতি বছর ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে দেশের প্রথম এই পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এটি চালু হলে দুটি ইউনিটে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য…বাংলাদেশে একক প্রকল্প হিসেবে এটিই সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প।

এছাড়াও দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন, ঈশ্বরদীতেই অবস্থিত। রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র ও ডাল গবেষণা কেন্দ্র । ঈশ্বরদীতে ৬০০ এর অধিক চাউল কল রয়েছে যা প্রায় দেশের ৪২ শতাংশ চাউলের চাহিদা পূরণ করছে। বর্তমানে এখানে একাধিক অটো রাইস মিলও তৈরী হয়েছে। দেশের একমাত্র রাইসব্রাণ অয়েল কারখানার অবস্থানও ঈশ্বরদীতেই। এছাড়া চিনিকল, কাগজ কল (বর্তমানে বন্ধ), সিমেন্ট কারখানা (বর্তমানে বন্ধ) , স’মিল, ফিড মিল, বিস্কুট কারখানা, আইসক্রিম ইত্যাদি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ঈশ্বর্দীতেই রয়েছে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াককরণ এলাকা, “ঈশ্বরদী ইপিজেড” যা এ অঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে।

সবুজ শ্যামল বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। তাই ঈশ্বরদী অঞ্চল শিল্প নির্ভর জনপদের সাথে সাথে একটি কৃষি সম্পদের ভান্ডারও বটে। ধান, গম, পাট, পেপে, গাজর, ধনে পাতা, শিম, বেগুন মরিচ, হলুদ, ফুলকপি ও বাধাকপি চাষের জন্য ঈশ্বরদীর মাটি বেশ উপযুক্ত। এখানকার কৃষকেরা এসব ফসল ফলিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে থাকে। বর্তমানে এখানকার  সুস্বাদু ফল “লিচু” অর্থনীতিক ফসল হিসাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তাছাড়া ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লী সবার কাছে পরিচিত।

ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাবনার ঈশ্বরদীর তাঁত শ্রমিকরা। এখানকার বেনারসি তাঁতপল্লীতে শাড়ি তৈরির ধুম পড়েছে। বছরের বেশ কয়েক মাস কারিগররা অলস সময় কাটলেও এখন দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না তারা। শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছেন স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। বলা হয়, জেলার সবচেয়ে ভালো ও উন্নতমানের জামদানি, কাতান আর বেনারসি তৈরিতে বিখ্যাত “ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লী”।

ঈশ্বরদী উপজেলা মোট ৮টি প্রশাসনিক এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়ন। ঈশ্বরদীর প্রাণ কেন্দ্রের ১৯.৫৯ বর্গ কি.মি আয়তন বেষ্টিত সীমানা অঞ্চল ঈশ্বরদীর পৌর এলাকা। পৌর এলাকার মোট জনসংখ্যা এক লক্ষেরও অধিক। এর সিংহভাগ লোক বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জরিত। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষনীয়।

 

ঈশ্বরদী পোর সীমানার পশ্চিমে তথা উপজেলার সর্ব উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত 21.52 বর্গ কি.মি. আয়তন বেষ্টিত জনপদটি ১ নং সাঁড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নটি পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি কৃষি প্রধান জনপদ। প্রায় ৪০ হাজার লোকসংখ্যা বিশিষ্ট এ জনপদটি প্রকৃতির অপরূপ রূপে সজ্জিত থাকে সারাবছর। অঞ্চলটি শিক্ষার মানে অনেক এগিয়ে। এখানে রয়েছে ১টি কলেজসহ প্রায় ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের মানুষ খুবই মিশুক ও অতিথি পরায়ন।

 

উপজেলার মাঝ সীমান্তের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ২নং পাকশী ইউনিয়ন। এটি উপজেলার ঐতিহাসিক নগরি। এর মোট আয়তন ১৯ বর্গ কি.মি.। পদ্মার তীরে অবস্থিত পাকশী ইউনিয়নেই রয়েছে উপজেলার সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যেমন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লালন শাহ সেতু, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস, ঈশ্বরদী ইপিজেড, পাকশী রেলওয়ে স্টেশন, এগ্রোনোমিক ল্যাব, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পাকশী রিসোর্ট। সুতরাং পাকশীকে ঈশ্বরদীর প্রাণ বললে ভূল হবে না।

উপজেলার সর্ব পূর্ব-উত্তর ইউনিয়নের নাম ৩ নং মুলাডুলি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের আয়তন ৪২.৭০ বর্গ কি.মি.। এটি ঈশ্বরদী উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

ইউনিয়নটির উপর দিয়ে বয়ে গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম বিভাগের রেল সংযোগ। এর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। বর্তমানে এ অঞ্চলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এটি ঐতিহাসিক কাল থেকেই কৃষি নির্ভর জনপদ।

 

উপজেলার ৪ নং ইউনিয়নটির নাম দাশুরিয়া। এর অবস্থান উপজেলার পূর্ব সীমান্তে। এ জনপদটি প্রকৃতির বিশালতায় যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বিস্তৃর্ণ ফসলী মাঠ, সবুজ অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে এককটি ঘর যেন পল্লীর বিশালতা প্রকাশ করে। এ ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে গেছে আন্তজেলা মহাসড়ক এবং প্রধান রেল সংযোগ।

 

উপজেলার সাড়া এবং লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়ন ব্যাতিত, বাকী চারটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ, পাবনা সদর উপজেলা সীমানার মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত, ঈশ্বরদীর ৫ নং ইউনিয়নটির নাম সলিমপুর ইউনিয়ন। প্রায় ১২টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত এ ইউনিয়নটি সবুজ বৃক্ষে আচ্ছাদিত একটি পল্লী জনপদ। পুরো এলাকা জুড়ে সাড়ি সাড়ি এ বৃক্ষগুলো মূলত ফলের বাগান। সলিমপুর ইউনিয়নের উপর দিয়ে চলমান রয়েছে রাজশাহী-কুষ্টিয়া আন্তজেলা মহাসড়ক। এখানকার জনবসতি খুব বেশি নয়। এটি একটি পরিছ্ছন্ন পল্লী নগর।

সলিমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণে অবস্থিত ০৬ নং সাহাপুর ইউনিয়ন। এর আয়তন প্রায় 27 বর্গ কি.মি. এবং বসবাস করে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ।

উপজেলার সর্ব দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত ৭নং লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়ন। এর আয়তন ৩৩.৫০ বর্গ কি.মি এবং জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। এ এলাকাটি ঈশ্বরদী উপজেলার একটি প্রাচীণ ও ঐতিহাসিক জনপদ। যার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রয়েছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৩টি নীলকুটি। সুতরাং ঐতিহাসিক যুগ থেকেই এ এলাকাটি তৎকালিন শাসকদের নজরে একটি বিশেষ ভূ-খন্ড হিসেবে বিদ্যামান ছিলো। লক্ষীকুন্ডার দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদী। ভরা মৌসুমে পদ্মার আচড়ে পড়া ঢেউ দেখতে পার্শবর্তী অঞ্চল থেকে এসে অনেক মানুষ ভীর করে। এ ইউনিয়ন সীমানায় রয়েছে উপজেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ডিগ্রির চর।

সর্বপরি ঈশ্বরদী উপজেলার ৮টি প্রশাসানিক নগরই স্ব-স্ব বিশেষত্ব্যে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ইউনিয়নেই রয়েছে অনেক সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া ব্যাংক-বীমা, এনজিও, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কৃষি অফিস, ভূমি অফিসসহ উপজেলা ভিত্তিক যেসকল সেবা দপ্তর বা শাখা রয়েছে, তার সকল শাখাই প্রতিষ্ঠিত আছে ঈশ্বরদী উপজেলায়। রয়েছে একটি বিমান বন্দর যা ঈশ্বরদী বিমানবন্দর নামে পরিচিত।

১২৪টি গ্রামের সমষ্টিত এই প্রশাসনিক নগরটিতে বাস করেন প্রায় চার লক্ষ মানুষ। তাদের ৮৯.১০ ভাগ মুসলিম ধর্মানুসারী এবং  বাকী ১০.৯০ ভাগ মানুষ হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের। প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে আলাদা-আলাদা উপাসনালয়। রয়েছে ৩৬৬টি মসজিদ, ৩২টি মন্দির ও ৩টি গীর্জা।

উল্লেখ্য, ঈশ্বরদী উপজেলাতে দেখা মিলবে মোট ৬টি সিনেমা হল। এক উপজেলাতে এত সংখ্যাক সিনেমা হলের উপস্থিতি খুব কমই দেখা যায়। তবে এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেক্ষাগৃহ “রাজু সিনেমা হলটি” গত বছরের এপ্রিলে উম্মুল কুরআন একাডেমি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় রুপান্তরিত হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এমন পদক্ষেপ এটাই প্রথম।

পাবনা জেলা সদর থেকে এর দুরুত্ব মাত্র ২৭ কি.মি। এখানকার মানুষ খুবই পরিশ্রমী। মাঠের কৃষাণ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী পর্যন্ত, যত পেশাজীবি মানুষ এ উপজেলায় বসবাস করে, তারা প্রত্যেকেই একেকজন ঈশ্বরদীর অভ্যুত্থানের গর্বিত সৈনিক। এ উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভুমি মন্ত্রনালয়ের ভূমি মন্ত্রি, জনাব মোঃ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। ঈশ্বরদীতে রয়েছে পাকশী হাইওয়ে থানা ও রেলওয়ে থানাসহ মোট ৩টি থানা এবং লক্ষীকুন্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়িসহ মোট ৪টি পুলিশ ফাড়ি। ৩টি থানাই পাকশী ইউনিয়নে অবস্থিত।

রেলওয়ে থানাটি ঈশ্বরদী রেল জংশনের অভ্যান্তরে অবস্থিত এবং ঈশ্বরদী থানার অবস্থান রেল জংশন থেকে মাত্র ৫০০মিটার দক্ষিণে, ঈশ্বরদী জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন লালপুর-ঈশ্বরদী মহাসড়ক ঘেষে। বিগত দুই দশকে ঈশ্বরদীতে যে উন্নয়ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।