Rangunia Model Thana

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা! চিরহরিৎ অনুচ্চ শৈল শিখর ও কর্ণফুলি নদী বিধৌত এ অঞ্চলটি ঐতিহাসিক কালে রঙ্গিনা নামে পরিচিত ছিল। চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক মোলভী হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর কর্তৃক ফার্সি ভাষায় রচিত চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস আহাদিসুল খাওয়ানিন গ্রন্থে এমনটাই উল্লেখ রয়েছে।  রঙ্গীনা  শব্দটি ফার্সি। যার অর্থ রঙে রঞ্জিত  বা সৌন্দর্য্য। এককালে এই রাঙ্গুনিয়ার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত মনোরম স্থান দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় আর ছিলো না। তাই  সুলতানী আমলে এ অঞ্চলটি পরিচিত হয় রঙ্গীনা নামে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে রঙ্গীনা শব্দটি রাঙ্গুনিয়া  শব্দে পরিচিত হয় এবং এ নামেই প্রশাসনিক অঞ্চল পরিচালিত হতে থাকে। কালের আবর্তে রাঙ্গুনিয়া প্রথমে থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরে থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করা হয়। কিন্তু কেমন আছে বর্তমানের এই রাঙ্গুনিয়া? কেমন আছে রাঙ্গুনিয়ার সাধারণ মানুষ?

চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের প্রধান অভিভাবক ডিআইজি নুরেআলম মিনার সময় উপযোগী সিদ্ধান্তে জেলার মান্যবর পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহর তত্ত্বাবধানে রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলের মানুষের আইনি সহায়তায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের সাথে নিষ্ঠার raসাথে নিবেদিত আছে রাঙ্গুনিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ চন্দন কুমার চক্রবর্তী। যার বাস্তবিক চিত্রায়ণ নিয়েই আজকের সবুজ সংকেত “রাঙ্গুনিয়া”।

 

 

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত রাঙ্গুনিয়া উপজেলাটি আয়তনের দিক থেকে চট্টগ্রাম জেলার ষষ্ঠ বৃহত্তম এবং জনসংখ্যার দিক থেকে নবম জনবহুল অঞ্চল। পূর্বকালে এটি পার্শ্ববর্তী রাউজান ও পটিয়া থানাধীন ছিল। ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাউজান থানার তৎকালিন ৭টি ইউনিয়ন রাজানগর, হোসনাবাদ, রাঙ্গুনিয়া, মরিয়মনগর, পারুয়া, পোমরা ও বেতাগী এবং পটিয়া থানার তৎকালিন ৩টি ইউনিয়ন সরফভাটা, শিলক ও পদুয়া সর্বমোট ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থানা গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষায় “গণদাবীর” প্রেক্ষিতে মরিয়মনগর ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ১১নং চন্দ্রঘোনা কদমতলী ইউনিয়ন গঠন করা হয়। অতপর ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে ১১টি ইউনিয়ন সম্পৃক্ত রাঙ্গুনিয়া থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। এর ৬ বছরপর ১৯৮৯ সালে শিলক ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ১২নং কোদালা ইউনিয়ন গঠন করা হয়। তারও ১১ বছর পর ২০০০ সালের ৪ জুলাই উপজেলার স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, মরিয়মনগর, পারুয়া ও পোমরা ইউনিয়নের অংশ নিয়ে রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা গঠন করা হয়। ২০০৩ সালে আবারো বৃহত্তর রাজানগর ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ১৩নং ইসলামপুর ইউনিয়ন ও ১৪নং দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়ন এবং বৃহত্তর হোসনাবাদ ইউনিয়নকে বিভক্ত করে ১৫নং লালানগর ইউনিয়ন গঠন করা হয়। তারপর থেকে রাঙ্গুনিয়া মোট ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে উপজেলার সকল প্রশাসনিক কাযক্রম পরিচালিত হতে থাকে। কিন্তু গত ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের ৪টি ইউনিয়নকে নিয়ে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা গঠনের অনুমোদন দেয়া হয়।

রাঙ্গুনিয়ার অতীত ইতিহাস বেশ সম্মৃদ্ধ ছিলো। বিশেষ করে তৎকালীন শাসন শোষন, জমিদাড়িত্বে বার বার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার দখল ও রাজত্ব নিয়ে ঘটেছে নানা সংগ্রাম। এমনকি জমিদার জান বক্স খাঁ ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে চুক্তির শর্তানুযায়ী পাহাড়ি এলাকা ত্যাগ করে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পারে বর্তমান দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে নতুন করে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। কালপরিক্রমায় সর্বশেষ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন নিপীরণে আবারো গর্জে ওঠে রাঙ্গুনিয়া। স্বাধীনতা যুদ্ধে রানীরহাট, রোয়াজারহাট ও রাঙ্গুনিয়ায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর রাঙ্গুনিয়া শত্রুমুক্ত হয়। সে দিনের স্মৃতি হিসেবে রাঙ্গুনিয়ায় রয়েছে ২টি বধ্যভূমি এবং ৪টি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে রাঙ্গুনিয়ার সেইসব মুক্তিকামী মানুষসহ বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসের সেই কথাগুলো অকোপটে স্মরণ করে।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশে নিশ্চিন্তাপুর পাহাড়ের পাদদেশে রাঙ্গুনিয়ার উপজেলার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় তিন হাজার হেক্টর আয়তনের গুমাই বিল চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিলগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। প্রবাদ আছে গুমাই বিলে এক মৌসুমের উৎপাদিত মোট ধান দিয়ে সারা দেশের আড়াই দিনের খাদ্য চাহিদা মেটানো যায়। এ বিলে প্রায় সাত হাজার কৃষক ধান চাষ করে। ধান কাটার মৌসুমে নেত্রকোণা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, রংপুর এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষিশ্রমিকেরা গুমাই বিলে ধান কাটার জন্য এসে জড়ো হয়। ধান ছাড়াও এ উপজেলায় তামাক, আলু, বেগুন, মরিচ, টমেটো, শিম, করলা, পান এবং বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজির চাষ হয়ে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছের বাগান, গবাদি পশু পালন এবং মৎস্য চাষের মাধ্যমে এ উপজেলার অর্থনীতিতে অনেকে অবদান রাখছে।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৩টি চা বাগান রয়েছে। উপজেলার কোদালা ইউনিয়নে গড়ে উঠা চা বাগানটি দেশের প্রথম চা বাগান এবং শীর্ষ চা বাগানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এলাকায় জনশ্রতি রয়েছে, ব্রিটিশরা কর্ণফুলী নদী দিয়ে আসা যাওয়ার সময় কোদালা এলাকায় বিস্তীর্ণ জায়গা দেখে চা বাগান করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আর সেই থেকে প্রায় ৪,২০০ একর এলাকা জুড়ে কোদালা চা বাগান গড়ে উঠে। বর্তমানে উৎপাদনের দিক থেকে সারাদেশে ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে এই কোদালা চা বাগান। এছাড়াও রয়েছে ৩,০০০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠা আগুনিয়া চা বাগান এবং প্রায় ৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঠাণ্ডাছড়ি চা বাগান। যা উপজেলার অর্থনীতিতে বৃহত্তর ভূমিকা রাখছে।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার আরেকটি বিশেষ অর্থনৈতিক খাত পাহাড়ী বাশ। যা উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র জীবিকা মাধ্যম। সুতরাং বলাই যায় যে, রাঙ্গুনিয়ার মানুষ খুবই পরিশ্রমী এবং কর্ম নির্ভর। তাই রাঙ্গুনিয়াবাসী সবসময়ই অপরাধ প্রবণ মানষিকতা থেকে দূরে থাকে।

বর্তমান রাঙ্গুনিয়া মডেল থানা এলাকা একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জনপদ। উপজেলার বিস্তৃত পাহাড় রাশিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শেখ রাসেল এভিয়ারি পার্ক। পার্কটি আয়তনের দিক থেকে এশিয়ার বৃহৎ পাখি সংগ্রহশালা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অপার সৌন্দর্যের সবুজ বনায়ন, পাহাড়ী পাদপিঠের বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠগুলো যেন উপজেলার প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের প্রাণের ভূমি হিসেবে আকাশ পানে সতেজতা ছড়িয়েছে। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে গেছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। কর্ণফুলী নদীটি রাঙ্গুনিয়াকে উত্তর-দক্ষিণ দুটি ভাগে দ্বি-খন্ডিত করেছে। এ নদীর সৌন্দর্যের কারণে রাঙ্গুনিয়ার আলাদা বৈশিষ্ট ফুঠে ওঠে। তাছাড়া রাঙ্গনিয়ার মধ্যভাগে উত্তর-দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে ছোট নদী ইছামতি। যা এ জনপদকে আরো বেশি পূর্ণতা দিয়েছে।

অন্তহীন প্রকৃতির ভালোলাগা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশকিছু আকর্ষনীয় স্থান। এর মধ্যে চাকমা রাজবাড়ি, ঢালকাটা জগদ্ধাত্রী মন্দির, ধর্মচক্র বিহার, পারুয়া রাবার ড্যাম অন্যতম। এছাড়াও কয়েকটি মাজার, কয়েকটি বিনোদনপার্ক, আঠারো শতকের চাকমা রাজা সুখদেব রায়ের রাজধানী পদুয়ার ধ্বংসাবশেষ রাজবাড়ি রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।