maxresdefault 6 jpg

নিস্তব্ধ গ্রাম! কুয়াশা ঘেরা আকাশের নীচে জনমানুষ বিচ্ছিন্ন এ প্রকৃতি সব সময় এমন নিরব থাকে না। প্রচন্ড শীতের দাবদাহে মানুষ এখনো ঘরের চৌকাঠ টপকায় নি। গাছের পাখিগুলোর শব্দ কানে ভাসলেও তাদের দেখা পাওয়া যায় না এ সময়। একটু পরেই হয়তো সূর্য তার কিরণ ছাড়ানোর মাধ্যমে প্রাণীকুলকে শীতের এ দাবদাহ থেকে একটু স্বস্তি দিবে। প্রকৃতি সাজবে ঝলমলে রঙ্গিন সাজে। প্রাণীকুল তারই অপেক্ষায়।

সকাল ৮টা। পল্লীর পরতে পরতে ধীরে ধীরে মানুষের ভীর লক্ষনীয় হয়ে উঠছে। বাজার, রাস্তা, অফিস ও কৃষি ক্ষেতগুলোতে মানুষ ভীরতে শুরু করেছে। এলাকাটি খুব বেশি বড় নয়। খুব বেশি উন্নতও নয়। উন্নত জীবন ধারা ও আধুনিকায়নের প্রতিযোগিতায় অনেক চাওয়া-পাওয়া রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের। তবুও এ এলাকার মানুষ হাসি-খুশির মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে। তাদের স্মীথ হাসির মাঝে উচ্চারিত হয় একটি কথা “ইনহাস্ত ওয়াতানাম”। অর্থাৎ এটাইতো আমার জন্মভুমি।

 

 

অদম্য দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ এ ভুমির প্রায় দেড় লাখ মানুষের জীবন-ধারণ, চাহিদা, পাওয়া-না পাওয়া আর শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে জয়পুরহাট জেলার তৃতীয় ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক অঞ্চল কালাই উপজেলাকে ঘিরে।

আলু আর ধান- কালাই এর প্রাণ। বাক্যটি থেকে বোঝা যায়, কালাই উপজেলা মূলত কৃষির উপরেই নির্ভরশীল। বিভিন্ন স্থাপনা, বসতি-ভিটা আর জলমহাল স্থান ব্যতিত বিস্তৃর্ণ ফসলি মাঠের দিকে তাকালেই দেখা যায় কৃষি ক্ষেতের অপার ভূমি। কোথাও ধানের সবুজ পাতাগুলো শিশির দানায় কাপছে, আবার কোথাও বৃহত্তম অর্থকরী ফসল আলুর পাতাগুলো সবুজ রঙ্গে কৃষকের মনে দোলা দিচ্ছে। আলু ক্ষেতের সঠিক পরিচর্যা করে কৃষকেরা যে স্বপ্ন বুনে মনের আয়নায়, তা সব সময়ই আশা সফল হয় না। তবুও এ অঞ্চলের কৃষকেরা নানা জাতের আলু চাষ করে প্রতিবছর দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। আর তাইতো উপজেলা ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্ব পেয়েছে, “আলু আর ধান কালাইয়ের প্রাণ” কথাটি।

ঐতিহাসিক কালাই

কালাই উপজেলা গঠনের ইতিহাস মাত্র চার দশকের। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে তৎকালিন ক্ষেতলাল থানার মাত্রাই, উদয়পুর, জিন্দারপুর, পুনট এবং আহম্মেদাবাদ এই পাচটি ইউনিয়ন নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে নতুন থানা অঞ্চল গঠিত হয় যার নাম কালাই। কিন্তু ঐতিহাসিক যুগে কালাই নামটি মুলত কানাই নামে পরিচিত ছিলো। জানা যায়, কানাই নামের একজন ব্যক্তির নামানুসারে প্রথমে কানাই ও পরে কালাই নামের উৎপত্তি ঘটে। কালাই থানা প্রতিষ্টার পরবর্তী বছর তথা ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কালাই থানা অঞ্চলটি উপজেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে কালাই উপজেলার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ২০০১ সালে স্থানীয় গুরুত্ব বিবেচনা করে, কালাইকে প্রথমে তৃতীয় শ্রেনীর পৌরসভা ২০১২ সালে যা দিতীয় শ্রেনীতে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৮ সালে কালাই পৌরসভাকে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে ঘোষনা করা হয়।

জয়পুরহাট শহর থেকে কালাই উপজেলার দুরত্ব মাত্র ১৬ কি.মি.। একদিকে জয়পুরহাট সদর অন্যদিকে চলে গেছে বগুড়া মহাসড়ক। এ উপজেলা থেকে বগুড়া শহরের দুরত্ব মাত্র ৪৫ কি.মি। পাখির চোখে কালাই উপজেলার প্রাণকেন্দ্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বগুড়া-জয়পুরহাট সড়কের দুই পাশকে কেন্দ্র করেই উপজেলার বিশেষায়িত স্থাপনা ও বসতি গুলো গড়ে উঠেছে। সড়কের দুই পাশেই গড়ে উঠে উচু-নিচু ইট পাথরের ভবন। তার মাঝেই দু একটি টিনের চালাঘর। কিন্তু পৌর সীমানা পেরুনোর সাথে সাথে এই অট্টালিকাগুলো আর চোখে পড়বে না।

কালাই উপজেলার অবকাঠামো

সরকারি অবকাঠামোগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই গড়ে উঠেছে কালাই উপজেলা প্রান্তরে। কালাই উপজেলা ভবন থেকে মাত্র ৫৫০ মিটার দক্ষিণে রয়েছে কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর অভ্যন্তরিন পরিবেশ তুলনামুলক বেশ পরিপাটি।
একই দুরত্তে রয়েছে কালাই থানা ভবন। এ ভবনটি পুরোনো আদলে তৈরি। দোতলা বিশিষ্ট কালাই থানা ভবনটির চারিপাশ সবুজ বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বর্তমান সময়ে এখানে একটি আধুনিক ভবন নির্মাণ সময়ের দাবি।

উপজেলার একমাত্র ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনটির অবস্থান উপজেলার মূল সড়ক ধরে ১ কি.মি পশ্চিমে। যা আধুনিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি। উপজেলার জনবসতি অদ্যাসিত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা মন্দ নয়। তুলনামুলক একটু সরু হলেও সড়কগুলোর পিচ ও গঠন খুবই সুন্দর। এইসব সুন্দর সড়কগুলোকে কেন্দ্র করেই উপজেলার বাজার, বসতি-ঘর ও বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে উঠেছে।

পেশায় কালাই

কালাই উপজেলার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি তাই এ কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে উপজেলার পুনট ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে একটি কোল্ড স্টোরেজ। কালাই উপজেলার উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে তুলসীগঙ্গা ও হারাবতি। এক সময়ের ক্ষরস্রোতা হারাবতি নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল এলাকার কালাইয়ের ব্যাবসা বানিজ্য । সময়ের ঘূর্ণয়নে এখন এ নদীগুলো মৃত প্রায়। তাই বর্ষা মৌসুম ব্যতিত নদী ভিত্তিক কোন যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব নয় কালাই উপজেলার সাথে।

ঐতিহাসিক স্থাপনার কালাই

এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক কোন বিবরণ পাওয়া না গেলেও উপজেলার একটি ধ্বংসাবশেষ স্থাপনা কালাই অঞ্চলের ঐতিহাসিক চিহ্ন বহন করে আছে। উপজেলার ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বেশি স্মরনীয় হয়ে আছে ৭১ এর রনাঙ্গনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। মুক্তযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কালাই এর জিন্দারপুর ইউনিয়নের চরবাখড়া ব্রিজের উভয় পাশে অবস্থান করে পাশ্ববর্তী অঞ্চলের সাতজন নিরিহ মানুষকে হত্যা করে। স্থানীয় রাজাকার ও হানাদারদের অত্যাচার দিন দিন বৃদ্ধি পেলে ১ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী সদস্যরা তাদের উপর স্বশস্ত্র আক্রমণ চালায়। পরদিন ২ ডিসেম্বর কালাই উপজেলার চড়বাখড়া ব্রিজ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। সেই ইতিহাসকে সাক্ষ্যি রেখে কালাইতে গড়ে উঠেছে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌদ্ধ।

নান্দাইল দীঘি

কালাই ভূ-পৃষ্টে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক দিঘি। কথিত আছে মৌর্য্য বংশের সম্রাট নন্দলাল ১৬১০ সালে এই ঐতিহাসিক নান্দাইল দিঘীটি খনন করেছিলেন। শুকনা মৌসুমে কৃষক প্রজাকুলের চাষ ও খাবার পানির অসুবিধার কথা চিন্তা করে এই দীঘিটি খনন করা হয়। দীঘিটিকে ঘিরে রয়েছে রমাঞ্চকর গল্পও। স্থানীয় জনগণের মতে দিঘীটি এক রাতের মধ্যে খনন করা হয়েছিলো। নান্দাইল দিঘীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ কি.মি. এবং ৬০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। শীত কালে এখানে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারণে বর্তমানে দিঘীটি দর্শনিয় স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

শিক্ষায় কালাই

বর্তমানে দিঘীটির পাড়ে নান্দাইল নামক একটি কলেজ স্থাপিত হয়েছে। তবে উপজেলার শতবর্ষী উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কালাই মঈন উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়। তাছাড়াও বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কালাই ডিগ্রী কলেজ কালাই, সরকারী মহিলা কলেজ হাতিয়র ফাযিল মাদ্রাসা, কালাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কালাই এম ইউ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। মোট শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ঠ কালাই উপজেলার মানুষের শিক্ষার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। বর্তমানে উপজেলার শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

কালাই উপজেলা মুলত মুসলিম প্রধান অঞ্চল হলেও উপজেলা জুড়ে রয়েছে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও কিছু আদীবাসি জনগোষ্ঠি।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।