Sobuj Songket Thumbnail 2 jpg

রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি উত্তর দিকের ঢাকা-ময়মনসিংহ প্রশস্ত চারলেনের মহাসড়ক ধরে ৯০ কি.মি. এরপর ডানদিকের পার্শরাস্তা ধরে মাত্র ৩৮ কি.মি. আঞ্চলিক মহাসড়ক অতিক্রম করলেই নরসুন্দা নদীর ধারের যে শহরটির দেখা মিলবে তার নাম ঈশ্বরগঞ্জ। উচু-নীচু শত শত স্থাপনার এ শহরের ব্যস্ততা শুরু হয় পাখি ডাকা ভোর থেকে। শহরের চৌরাস্তার মোড়ে রয়েছে লাল-সবুজের মানচিত্র হাতে সাধীনতার প্রতিকীযুক্ত একটি ফোয়ারা। ফোয়ারার গায়ে অঙ্কিত আছে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ভাষা আন্দোলনের নানা চিত্র। এ শহরে ছুটে বেড়ানো হাজারো মানুষ যা দেখে মনে করে সেইসব দিনের কথা! স্বাধীনতার কত স্মৃতেই যে রয়েছে এই ঈশ্বরগঞ্জে। ১৯৭১ সালে এ ভূখন্ডের মাটি কয়েকবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। প্রাণ দিয়েছিলো অনেক মুক্তিযোদ্ধা। শহীদদের রক্তের বদলা নিতে মুক্তিযোদ্ধারা ৮ ডিসেম্বর পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এবং তাদের ভয়াবহ আক্রমণের মুখে পাকহানাদাররা ভীত হয়ে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। অতপর ৯ ডিসেম্বর ঈশ্বরগঞ্জকে শত্রুমুক্ত ঘোষনা করা হয়। সেই উত্তাল মহুর্তের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতার নানান প্রতিকী।

 

 

ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কি.মি পূর্বে অবস্থিত ২৮৬.১৯ বর্গকিমি আয়তনের একটি উপজেলা যার নাম ঈশ্বরগঞ্জ। ঈশ্বরগঞ্জের পূর্ব নাম ছিলো পিতলগঞ্জ। আর ঈশ্বর ছিলো পিতলগঞ্জ হাটের ব্যবসায়ীদের নৌকা যোগে নদী পারাপার করা নৌকার মাঝি। তার পুরো নাম ঈশ্বরপাটনী। এই সাধারণ মাঝিই ঘটনাক্রমে হয়ে উঠেছিলো তৎকালিন পিতলগঞ্জের অন্যতম নায়ক। যা এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের এক প্রতিনিধিকে ঈশ্বরপাটনী নামের সেই মাঝি তার বৈঠার আঘাতে মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে মাঝিকেও জীবন দিতে হয়। তার স্মৃতি স্মরণে সেসময় প্রতিষ্ঠিত একটি হাটের নাম রাখা হয় ঈশ্বরগঞ্জ। যে নামটি আজকের একটি সম্মৃদ্ধ উপজেলা শহরের নাম।

জমিদারী আমলে ঈশ্বরগঞ্জ ছিলো গৌরীপুর জমিদারদের পরগনা। ১৯৩৬ সালে ঈশ্বরগঞ্জে একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে প্রশাসনিকভাগে ঈশ্বরগঞ্জের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। পরে ১৯৮৩ সালে ঈশ্বরগঞ্জ একটি উপজেলা মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলাটি ১টি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। রয়েছে ২৯৩টি মৌজা ৩০৪টি গ্রাম এলাকা।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শহরটিই মুলত ইশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকা। প্রশাসনিক দপ্তরসমুহের প্রায় সব কিছুই এই পৌর এলাকাতে অবস্থিত। তবে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দ হিসেবে উপজেলার আঠারবাড়ি বাজারটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকেও আঠারবাড়ীর গুরুত্ব অত্যাধিক। এটিকে একসময় আলাদা থানা ঘোষনা করারও দাবি উঠেছিলো স্থানীদের মুখে। হয়তো সময়ের ঘুর্ণয়নে তা বাস্তবায়ন হবে।

ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই এলাকাটি ব্যবসা-বানিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রসর ছিলো। এমন একটি সমৃদ্ধ এলাকায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নিরব দাঁড়িয়ে আছে জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায়ের পরিত্যক্ত দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল বাড়ি, যা আঠারবাড়ি নামে পরিচিত। এ জমিদার বাড়িতে ভ্রমণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে কবি ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে করে জমিদার বাড়ি পৌঁছান। যার ফলে আঠারবাড়ি রেল স্টেশন ও জমিদার বাড়িটি পর‌যটকদেরকে একটু বেশিই আকর্ষণ করে।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা একটি মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল। এ উপজেলায় রয়েছে প্রাচীণকালের ৩টি ঐতিহাসিক মসজিদ ও একটি প্রাচীণ দীঘি। এখানে রয়েছে ১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভোলশোমা মসজিদ, ১৬২৫ সালে নির্মিত নালুয়া মসজিদ ও তেলুয়ারী জামে মসজিদ। ঐতিহাসিক এ স্থাপনাগুলো ঈশ্বরগঞ্জকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে দেশের মানুষের কাছে।

বিস্তৃর্ণ সুবিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নয়নাভিরাম একেকটি গুচ্ছ গ্রাম। পাখির চোখে যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পজিটিভ থিংক এর ড্রোন উঠানো হয়েছিলো ৫০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায়। সাদা মেঘের ভেলা থেকে ঈশ্বরগঞ্জের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমরা। তখন মেঘের আড়ালে ঢাকা ছিলো ঈশ্বরগঞ্জের প্রকৃতি, মাটি, খাল-বিল ও জনপদ। মেঘের ফাঁকে পিচ ঢালাই সড়ক ও রেল লাইনকে খুব সরু দেখাচ্ছিল আর তার পাশের শহরটিকে কাগজে আকা একটি ঘন বসতির ছবির মত মনে হচ্ছিল।

সবুজ অরণ্যের মাঝে ছোট ছোট ঘর আর চতুর্পাশে ফসলি মাঠ যেন প্রকৃতির অন্যরকম ঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল বাতাশে। এটি মূলত একটি কৃষি নির্ভর জনপদ। এখানকার প্রধান অর্থকরি ফসল ধান ও পাট। সেই সাথে পর্যাপ্ত দেশীয় মাছ পাওয়া যায় উপজেলার প্রধান নদী নরসুন্দাসহ কাঁচামাটিয়া, মঘা এবং সোয়াইন নদী থেকে। এছাড়াও অসংখ্য পুকুর জলাশয়ে মাছ চাষ করে তা সারাদেশে রপ্তানির করে থাকে ঈশ্বরগঞ্জের মৎসজীবিরা।

বর্তমানে এখানকার মানুষ গবাদি পশুর খামার ও হাস-মুরগীর খামার করার দিকে বেশি মনোযোগি হচ্ছে। তাছাড়াও অন্যান্য স্থায়ী ও আদি ব্যবসাসহ এ জনপদের একটি বৃহত্তম অংশ কুটির শিল্পের সাথেও জরিত রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।