maxresdefault 9 jpg

গ্রাম বাংলার মেঠোপথ, চারিদিকে সবুজের সমারোহ, হেটে চলা কিশোরীর নূপুরের শব্দ আর বাউলের এক তারার সুরে ভেসে যাওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত কুমার নদীর অপার লীলাঘেরা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত মাদারীপুর জেলার দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম উপজেলার নাম রাজৈর। বর্ষা মৌসুমে থৈ থৈ পানির উপর ভাসমান ও শুস্ক মৌসুমে সবুজ ফসলে ভরে থাকে পুরো রাজৈর। উপজেলাটি পদ্মাবিধৌত নিম্ন পলল ভূমি এলাকা। উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলার চান্দার বিল এবং বাগিয়ার বিলের ৫১৮ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদ পিট কয়লায় ভরপুর। ১৯৮০ সালের দিকে রাজৈরের আলম দস্তার, টেকেরহাট, ইশিবপুর, শাখারপাড়, হৃদয়নন্দী, খালিয়া, বাজিতপুর, নয়াকান্দি, লখার বিল, লাউসার বিল, আমগ্রাম বিল, পশ্চিম খালিয়া, সেনদিয়া, পলিতা, আড়ুয়াকান্দি, লক্ষ্মীপুর, কদমবাড়ি, বিলবাঘিয়া ও পার্শ্ববর্তী ভেন্নাবাড়ি, জলিরপাড়, কলিগ্রাম, সাতপাড়, চান্দার বিল এলাকায় খনন করতে গিয়ে এ পিট কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। মাটির নিম্নাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ আর উপরিভাগ বিশাল মৎস ভান্ডারের এ উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর বর্তমান সময়ের চাঞ্চল্যকর বিষয়াদি নিয়েই রয়েছে বিচিত্র আয়োজন।

 

 

১৮৫৪ সালে সৃষ্ট মাদারীপুর মহকুমার অধীনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ সালে রাজৈর থানা গঠন করা হয়। ১৯৮৪ সালের দিকে রাজৈর থানাটি উপজেলায় রুপান্তরিত হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম বেড়ে যায় ও রাজৈর থানাটি একটি মানউন্নীত থানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি থাকলেও ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বিখ্যাত ছিলো। তখন এ অঞ্চলে বিভিন্ন রাজা-সামন্তদের আনা-গোনা ছিলো। কালের পরিক্রমায় রাজা রাম রায়ের রাজ কর্মচারীরা এ অঞ্চলে এসে আস্তানা গড়ে তোলেন। প্রাচীন ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ও পূর্বাপর রাজাদের বিশ্রামের স্থান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় একসময় অঞ্চলের নামকরণ হয় রাজৈর।

সে হিসেবে বলা যায় রাজৈর উপজেলার সভ্যতা বহুপ্রাচীন। এখানকার প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম খালিয়া জমিদার বাড়ি। এটি মুলত উপজেলার খলিয়া গ্রামে অবস্থিত বলেই খালিয়া জমিদার বাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর আসল নাম রাজারাম রায় চৌধুরীর বাড়ি। শতেরো শতকে নির্মিত প্রায় ২৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ বাড়িটি বর্তমানে প্রায়ই ধ্বংষের পথে। জমিদারে নির্মিত মন্দিরটি এখনো অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। চার চালা ঘরের আদলে নির্মিত মন্দিরটি মোট ২৩ শতাংশ জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর নকশা বেশ আকর্ষণীয়। দ্বিতল বিশিষ্ট এ ঘরটিতে মোট ৯টি কক্ষ রয়েছে। যার মধ্যে নিচের তলায় তিনটি ও উপরের তলায় ৬টি কক্ষ। এছাড়াও পূজা অর্চনার জন্য রয়েছে একটি আলাদা স্থান। রাজারাম মন্দিরের উচ্চতা ৪৭ ফুট। এর দৈর্ঘ্য বিশ ফুট ও প্রস্থ ষোল ফুট। মন্দিরটির প্রতিটি দেয়াল বিভিন্ন রকম দেবদেবী, রামায়ণ ও মহাভারতের নকশা দ্বারা ফুটিয়ে তুলা হয়েছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন রয়েছে।

উপজেলার দিঘীরপাড় এলাকায় ৩৬৫ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কদমবাড়ী মহামানব শ্রী শ্রী গণেশ পাগলের আশ্রম ও মন্দির ৷ আজ থেকে প্রায় ১৪০ বছর আগে তৎকালিন ১৩ জন সাধু মিলিত হয়ে ১৩ কেজি চাল ও ১৩ টাকা নিয়ে ১৩ই জৈষ্ঠ্য এ সেবাশ্রমে কুম্ভমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে আজ অবধি প্রতি বছরের এই দিনে ধারাবাহিকভাবে কুম্ভমেলার আয়োজন হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, শ্রী শ্রী গনেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘের এই মেলা উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ কুম্ভমেলা হিসেবে স্বীকৃত। যা প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত। এমন নানাবিধ কারণে রাজৈর উপজেলার সুনাম রয়েছে মাদারীপুর জেলা জুড়ে।

এ উপজেলায় জন্ম নিয়েছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী; ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার, স্বদেশী যুগের রাজনৈতিক কর্মী, কবি, গীতিকার ও সাহিত্য সাধক, কিরণ চাঁদ দরবেশ, ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস, প্রখ্যাত আইনবিদ ও দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি এ. বি. এম. খায়রুল হক।

তাছাড়া ১৯৭১ এর রণাঙ্গণে এ উপজেলার মানুষের অবদান বাঙ্গালী কখনোই ভুলবে না। সেদিন পাকবাহিনীর অস্ত্রের মুখে শপে দিয়েছিলো উপজেলার সেনদিয়া গ্রামের প্রায় অর্ধশত নিরীহ প্রাণ। হত্যা, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা সেদিন মেতে উঠেছিলো রাজৈর উপজেলা ধ্বংসের মিছিলে। এরপর ৪ ডিসেম্বর খলিয়ার বোল গ্রামে পাকিস্তানিরা পুনরায় আক্রমণ চালালে এ মাটির সূর্য সন্তানেরা সেদিন ১৩৫ জন পাক-বাহিনীকে আটক করে রাজৈর অঞ্চলকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে।

সে সময়ের বিপযস্ত জনপদ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এখন একটি মানউন্নিত উপজেলায় বদলাতে চলেছে। পরিবর্তন এসেছে যোগাযোগ পথেও। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১০২ কি.মি. দুরত্বে রাজৈর থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। এ উপজেলার উপর দিয়ে চলমান রয়েছে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। তাছাড়া উপজেলার আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়কগুলোও বেশ প্রশস্ত রয়েছে। যা রাজৈর শহরকে সরাসরি মাদারীপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করেছে।

রাজৈর উপজেলাটি তুলনামুলক দরিদ্র জনগোষ্টির আবাসস্থল হওয়ায় এখানকার শিক্ষার মান খুব বেশি এগুতে পারেনি। তথাপী সরকারী হিসেব মতে শতকরা ৪৮ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত দেখানো হলেও বর্তমানে এ পরিসংখ্যান যথার্থই বেড়েছে। সেই ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত খালিয়া রাজারাম ইনস্টিটিউশন এর মাধ্যমে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিলো রাজৈর উপজেলায়। এর দুই বছর পরই প্রতিষ্ঠিত হয় রাজকুমার এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন। পরের দশকে আমগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ও তারপর আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছিলো এ উপজেলায়। এভাবে বহু নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে বর্তমান রাজৈর উপজেলায়।

মাদারীপুরের এ উপজেলার মানুষ আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে কিছু বিশেষ রোগে সারা বছরই আক্রান্ত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত রাখে আর্সেনিকযুক্ত খাবার পানি। ফলে অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সব সময়ই একটা বড় ধাক্কা সামাল দিতে হয়।

উল্লেখ্যযোগ্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র হিসেবে রাজৈর উপজেলায় রয়েছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি সরকারি হাসপাতাল এবং ৭টি বেসরকারি হাসপাতাল। রয়েছে ৫টি উপ-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে।

রাজৈর মুলত একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল। এ জনগোষ্ঠির মোট আয়ের ৬০.৬৮ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। ধান, পাট, আঁখ, গম, মিষ্টি আলু, ডাল, সরিষা ও শাকসবজি এখানকার প্রধান কৃষিজ ফসল। এ অঞ্চলে উৎপাদিত পাট, খেজুরগুড় ও শরিষার তেল প্রধান রপ্তানিযোগ্য পণ্য। তাছাড়া বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা, কুটির ও তাঁতশিল্প রাজৈর উপজেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।