Pabna Sadar jpg

পাবনা, এটি রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত একটি প্রাচীন জেলা শহর। পাবনা জেলা মোট ৯টি উপজেলা ও ১১টি থানা নিয়ে গঠিত। তারমধ্যে অন্যতম পাবনা সদর উপজেলা বা সদর থানা। যার অবস্থান জেলার প্রাণকেন্দ্রে।

রাজধানী ঢাকা থেকে পাবনা শহরের দুরত্ব ২০২ কি.মি.। পদ্মা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ জনপদটির যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে। কত শাসন, শোষন, নিপিড়ন আর রাজ-রাজাদের ঐতিহাসিক কালিমা যে–, এই দেশের ইতিহাসে পটে লিপিবদ্ধ আছে তা অনেকেরই অজানা। পাবনা শহরও তেমনি একটি ঐতিহাসিক ভুখন্ড যার অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনো পাবনার পরতে পরতে জিইয়ে আছে।

নানান নামের শহর বেষ্টিত এ দেশে, পাবনার নাম একটু ভিন্ন ভাবেই উচ্চারিত হয় গোটা বাংলায়। পাবনার নাম আসলেই অকোপটে মানুষের মনে ভেসে ওঠে, অভিনবসব পাগলের পাগলামী। যাদের ঠাই হয় দেশের একমাত্র জাতীয় মানষিক হাসপাতালে। তাছাড়া, পাবনা শহরের দক্ষিণরাঘবপুরের পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত জোড়বাংলা মন্দির, পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বনমালী রায়বাহাদুরের তাড়াশ ভবন, শহরের সন্নিকটে তথা হেমায়েতপুর গ্রামে অবস্থিত শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রম- প্রত্যেকটি স্থাপনাই পাবনার ঐতিহ্যকে দেশব্যাপি পরিচিত করেছে। শুধু তাই নয়। দেশ ও মহাদেশের একাধীক গুণি মহাপুরুষের জন্মভিটা এই পাবনা শহর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে স্মার্ট রাষ্ট্রের অনবদ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এর জন্মভূমি এই পাবনা সদর। তার প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিএসসি ডিগ্রি সম্পন্ন হয়েছিলো এ শহরের বুকেই। তিনি এখন পাবনার সবচেয়ে উজ্জল তারকা।

তাছাড়া শহীদ ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী ও বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন এর জন্ম এ উপজেলাতেই। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর বন্দে আলী মিয়া, বরেন্য শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামালের মত সুর্যসন্তানেরাও এই পাবনারই সন্তান।

 

 

শিল্প ও ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে পাবনা সদর উপজেলা আদিকাল থেকেই প্রসিদ্ধ ছিল। অতি পুরাতনকাল হতেই এ জেলার বস্ত্র শিল্প অধিক প্রশংসনীয়। এখনও গ্রামে গ্রামে বস্ত্রবয়নকারী হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতি সম্প্রদায় মিলে মিশে কাজ করে। পাবনার সাদুল্লাপুরসহ অনেক এলাকায় রয়েছে সম্ভ্রান্ত তাঁতী সম্প্রদায়। দোগাছির শাড়ী ও লুঙ্গী দেশ খ্যাত। পাবনা ব্যতীত অন্য কোথাও কাপড় প্রস্তত উপযোগী সূতা রংকারক দেখা যায় না। যা পাবনা সদরে, সুদূরপ্রসারী। তাছাড়া হোসিয়ারী তাঁত শিল্পে পাবনা সদর উপজেলার যথেষ্ট সুনাম আছে। ঔষধ শিল্পেও উল্লেখ্য করার মত। বর্তমানে পাবনা সদর উপজেলাতে প্রায় ৫০০ হোসিয়ারী শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। যেখানে প্রায় ১০,০০০ শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। তবে বর্তমানে হোসিয়ারী শিল্পের মূল উপাদান গার্মেন্টস এর ঝুট বাইরে চলে যাওয়ায় এ শিল্পটি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে।

পাবনা সদর উপজেলা তাঁতশিল্পে সমৃদ্ধশালী। এখানকার শাড়ী, লুংগী ও গামছা বিদেশেরপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।

পাশাপাশি পাবনায় প্রচুর পরিমানে সরিষা উৎপাদিত হয়, যার ফলে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য তেল কল। পূর্বে খুলু সম্প্রদায় এই পেশার সাথে সম্পৃক্তছিল, কিন্তু যন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা আজ বিলুপ্ত প্রায়। অন্যান্য কৃষিজাত পন্যও মোটামুটি উৎপাদিত হয়ে থাকে পাবনা সদর উপজেলায়।

পাবনা সদর উপজেলা একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে বিভক্ত। পৌরসভাটি পাবনা সদর পৌরসভা নামে 1876 সালে প্রতিষ্ঠিত। আর ইউনিয়নগুলো হলো মালিগাছা, ভাঁড়ারা, আতাইকুলা, মালঞ্চি, দাপুনিয়া, গয়েশপুর, সাদুল্লাপুর, চরতারাপুর, হেমায়েতপুর ও দোগাছী ইউনিয়ন।

মোট ২৫৯টি মৌজায় বিভক্ত সদর উপজেলার ১১টি প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে পাবনা সদর পৌরসভা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এটি একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা ভুক্ত শহর। ১৫টি ওয়ার্ড ও ২৪টি মৌজা নিয়ে গঠিত পাবনা সদর পৌরসভার আয়তন ২৭.২০ বর্গ কি.মি.। বিবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কল কারখানা, সরকারি-বেসরকারি নানান সেবা সংস্থা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ প্রায় সবকিছুই পৌর এলাকার মধ্যে অবস্থিত।

অন্যদিকে ইউনিয়ন এলাকাগুলোর গুরুত্বও কম নয়! প্রকৃতির অপার লীলায় সজ্জিত পাবনা সদরের একেকটি ইউনিয়নে রয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নানান স্থাপণা। ইউনিয়নের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সবুজ ও সোলালী ক্ষেত। তাছাড়া উপজেলার দোগাছী ও গয়েশপুর ইউনিয়নের ঘরে ঘরে রয়েছে তাঁত শিল্পের অফুরন্ত সম্ভাবনা।

পদ্মা যমুনার মিলন মোহনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশের প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ পাবনা। কীভাবে গড়ে উঠেছিল পাবনা নামের এই সুপ্রাচীন শহরটি এবং কোন সময় থেকে এই ভূ-খন্ডটির নাম পাবনা হয়েছিলো তার সঠিক তথ্য আজও অজানা। একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে পাবনা জেলার গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর। স্রোতসিনী ইছামতি নদীর দু’পার ঘিরে আবর্তিত জনপদের মানুষের শ্রমে বিনির্মিত পাবনাকে পৌরসভার মর্যাদায় অভিসিক্ত করা হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই। এর মাত্র ২ বছর পর ১৮৭২ সালে পাবনা থানার সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই পাবনা শহরে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদন হতে থাকে। তবে সে সময় পাবনা থানা সীমানার পরিধি ছিলো বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কালক্রমে সময়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে নতুন নতুন থানা সৃষ্টির মাধ্যমে থানা সীমানার পরিবর্তিত হয়। থানা প্রতিষ্ঠার ১১০ বছর পর স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং পরিবর্তিত প্রশাসনিক নীতির ফলশ্রুতিতে ১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার  অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে থানা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়ে পাবনা সদর উপজেলা গঠন করা হয়।

পরে, ২০০১ সালে, উপজেলার ২টি ইউনিয়ন যথা আতাইকুলা এবং সাদুল্লাপুর ইউনিয়নকে পাবনা থানা সীমানা থেকে কর্তন করে  আতাইকুলা নামে একটি আলাদা থানা এলাকা গঠন করা হয়। অর্থাৎ পাবনা সদর উপজেলা দুটি থানায় বিভক্ত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।

উপজেলার উপর দিয়ে বহমান রয়েছে দুটি নদী। যথা পদ্মা ও ইছামতি। তাছাড়া উপজেলা সীমানাতে রয়েছে কয়েকটি জলাভূমি। এসব নদী ও জলাশয় প্রভাবিত পাবনার কৃষি ভূমি সারাবছরই পলিযুক্ত থাকে। শুষ্ক মৌসুমে কিছু রবি শস্য ও প্রচুর বোরো ধানের চাষ হয়। আর বর্ষা মৌসুমে পাট ও গভীর পানির বোনা আমন ধানের সবুজ পাতায় ভাসে গোটা পাবনার হাওর বাওর। অন্যদিকে ডাল, তীল,  বিভিন্ন মসলা জাতীয় ফসল ও মৌসুমী ফল উৎপাদনে পাবনার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সামগ্রিকভাবে বলা যায় পাবনা সদর উপজেলা বাংলাদেশের একটি স্ব-নির্ভর উপজেলা। শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যে পাবনা শহর এখন দেশের অর্থনীতিতে একটি অন্যতম নাম। এ শহর এখন হাজার হাজার অট্টালিকার ভীত। আকাশ থেকে দেখলে মনে হয়, এটি যেন ইট পাথরে গড়া একটি পরিকল্পিত শহর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সরকারি দপ্তরিক প্রতিষ্ঠান, ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ হাজার হাজার বাসস্থানের নগর এই পাবনা শহর। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম শীর্ষ তালিকায় রয়েছে তার মধ্যে পাবনা গুরুত্বও বেশ প্রশংসনীয়।

মেডিক্যাল কলেজ, আইন কলেজ,  ক্যাডেট কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটসহ সুনামধন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এ পাবনা শহরে। তারমধ্যে অন্যতম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ। এ কলেজ থেকেই দেশের ২২তম মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

পাবনা শহর থেকে ১০ কি.মি. দূরে পাবনা-নগরবাড়ি মহাসড়কের কোল ঘেষে অবস্থিত রয়েছে দেশের ১২ ক্যাডেট কলেজের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠান পাবনা ক্যাডেট কলেজ।

তাছাড়া শহরের পাদদেশে অবস্থিত সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ, পাবনা জেলা স্কুল ও আল জামিয়া আল আশরাফিয়া মাদ্রাসা যুগ যুগ ধরে সুশিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টি করে চলেছে হাজার হাজার প্রদিপ। যার বিভিন্ন নিদর্শন প্রতিনিয়ত উঠে আসছে স্থানীয় বেশকিছু গণমাধ্যমে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দৈনিক, স্বত:কণ্ঠ, দৈনিক ইছামতি, দৈনিক জোড়বাংলা ও দৈনিক পাবনার আলো।

পাবনা সদর উপজেলার আয়তন ৪৩৯.৩০ বর্গকিলোমিটার। এটি পাবনা ৫ নির্বাচনি এলাকার অন্তর্ভুক্ত জনপদ। এ জনপদের জনসাধারণের সেবার জন্য রয়েছে ৪টি সরকারি হাসপাতাল ও উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। রয়েছে ২৮টি পোষ্ট অফিস, ৩৩টি প্রসিদ্ধ হাট-বাজার ও ৬১টি বিভিন্ন ব্যাংক শাখা। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান মতে উপজেলার ১১টি প্রশাসনিক এলাকার মোট জনসংখ্যা ৫,৯০,৯১৪ জন। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা এখন প্রায় ৭ লক্ষের কাছাকাছি পৌছেছে। এই বিশাল জনগোষ্টির মাঝে আইনি সেবা প্রদানের জন্য রয়েছে পাবনা জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন পাবনা সদর থানার মাত্র ৭২ জন প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।