১৮৯০ সাল। তখন এ দেশ ব্রিটিশদের দখলে জমিদারি শাসনে পরিচালিত হতো।
ভারত উপমহাদেশে তখন জমিদাররা প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করতেন। এমনই একটি জমিদারি এলাকা ছিলো তৎকালীন পাবনা জেলার তথা বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যতম উপজেলা শাহজাদপুর। এ শাহজাদপুরে জমিদারির কাজে হাল ধরেছিলেন ২৯ বছরের তরুণ কবি রবিন্দ্রনাথ। তিনি তার বাবার আদেশে ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত প্রায় ৭ বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুর আসা-যাওয়া এবং অবস্থান করেছেন। এই সময়ের মধ্যে এখানেই তিনি তাঁর অনেক কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। ‘‘সোনার তরী, ভরা ভাদরে, দুইপাখি, ‘আকাশের চাঁদ, ‘হৃদয় যমুনা, ‘প্রত্যাখান, পুরস্কার ইত্যাদি নামক বিখ্যাত কবিতাগুলো এবং ‘‘কল্পনা, যাচনা, ‘বিদায়, নববিরহ, লজ্জিতা, ‘সংকোচ নামক বিখ্যাত গানগুলো এখানে বসেই রচনা করেছেন। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প তথা পোস্টমাস্টার, ‘ছুটি, ‘সমাপ্তি, অতিথি, এই শাহজাদপুরেরই সৃষ্টি। আজ বাংলার মাটি থেকে জমিদারি শাসন ব্যাবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যকার সৃষ্টিশীল কিছু মানুষের সৃষ্টিগুলো চির অম্লান হয়ে আছে বিশ্বের বুকে। তাদের বিদায়ের শত বছরের অধিক সময়ের পরে এসেও কেমন আছে শাহজাদপুর? কবি গুরুর স্মৃতি স্মরনীয় এ ভূমির বর্তমান হালচাল ও আইন শৃংখলা পরিস্থিতির বিষদ বর্ণনা নিয়েই সাজানো আজকের সবুজ সংকেত।
ধুধু বিল, ফসলে ভরা মাঠ আর নদীর চড়ে, চরে বেড়াচ্ছে অসংখ্যা গবাদি পশু। শুকনো মৌসুমে মাঠের পর মাঠ জুড়ে এ অঞ্চলে পালন করা হয় গবাদি পশু। মাঠের প্রান্তে যে টিনের ছাপড়া বিশিষ্ট যে ঘরগুলো দেখা যায় তা মুলত গবাদি পশুরই আশ্রয় স্থল। এটি শাহজাদপুর থানা অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা মাধ্যম। এ জন্য দেশের বৃহত্তম বেসরকারি একটি দুগ্ধ শিতলীকরণ কেন্দ্র এই শাহজাদপুরেই গড়ে উঠেছে। তবে ঐতিহাসিক যুগে শাহজাদপুর অঞ্চলের শিল্প-বাণিজ্য এমন ছিলো না। উনিশ শতকের কয়েক দশক এ অঞ্চল পাট উৎপাদনে বেশ সম্মদ্ধ ছিলো। তার আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানে নীলকরদের একটি নীলকুঠি স্থাপিত হয়েছিল। পরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি ১৩ টাকা ১০ আনায় নিলামে ক্রয় করেন। তারপর এটি
জমিদারী খাজনা আদায়ের কাচারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর আমল থেকেই এই কাচারি কুঠিবাড়ি নামে প্রচলিত হয়। এখনও একে কুঠিবাড়ি নামেই ডাকা হয়। বর্তমানে এখানে নির্মিত হয়েছে আধুনিক অডিটোরিয়াম। দ্বিতল ভবনটি এখন রবীন্দ্র জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আঙিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুন্দর সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান। যা শাহজাদপুরের বিশেষ স্থান হিসেবে সুঘন্ধি ছড়িয়েছে।
শাহজাদপুর নামটি আসলেই এখানকার দুটি প্রসিদ্ধ মাজারের নাম সামনে আসে। তা হলো হযরত মখদুম শাহদৌলা মাজার এবং হযরত শাহ হাবিবুল্লাহ (র.) এর মাজার। মুলত শাহজাদপুর নামকরণের সাথেই মাজার দুটির নিবির সম্পর্ক রয়েছে।
কথিত আছে যে, ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মধ্যপ্রচ্যের ইয়েমেনের শাহজাদা মখদুম শাহদৌলা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তার তিন ভাগ্নে তাদের মাতাসহ বার জন প্রসিদ্ধ দরবেশ এবং কিছু সংখ্যক সহচর নিয়ে নদী পথে জাহাজে রওনা দেন। তিনি তার সহচরদের নিয়ে একসময় বর্তমান শাহজাদপুর ভূখণ্ডে এসে পৌঁছান। তিনি এখানে ইসলাম প্রচার শুরু করলে স্থানীয় হিন্দু রাজার সাথে তার যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং তিনি সেই যুদ্ধে শহীদ হন। কিন্তু বিজয় হয় মুসলমানদেরই। ইয়েমেনের সেই সাধক বীর শহীদ হযরত মখদুম শাহদৌলা -এর নাম অনুসারে এই ভূখণ্ডের নামকরণ করা হয় শাহজাদপুর।
দ্বাদশ শতকের এই বিখ্যাত দরবেশ এর শায়িত কবর তথা মাজারটি শাহজাদপুরের পুরোনো শাহী মসজীদের পাশেই অবস্থিত। প্রতিদিন এ মাজারে শত শত দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। যা শাহজাদপুর থানা অঞ্চলের আরেকটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
ঢাকা থেকে ১৬২ কি.মি. পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলার দক্ষিণাংশের সর্বশেষ উপজেলা শাহজাদপুর। এ উপজেলার উত্তরে উল্লাপাড়া, পূর্বে বেলকুচী ও চৌহালী, এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে পাবনা জেলার তিনটি উপজেলা সীমানা বিস্তৃত। সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে শাহজাদপুর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এর মোট আয়তন ৩২৫ বর্গ কিলোমিটার, তন্মধ্যে জলাশয় ও নদীর আয়োতন প্রায় ৩৪.৫০ বর্গ কিলোমিটার। শাহজাদপুরের এসব জলাশয়ে প্রচুর মাছ চাষ হয়ে থাকে। তাছাড়া বর্তমানে এখানকার কিছু মৎস খামারী উদ্দোক্তরা ফসলী জমি খনন করে পুকুরে মাছ চাষ করে থাকে।
শাহজাদপুর উপজেলা একটি ব্যবসায়ী এলাকা, এ কারণে শাহজাদপুরের মানুষের মাথাপিচু আয় জাতীয় মাথাপিচু আয়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। এ এলাকার মানুষের মূল ব্যবসা হচ্ছে কাপড়ের ব্যবসা। শাহজাদপুরের সর্বত্র তাত শিল্প বিদ্যমান। এ অঞ্চলে প্রচুর শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা উৎপাদিত হয়। যা অঞ্চলের প্রাচীণ গৌরবও বলা যায়। শাহজাদপুরের গৌরবময় ঐতিহ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে এখানকার কাপড়ের হাট। এই হাট-ই শাহজাদপুরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রধান চালিকাশক্তি। সাপ্তাহের দুইদিন তথা রবি ও বুধবারে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে আসে কাপড়ের ছোট-বড় ব্যাপারি ও পাইকাররা। এই হাজার হাজার খরিদ্দারের পদচারনায় মুখরিত থাকে শাহজাদপুর। ধারণা করা হয় কাপড়ের এই বিশাল হাটে একেকদিন কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই কাপড়ের হাটের কল্যানে প্রচুর অর্থের লেন-দেন চলে শাহজাদপুরের ব্যাংকগুলোতে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং দেশের বাইরে থেকে যেসব ব্যবসায়ীরা আসেন শাহজাদপুরে, তাদেঁর টাকা পয়সা ও খরিদকৃত কাপড়ের নিরাপত্তার ব্যাপারে শাহজাদপুর বাসী এবং স্থানীয় প্রশাসন অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন থাকে সর্বত্র, সবসময়।
শাহজাদপুর উপজেলার গুরুত্ব যে সমস্ত কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে তার মধ্যে বাঘাবাড়ি নৌবন্দরে প্রতিষ্ঠিত পেট্রোলিয়াম ডিপো অন্যতম। এই ডিপোতে রয়েছে পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানির সরবরাহ। উত্তরবঙ্গের জ্বালানী তেলের প্রায় সবটুকুই এই ডিপো থেকে সরবরাহ করা হয়। বড়াল নদীর তীরে মহাসড়কের পাশ ঘেসে দাড়িয়ে থাকা অসংখ্যা জালানী পরিবহণগুলো প্রতিদিনই এসব জালানী সরবরাহ করে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
তাছাড়া শাহজাদপুর থানা অঞ্চলের আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হলো বাঘাবাড়িতে স্থাপিত দুটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এ দুটি প্লান্ট থেকে গড়ে ১৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে।
সর্বপরি বলা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যতম থানা নগরীটিই হলো শাহজাদপুর। এটি দেশের প্রাচীন থানা সমুহের মধ্যে একটি। প্রশাসনিক তথ্য বিশ্লেষনে জানা যায় শাহজাদপুর থানা গঠিত হয় ১৮৪৫ সালে। পরে ১৯৮২ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এরপর ৯টি ওয়ার্ডের সমন্বয়ে ২০ অক্টোবর ১৯৮৯ সালে শাহজাদপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।