Ullapara

কালস্রোতের নিরস্তর ধারায় সৃষ্ট হয় জনপদ, নগর সভ্যতা। যুগোত্তীর্ণ হওয়ার গৌরবে অভিষিক্ত হয় মানবতার কল্যানে নিবেদিত প্রাণ অসংখ্য জনতা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বর্তমান সভ্যতার এই অঞ্চল খৃষ্টপূর্ব হাজার কাল পূর্বে অধিকাংশ স্থানই ছিল জলমগ্ন। কিন্তু সময়ের শ্রোতে জলমগ্ন এ অঞ্চলটি ভুমি মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় মানববসতি। স্থানীয় জনশ্রুতিতে জানা যায় এ মানচিত্রের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত ফুলজোড় নদী বিবর্তনের স্রোতে নাব্যতা হারানোর ফলে জেগে উঠা চরাঞ্চলে সৃষ্টি হয় কাশবন যা উলুবন নামে প্রকাশ ঘটে। সেই ‘উলু শব্দের পরিবর্তিত রূপ উলা থেকে উল্লা এবং বন এলাকায় জনবসতী গড়ে উঠলে সেটিকে পাড়া নামে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ উলুবনের ভেতরের বসতি এলাকাটিই আজকের উল্লাপাড়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের প্রয়োজনে ১৮৭৫ সাথে উল্লাপাড়ায় এ নামেই একটি থানার সৃষ্টি হয়। এর প্রায় শত বছর পর তথা বিংশ শতাব্দির ষাটের দশকে পাবনা-বগুড়া মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কাজ শেষ হলে উল্লাপাড়ার গুরুত্ব বাড়ে বহুগুণ। এবং দেশের মানচিত্রে গুরুত্ব পূর্ণ একটি থানা নগরী হিসেবে পরিচিতি ধারণ করে।

সিরাজগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ থানা উপজেলাটি বর্তমানে দুটি থানা অঞ্চলে বিভক্ত। তাছাড়াও রয়েছে একটি হাইওয়ে থানা। সবুজ সংকেতের আজকের পর্বটিতে থাকছে শুধুমাত্র উল্লাপাড়া মডেল থানা নগরীর মানুষের জীবনমান, কর্ম, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আইন শৃংখলার মান ও বর্তমান সময়ের বিবিধ হালচাল। সেই সাথে থাকবে সিরাজগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোঃআরিফুর রহমান মন্ডল,বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) এর তত্বাবধানে উল্লাপাড়া থানা পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম।

 

 

ঢাকা থেকে ১৪৫ কি.মি. পশ্চিমে ৬টি শাখা নদী বেষ্টিত সিরাজগঞ্জ জেলার সর্ব বৃহৎ উপজেলাটির নামই উল্লাপাড়া। এর আয়তন ৪১৪.৪৩ বর্গ কি.মি.। মোট ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বিশিষ্ট এ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকাটি নিয়ে 2001 সালে নতুন মানচিত্র অঙ্কন করে উল্লাপাড়া থানা। নামকরণ হয় উল্লাপাড়া মডেল থানা হিসেবে।

উল্লাপাড়া থানার বর্তমান আয়তন ৩৪৪.১৬ বর্গ কি.মি.। ৩৪৬টি গ্রামের সমষ্টিতে গঠিত উল্লাপাড়া মডেল থানা এলাকায় বর্তমানে বসবাস করে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। যদিও এ পরিসংখ্যানটি ২০১১ সালের হিসেবে বলা হয় তবে বর্তমানে উল্লাপাড়া থানার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়েছে। ত্রিমূখী যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্বলিত উল্লাপাড়া থানা নগরটি ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিল্প-সাহিত্য ও শিক্ষার দিক দিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যতম সমৃদ্ধ থানা এবং উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক নগর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

বর্তমান উল্লাপাড়ার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। সরকারি হিসেব মতে শতকরা প্রায় ৪১.৭৫ শতাংশ মানুষ কৃষি পেশার উপর নির্ভরশীল। আর ২০ শতাংশ ব্যবসা, ৬ শতাংশ চাকুরী, ৩০ শতাংশ শ্রমিক ও ২.২৫ শতাংশ অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত।

এ অঞ্চলের প্রধান রপ্তাণিযোগ্য কৃষি ফসল ধান, পাট, গম, যব, আলু, সরিষা, তিল ইত্যাদি। কল কারখানার মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা ১টি,  ফ্লাওয়ার মিল ২টি, ফিড মিল ১টি, দুগ্ধ শীতলি করন কেন্দ্র ১টি, জুতার কারখানা ১টি, হিমাগার ১টি, বরফ কল ৪৫টি এবং কাপড় বুনন শিল্প প্রায় ১০০টি। তাছাড়াও কিছু কুটির শিল্প তথা বাশ ও বেতের কাজ এবং কতিপয় কিছু কামার-কুমোর পেশাজীবি মানুষের বসবাস রয়েছে উল্লাপাড়া থানা অঞ্চলে। উল্লাপাড়া থানা অঞ্চলে উচ্চ বিত্ত ও নিম্নবিত্ত সব ধরনের মানুষই বসবাস করে। এখানকার নিম্নবিত্ত মানুষেরা সাধারণত এনজিও ভিত্তিক ঋণ নিয়ে তাদের জীবন উন্নয়নের চেষ্টা করে। উল্লাপাড়া উপজেলা সীমানার মধ্য দিয়ে মোট ৬টি নদী প্রবাহিত। সেগুলো হলো করতোয়া, ফুলজোড়, সরসতী, মুক্তাহার, গোহালা এবং ঝবঝবিয়া।

 

এক মানচিত্রে এত নদীর সমস্টি সাধারণত সব উপজেলায় দেখা যায় না। এসব নদীগুলোর জন্যই উল্লাপাড়ার প্রকৃতি এত সুন্দর। পড়ন্ত বিকালে গ্রামের পিচঢালা সুরুপথে মোটরবাইকে চড়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা। হয়তো এ কারণেই উল্লাপাড়ার যুবকেরা বিকেলে বাইকে চড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। উল্লাপাড়া থানা অঞ্চলের উধুনিয়ার আঞ্চলিক সড়কটিও স্থানীয় যুবকদের একটি প্রিয় স্থান। এখানকার সাড়ে তিন কি.মি. সড়কে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘুরতে আসেন। তারা এটাকে ভালবেসে নাম দিয়েছে অনেকে সিরাজগঞ্জের মিঠামইন।

চারদিকে পানি মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে আঁকাবাঁকা পাকা সড়ক। সড়কের দুই পাশ দিয়ে ছুটে চলে হরেক রকম নৌকা। মাথার ওপর নীল আকাশ, পানিতে সূর্যের কিরণ। বেলা যত গড়িয়ে পরে এখানকার মুগ্ধতা ততই বাড়তে থাকে। এ মুগ্ধময় পরিবেশ খুব অল্প দিনেই হয়ে উঠেছে উল্লাপাড়ার অন্যতম ভালোলাগার স্থান। তাছাড়া উল্লাপাড়া থানা অঞ্চলাধিন কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা রয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, পনের শতকের প্রাচীণ মাক্কাউলিয়া মসজিদ,হযরত বাগদাদী’র মাজার, হিন্দু জমিদার বাড়ি ও পুকুর এবং শাহ্ সুফি সাহান শাহ্ বাগদাদী রহমতুল্লহ্’র মাজার।

অন্যদিকে উল্লাপাড়ার সবুজ ফসলের ক্ষেত, বন-বাগানে নানা পাখির কিচিরমিচির, কৃষকের মিষ্টি হাসি, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর মিষ্টি কথাগুলো আগত যেকোন অতিথিকে মুগ্ধ করে। উল্লাপাড়ার তেজোদীপ্ত লাল সূর্যটা যখন ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশে হারিয়ে যায় তখন নিরবতায় ছেয়ে যায় উল্লাপাড়ার শহর ও নগর। কেবল ব্যস্ত থাকে এলাকার প্রধান সড়ক ও স্টেশন। দেশের সকল জেলার সাথে উল্লাপাড়ার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিম বিভাগের একটি অন্যতম রেল সংযোগ উল্লাপাড়া রেল স্টেশন। এ স্টেশনটি নির্মিত হয় ১৯১৬ সালে। উল্লাপাড়া রেল স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন ১৮টি ট্রেন আসা-যাওয়া করে।

বাংলাদেশের রেল দুর্ঘটনার ইতিহাসে এ শতাব্দির গত দশকে পর পর দুটি রেল দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে উল্লাপাড়া রেল স্টেশনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে উল্লাপাড়া রেল স্টেশন থেকে অনতি দূরে ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রীজের নিকটে ২০শে এপ্রিল, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ও পাক সেনাদের তূমুল সংঘর্ষ  হয় এবং লড়াইয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২০জন সৈন্য নিহত হয়। সে বছর ৯ মাসের প্রাণপন যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন উল্লাপাড়া মাটির বহু কৃর্তিসন্তান। তাদের স্বীকৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে উল্লাপাড়ায় রয়েছে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি গনকবর। সেই রণাঙ্গনের দিনে উল্লাপাড়ার হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্ম-জাতি যেমন এক হয়ে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলো ঠিক তেমনিভাবে এ ভূ-খন্ডের মানুষ আজও সম্পৃতির বন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।

error: কপি না করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।