maxresdefault 7 jpg

বিশাল বিশাল অট্রালিকায় গড়ে ওঠা পাঁচবিবি শহর এক সময় পুরোটাই সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত ছিলো। কিন্তু কালের পরিক্রমা আর মানুষের প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাহিদায় এখন অরণ্যভূমি জেগে উঠেছে শত শত অট্টালিকায়। যদিও পাঁচবিবির পল্লী অঞ্চলগুলো এখনো প্রকৃতির অভয়াশ্রম হিসেবে জিইয়ে আছে। এ উপজেলায় রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র উড্ডয়ন ক্ষমতা বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী প্রাণী বাদুড়ের অভয়াশ্রম। পরিবেশের নানা প্রতিকূলতার কারণে এ প্রাণীগুলোকে এখন খুব বেশি দেখা না গেলেও পাঁচবিবি উপজেলায় তাদের বিচরণ একই ভাবে বিদ্যমান আছে।

জয়পুরহাট সদর থেকে মাত্র ১৫ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত পাঁচবিবি উপজেলার আয়তন ২৭৮ কি.মি। আয়তনের দিক থেকে এটি জয়পুরহাট জেলার সবচেয়ে বড় অঞ্চল।

 

 

পাঁচবিবি একটি অতি প্রাচীন জনপদ, খ্রিষ্ট পূর্ব সময়কাল থেকেই এখানে মানুষের বসতি শুরু হয়েছিলো। এর পূর্ব নাম ছিলো লালবাজার। আনুমানিক সতেরোশ খ্রিষ্টাব্দে লালবাজার অঞ্চলের খসবাগুড়ি গ্রামে একজন মুসলীম দরবেশ বসবাস করতেন। তার পর্যায়ক্রমে পাচজন বিবি ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই ধর্মপারায়ন, কামেল ও মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর খসবাগুড়ি এলাকার ছোট যমুনা নদীর তীর বর্তী স্থানে পাচটি মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের স্মৃতি ও সম্মাণার্থে এলাকাবাসী উক্ত স্থানকে পাচবিবি দরগাহ নামে উল্লেখ করতে থাকেন। পরে ধীরে ধীরে এলাকাটি পাঁচবিবি নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

১৮৬৮ সালের ১৬ই মার্চ নদীভাঙ্গনের কারণে পূর্বে গঠিত লালবাজার থানা সদর, বেল-আমলার লালবাজার স্থান হতে, পাঁচবিবি দরগায় তথা পাঁচবিবিতে স্থানান্তর করা হয়। তথন থেকেই এর নাম হয় পাঁচবিবি। ১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারী জয়পুরহাট মহকুমা ঘোষিত হলে পাঁচবিবি থানা জয়পুরহাট মহকুমার অন্তর্ভূক্ত হয়। যা পূর্বে বগুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সর্বশেষ ১৯৮২ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পাঁচবিবি থানাকে পাঁচবিবি উপজেলা হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং ১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী জয়পুরহাট জেলা ঘোষিত হলে পাঁচবিবি উপজেলা জয়পুরহাট জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়।

১৯৯৮ সালের ২৭ আগষ্ট উপজেলা শহরের প্রায় ১০ বর্গ কি.মি. আয়তনে ৯টি ওয়ার্ডের সমন্বয়ে পাঁচবিবি পৌরসভা গঠিত হয়। যা উপজেলা উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ। পৌরনগরের প্রাণকেন্দ্র তথা পাঁচবিবির প্রধান ফটকে নির্মিত হয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যটি উপজেলাবাসিকে মনে করিয়ে দেয় ৭১ এর সেই বীরত্ব ও ত্যাগের কথা। স্মৃতি ভাস্কর্যের সামনেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু মুর্যাল। পাঁচবিবি পৌরপার্কেরর ভেতরে নির্মিত হয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ। পৌর অঞ্চলের অভ্যন্তরে এসব স্মৃতি স্থাপনা ছাড়াও রয়েছে নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

পাঁচবিবি উপজেলাটি মোট ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা অঞ্চল নিয়ে গঠিত। জেলার সর্ববৃহত্তম এ উপজেলায় বাস করে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে অন্যতম হিন্দু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যথাক্রমে প্রায় ৫শতটি মসজিদ, ৬০টি মন্দির ও ১২টি গীর্জা। তাছাড়া এ উপজেলায় ৫৫০৮টি পরিবারে মোট ২৫,৪০৫ জন আদিবাসি বসবাস করে।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে আধিবাসীদের অবদান স্বীকার করে তাদের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে শহীদের স্বরণে উপজেলার ধরঞ্জি ইউনিয়নে নির্মিত হয়েছে উঁচু বেদীর উপরে তীর ধনুক হাতে পুরুষ এবং নারীর অংশ গ্রহণমূলক আদিবাসি ভাস্কর্য। বাংলাদেশে এমন প্রতীক রয়েছে মাত্র দুটি। তারমধ্যে একটি ধরঞ্জি ইউনিয়নের এই আদীবাসি ভাষ্কর্য।

ধরঞ্জি ইউনিয়নের কড়িয়া গ্রামে রয়েছে পাঁচশত বছরের পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী লকমা জমিদার বাড়ি। কথিত আছে এই জমিদার বাড়ির জমিদাররা ছিলেন খুবই অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর। তাদের সেই নির্মমতার ছাপ হয়তো এখনো বাড়ির দেয়াল ও প্রাচীরের অভ্যন্তরে গুমড়ে চিৎকার করে। নেই সেই জমিদার চৌধুরী, কিন্তু তাদের নির্মিত জমিদারি কুঠির এখনো দৃশ্যমান হয়ে আছে পাঁচবিবি ভূ-খন্ডে। উপজেলার পাথরঘাটা এলাকায় আবিষ্কৃত হয়েছে পাল শাসনামলের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। তারই পাশে রয়েছে নিমাই পীরের দরগাহ। স্থানীয়রা এটিকে পীরকেবলা নাছিরের মাজার বলে থাকেন।

পাঁচবিবি উপজেলা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্মৃতি বিজরিত দেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ভূখন্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে তথা ১৮৯৩ সালে তিনি পাঁচবিবি উপজেলার বালিঘাটার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা পাঁচবিবি উপজেলার মানুষ অর্থনীতির মানদন্ডে তিন ভাগে বিভক্ত। এক শ্রেণি উচ্চবিত্ত পরিবার। যাদের প্রধান আয়ের মাধ্যম ব্যবসা। আরেক শ্রেণি মধ্যবিত্ত যারা চাকুরী, কৃষি পেশা ও ছোট ব্যবসার সাথে জড়িত। আরেক শ্রেণি নিম্নবিত্ত। যারা মূলত দিনমজুর। দিন আনে দিন খায় স্বভাবের। এ উপজেলায় রয়েছে কয়েকটি বড় শিল্পমাধ্যম। রয়েছে শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। পাঁচবিবির অর্থনীতি মুলত কৃষির উপরেই নির্ভরশীল। অন্যান্য কৃষির ফসলের পাশাপাশি এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বে কচু চাষ। বর্তমানে এ উপজেলার মানুষ কচু ও কচুর লতি বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

পাঁচবিবি উপজেলার প্রায় আড়াই শতাধিক গ্রামজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৫৫টি বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তন্মধ্যে রয়েছে ৫টি মহাবিদ্যালয়, ২৮টি মাদ্রাসা ও একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রথম সাড়িতে রয়েছে পাঁচবিবি লাল বিহারী পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পাঁচবিবি নছির মন্ডল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মহীপুর হাজী মহাসীন সরকারি কলেজ।

উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য রয়েছে একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৮টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র। রয়েছে, ব্যাংক, বীমা, এনজিও এবং ফায়ার সার্ভিস স্টেশনসহ সরকারি বেসরকারি নানা দাপ্তরিক ভবন।
এসব দাপ্তরিক কার্যালয়সহ উপজেলার বাজার, রাস্তা-ঘাট, পথে-প্রান্তরে প্রতিদিনই ঘটছে নানা ঘটনা ও অপঘটনা। যা দৈনিক গণমাধ্যমে স্পষ্টই প্রকাশ পাচ্ছে।

এ উপজেলাকে ঘিড়ে আছে প্রায় ১২ কি.মি. বর্ডার সীমান্ত। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে এখানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, জয়পুরহাট ব্যাটলিয়ন-২০।

জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলা বর্তমানে উন্নয়নের দিকে ধাবমান একটি জনপদ। এ উপজেলা থেকে ঢাকার রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উপজেলার পাঁচমাথা রোড সংলগ্নে অবস্থিত পাঁচবিবি রেলস্টেশন। এবং বালিঘাটা বাজার এলাকায় রয়েছে একটি বাস টার্মিনাল।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।