maxresdefault 8 jpg

জয়পুরহাট সদর ঢাকা থেকে ২৪০ কি.মি. দূরত্বে দেশের সর্ব উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ২৩৮.৫ বর্গ কি.মি. আয়তনের সবুজ অরণ্যে ঢাকা জনপদ। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আগে এ অঞ্চলের নাম ছিলো গোপেন্দ্রগঞ্জ। তারপর রাজা জয়পাল এর নাম থেকে জয়পুর নামকরণ করা হয়। ১৮৮৪ সালে তৎকালিন ভারত বর্ষে ২৯৬ মাইল রেল সংযোগ স্থাপন করা হয় এবং কিছুদূর পর পর একটি করে রেল স্টেশন নির্মাণ করা হয়। তন্মধ্যে একটি এ উপজেলার জয়পুর রেল স্টেশন। কিন্তু পার্শবর্তী আরেকটি রেল স্টেশন জয়পুর নামে থাকায় তৎকালিন নীতি নির্ধারকগণ তাদের দলিলপত্রে এ স্টেশনের নাম লিপিবদ্ধ করেন জয়পুরহাট নামে। সেই থেকে জয়পুর এলাকাটি জয়পুরহাট নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এ রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন আন্তঃনগর, মেইল ও কমিউটারসহ মোট ২৪টি ট্রেন নিয়মিত চলচল করে। তন্মধ্যে একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, নীলসাগর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটি সরাসরি ঢাকার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সকালের প্রথমভাগে স্টেশনটি কোলাহলমুক্ত থাকলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে চাপ বাড়তে থাকে স্টেশনের প্লাটফর্মে।

 

 

জয়পুটহাটকে বলা হয় উত্তরবঙ্গের সরিষা ভান্ডার। এ অঞ্চলের প্রধান কৃষি পণ্য ধান হলেও প্রচুর পরিমাণে গম, আলু ও ভুট্টার চাষ হয়। এই শীতের মৌসুমে কৃষকেরা ভোর থেকেই মাঠে নামে জমি তৈরিতে। লাঙ্গল দিয়ে ভূমি চাষ করে থাকে এখানকার কৃষক। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। তারাও শীতের সকালে ঘর থেকে বের হয় শ্রম বিক্রির মাধ্যমে। অন্যদিকে মৌসুমী ফল চাষীরা তাদের বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত হয় সকাল থেকেই। জয়পুরহাটের বাজার এলাকাগুলোতে সকাল থেকেই মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মাছ বাজারগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার বেশি সমাগম হয়। কষাইরা নিয়মিত ভাবেই মাংশ তৈরি করে উপজেলার মানুষের আমিষ চাহিদা পূরণ করছে এবং নিজের জীবিকা অর্জনেও সমানভাবে ভূমিকা রাখছে। এরই মধ্যে বাজারের অন্যান্য ব্যাবসা তথা হোটেল, রকমারী ইত্যাদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জয়পুরহাট উপজেলায় রয়েছে ভ্রাম্যমান কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা স্বল্প পুজিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত থাকে। বিশেষ করে শীতকালে জনপদের বিভিন্ন স্থানে বসে চিতল ও ভাপা পিঠার দোকান। স্বাধারনত নারীদেরকেই এ পেশায় বেশি দেখা যায়। শীতকালে তাদের তাতে তৈরি গরম পিঠাগুলো খুবই সুস্বাদু হয়। তাই ক্রেতাদের ভীর লেগেই থাকে সকাল থেকে রাতের প্রথমভাগ অবদি।

দেশের স্বাধীনতা অর্জনে জয়পুরহাটের রয়েছে অন্যন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়পুরহাট ৭ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ২৩ মার্চ জয়পুরহাটে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে ২৪ এপ্রিল পাকবাহিনী জয়পুরহাট দখল করে নেয়। ২৬ এপ্রিল জয়পুরহাট থানার বম্বু ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় পাকবাহিনী রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় তিনশতাধিক গ্রামবাসিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ৫ অক্টোবর পাগলা দেওয়ান গ্রামে জুম্মার নামাজে শরীক প্রায় তিনশতাধিক নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। অবশেষে ১৪ ডিসেম্বর জয়পুরহাট শত্রুমুক্ত হয়। উপজেলার চকবরকত ইউনিয়নে অবস্থিত পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি ১৯৭১ এর গণহত্যার অন্যতম নিদর্শন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রায় দশ হাজার নিরিহ বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে এই পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিতে। পাশেই অবস্থিত পাগলা দেওয়ান স্মৃতিসৌধ। এ স্মৃতি স্তম্ভটি সেই ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। ইতিহাসের পাতায় স্বাধীন জয়পুরহাট আজ ৫২ বছর পেরিয়েছে।

সাথে সাথে এ অঞ্চলের পারিপার্শিক রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে, মিল, কল-কারখানাসহ নানা উন্নত অবকাঠামো। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাংক-বীমা, এনজিও সহ বহু জনকল্যাণমুলক সংগঠন।

১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জয়পুরহাট উপজেলা বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। রয়েছে ১৮৪টি মৌজা ও ১৯২টি গ্রাম। উপজেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। উপজেলা পরিষদ চত্তরেই রয়েছে জয়পুরহাট উপজেলার সকল দাপ্তরিক কার্যালয় সমুহ।

দেশের তিনটি ৩টি গার্লস ক্যাডেট কলেজের মধ্যে একটির অবস্থান এই জয়পুরহাট উপজেলায়। বাংলাদেশে মোট ১২টি ক্যাডেট কলেজের মধ্যে এটি সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মোট ৫৭ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২০ জন। সুতরাং বলাই যায় যে, শিক্ষার দিকে বেশ এগিয়ে জয়পুরহাট উপজেলা। এ উপজেলায় প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছিলো সেই ১৯০১ সালে খঞ্জনপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এর পরের ২ দশকে দুইটি মাদ্রাসা ও দুইটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এ উপজেলার সরকারি বেসরকারি মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। এর মধ্যে জয়পুরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জয়পুরহাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ অন্যতম।

অন্যদিকে বিশেষ স্থাপনা হিসেবে রয়েছে প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (পিটিআই), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ও স্টেডিয়াম ভবন।

জয়পুরহাট উপজেলা একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। তবে, এ উপজেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য এ অঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৭০০টি মসজিদ অর্ধশত মন্দির, ৮টি গির্জা ২ তীর্থস্থান ও ২টি মাযার। উপজেলার প্রাচীন উপাসনালয় হিসেবে রয়েছে সতেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত বারো শিবালয় মন্দির । বারো শিবালয়ের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় যে রাজা বল্লাল সেন শিবের উপাসক ছিলেন বলে তিনি এই মন্দির স্থাপন করেন। প্রতিবছর ফাগুনমাসের চতুর্দশীতে শিবরাত্রি এ বারো শিবালয় কে ঘিরে পূজা অর্চনা আয়োজিত হয়। শিবরাত্র উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল মেলা। মেলায় মানত, শিবদর্শন, গীতাপাঠ, উলুধ্বণি আর ঐতিহ্যবাহী ঢাক ঢোলের বাজনায় সারা এলাকা মুখরিত থাকে।

জয়পুরহাট অঞ্চল তুলনামূলকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আভাসভূমি। পল্লী এলাকার মানুষ নানা অসহায়ত্তের মাঝে জীবন অতিবাহিত করে। তাদের একশ্রেণি ভ্যান অটোরিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, আরেক শ্রেণি নিতান্তই দিনমজুর। প্রতিনিয়ত খেটে খাওয়া এ মানুষগুলো একদিন কাজ না করলে চরম অভাবের সম্মুখিন হয়। তবে মনুষত্যের দিকে সর্বদাই এগিয়ে জয়পুরহাট উপজেলার মানুষ। অসহায়কে সাহায্য করা তাদের পরম নৈতিকতার পরিচয়। অন্ধকে পথ দেখিয়ে তারা ভালবাসা জুগিয়ে নেয়। জয়পুরহাট সদরের নিভৃত পল্লীতে দেখা মিলবে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের কুঠরী মাটির ঘর। স্থানীয়রা বলেন, ঐতিহ্যের ধারক হিসেবেই এই ঘরগুলো তারা এখনো টিকিয়ে রেখেছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।