modhukhali
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজের সমারোহ, হিমেল হাওয়া আর শান্তভাবে বহমান গড়াই, মধুমতি নদীর তীরে গড়ে উঠা আখ প্রধান অঞ্চল মধুখালী । মধুখালী উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত এই উপজেলাকে ঘিরে রয়েছে  ঢাকা বিভাগ ও খুলনা বিভাগের অন্যান্য উপজেলাগুলোও। উপজেলাটি ১৯৮১ সালে ভূষণা থানার অধিভুক্ত হয়ে পরে সৈয়দপুর থানার অধীনে ছিলো । ১৯৮৪ সালে মধুখালী উপজেলা আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে মধুখালী একটি স্বতন্ত্র ও মানউন্নীত থানা হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

মধুখালীর নাম করণ ও সংস্কৃতি : 
মধুখালীতে এক সময় প্রচুর পরিমাণে মধু পাওয়া যেত সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম হয় মধুখালী । কালের বিবর্তনে মধুখালী উপজেলাটি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অভিজাত্য ও সম্পদে পরিপূর্ণ একটি অন্যতম উপজেলা। চন্দনা-বারাশিয়া নদীর গতিপ্রকৃতি ও মধুমতি নদী ঘেরা মধুখালী অঞ্চলের মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, ঐতিহ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই উপজেলার সংস্কৃতি।
২৩১.২৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন বেষ্ঠিত এই থানা অঞ্চলটি ১১ টি ইউনিয়ন,  ১৩০ টি মৌজা ও  ২৪২ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এবং ২০১২ সালে উপজেলার ৯ টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় একটি পৌরসভা যা মধুখালী পৌরসভা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের অন্যতম নদীমাতৃক উপজেলা মধুখালী । এ উপজেলা উপর দিয়ে  অসংখ্য খাল-বিল, নদী-নালা প্রবাহিত হয়েছে। মধুখালী উপজেলার উল্লেখযোগ্য নদী গুলো হলো গড়াই, মধুমতি, কুমার, চন্দনা-বারাশিয়া ও পরুষালী ।

 

মধুখালীর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য :
এই উপজেলার লোকজনের যাতায়াতের জন্য নদী ও সড়কপথ ছাড়াও রয়েছে একটি রেল জংশন। ব্রিটিশরা তাদের চলাচলের জন্য ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়া-গোয়ালন্দ লাইনের শাখা হিসেবে কালুখালী হতে ভাটিয়াপাড়া ঘাট পর্যন্ত রেল পথ তৈরি করেন। পরবতীকালে  ১৯৩২ সালের দিকে  মধুখালী রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হয়। এই স্টেশন থেকে কামারখালী ঘাট পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হলে মধুখালী জংশন স্টেশনে পরিণত হয়। বর্তমানে এ স্টেশন দিয়ে  টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, ভাটিয়াপাড়া এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে এই উপজেলার দুরত্ব প্রায় ১২৫ কি.মি. ও জেলা সদরের সাথে দুরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে  পদ্মা পাড়ি দিতে হয় । তবে স্বপ্নের পদ্মসেতু চালু হলে উপজেলাবাসীর যোগাযোগ ও জীবনমানে যে পরিবর্তন আসবে তা হবে এ উপজেলা বাসির জন্য এক অকল্পনীয় সম্মৃদ্ধি।
এখানে গড়ে উঠেছে ৫০ শয্যা বিশিষ্টি একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্রেক্স, প্রায় ৪০ টি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অন্যান্য আরও কিছু চিকিৎসা কেন্দ্র। একসময় এ উপজেলার প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলের শিশুরা প্রায়ই শিক্ষার হার থেকে বঞ্চিত হতো কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার ব্যপক প্রসারে সেইসব গ্রামাঞ্চল এখন শতভাগ শিক্ষার আলোতে বেড়ে ঊঠছে । প্রায় ৪ টি মহাবিদ্যালয় ও কামিল মাদ্রাসা, ৪০ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ও শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়াও অঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও ইনস্টিটিউট ।
প্রাকৃতিক অরণ্যে ঘেরা এ মধুখালীতে রয়েছে কয়েকটি আঞ্চলিক পত্রিকা। তার মধ্যে সাপ্তাহিক মধুখালী সংবাদ, সাপ্তাহিক মধুখালী, মধুখালী কন্ঠ অন্যতম। তাছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল।
মধুখালীর গৌরব : 
নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা এ অঞ্চলের প্রায়  ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ  লোক কৃষক। বলা হয় মধুখালী অঞ্চল  পেঁয়াজ চাষে বেশ সমৃদ্ধ । মধুমতি, গড়াই নদী বেষ্টিত এলাকায় বর্ষাকালীন সময়ে প্রচুর পরিমাণে পাট জন্মে। এ অঞ্চলের পাট সারাদেশসহ বিদেশে রপ্তানী করা হয়। প্রচুর পরিমানে পাট জন্মে বলে এ এলাকায় গড়ে উঠেছে আলতু খান জুট মিল। এ অঞ্চলের মরিচ, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়া উপজেলাবাসীর চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলার চাহিদাও মিটিয়ে থাকেন। এছাড়াও মধুখালী উপজেলার মাটি অধিকতর উর্বর হওয়ায় চাষ হয় আখ । এই আখকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান চিনি শিল্প কারখানাটি উপজেলার গাজনা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের চিনি শিল্পে এই কারখানাটির অবদান অসামান্য। এই কারখানায় অনেক উৎকৃষ্ট মানের চিনি উৎপাদন হয় যা দেশীয় চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
মধুখালী থানা অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই মধ্যম অায় শ্রেনির। রয়েছেন কিছু বিত্তবান শ্রেনী ও নিম্নবিত্ত মানুষ।মানুষ মানুষের জন্য এই সত্য বাক্যটির যথার্র্থ রুপ পরিলক্ষিত থাকে অঞ্চল জুড়ে। সমাজের নানা শ্রেনীর মানুষই এখানকার অসহায়দের পাশে দাড়ান সবসময়। হাত বাড়িয়ে দেন অসহায়দের সহযোগিতায়। সমাজসেবায় অন্যান্যদের মত সর্ববস্থায় এগিয়ে আসেন আমানা গ্রুপ ও লেনদেন বিডি এর পরিচালক বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী জনাব মোঃ দেলোয়ার হোসেন।
কৃষক, দিন মজুর, উদ্যোক্তা, কামার-কুমার, জেলে-ব্যবসায়ীর এ অঞ্চল কয়েকটি কারণে ফরিদপুর জেলার একটি বিশেষায়িত উপজেলা হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে।
তন্মধ্যে উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের চন্দনা নদীর তীরে দাড়িয়ে আছে ৫শ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য বহন কারী একটি দেউল মঠ বা মন্দির । প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, চুন-সুরকির মিশ্রণে বারোকোণ ও একটি ছোট কক্ষ বিশিষ্ট,  ২১.২ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন এ দেউলটি ষোড়শ শতকে সংগ্রাম সিংহ নামক বাংলার এক সেনাপতি নির্মাণ করেন। মন্দিরটি উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি থাকলেও জানা যায়,  ১৬৩৬ সালে ভূষণার বিখ্যাত জমিদার সত্যজিতের মৃত্যুর পর সংগ্রাম সিংকে এলাকার রাজস্ব আদয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তৎকালীন শাসকের ছত্রছায়ায় থেকে সংগ্রাম সিং বেশ ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন। কাপাস্তিগ্রামের এক বৈদ্য মেয়েকে বিয়া করে মথুরায় বসবাস কালীন সময়ে তিনি মন্দিরটি নির্মাণ করেন। অন্য তথ্যমতে, সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি মানসিং রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসেবে এই দেউলটি নির্মাণ করেন। মথুরাপুর দেউল একটি বিজয়স্তম্ভ । দেউলটিতে দক্ষিণমুখী ও পশ্চিমমূখী  দুটিপ্রবেশ পথ রয়েছে।
বাংলার ইতিহাসে এর নির্মাণশৈলী অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে ৷ এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি সুরক্ষিত সম্পদ ৷ মধুখালী উপজেলায় আরও রয়েছে, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত চৎকার কারুকার্য শোভিত মান্দারতলা ব্রিজ । উপজেলাবাসীর যোগাযোগকে সহজ করতে, ফরিদপুর  ও মাগুরা জেলা সংযোগ কারী গড়াই নদীর উপর নির্মিত হয়েছে গড়াই সেতু।
এছাড়াও উপজেলার দর্শনীয় অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে বনমালদিয়ায় অবস্থিত ১৪ শতকে ইসলাম প্রচারক  হযরত শাহ সৈয়দ হাবিবউল্লাহর দরগাহ।
বিনোদন প্রমীদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত মধুখালী উপজেলাটিকে সরব করে রেখেছে, লাল শাপলা রাজ্য হিসেবে পরিচিত গাবুরদিয়া শাপলা বিল । বিশাল আকৃতির বিলটিতে শোভা পাচ্ছে লাল-সাদা চাদরে মোড়ানো ভাসমান শাপলা । লাল-সাদা শাপলার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে উপজেলার গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বিলের ধারে ভিড় জমায় পর্যটকরা।
এ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন,বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুন্সি আব্দুর রউফের অপরিসীম বীরত্ব,সাহসীকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করেন ।
প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাসের এ ভুখন্ডে জমি বিরোধ ও পারিবারিক কলহের মতো সামাজিক নানা অপরাধ দানা বেধে থাকে। যা রূখতে ও মধুখালী অঞ্চলের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তাসহ সেবার ব্রত নিয়ে একাগ্রচিত্রে  দায়িত্বে  পালনে নিয়োজিত রয়েছেন মধুখালী থানার একদল চৌকস, তরুণ পুলিশ সদস্যসহ তাদের অবিভাবক, থানার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একজন অফিসার ইনচার্জ।
error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।